প্রধানমন্ত্রীর কাছে খোলা চিঠি

ছবি: হাসান রাজা
ছবি: হাসান রাজা

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আমাদের শুভেচ্ছা জানবেন। কোটা সংস্কার আন্দোলনের কারণে দেশে যে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল, সংসদে এ বিষয়ে আপনার বক্তব্যের মধ্য দিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে তার অবসান ঘটেছে। দাবির যৌক্তিকতা, পড়াশোনায় ব্যাঘাত ও ছাত্রীদের নিরাপত্তার বিষয় অনুধাবন করে আপনি সংসদে যেসব কথা বলেছেন, সব মহলে তা প্রশংসিতও হয়েছে। যদিও শিক্ষার্থীরা কোটাব্যবস্থা বাতিল করার দাবি তোলেনি, বরং তা সংস্কারের দাবি তুলেছিল, তবু কোটাব্যবস্থা বাতিল করার ঘোষণা দিয়ে আপনি শিক্ষার্থীদের আবার ক্লাসে ফিরে যেতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। তারা আপনার প্রতি আস্থা রেখে আন্দোলন স্থগিত করেছে। তাদের প্রত্যাশা, আপনার বক্তব্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সম্ভাব্য দ্রুততম সময়ে সরকারি প্রজ্ঞাপন জারি হবে।

কিন্তু এখন আমরা উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করছি, শিক্ষার্থীদের বিভিন্নভাবে হয়রানি করা হচ্ছে। অনেককে মারধর করা হয়েছে, হুমকি দেওয়া হয়েছে এবং হচ্ছে। পুলিশ কয়েকজন আন্দোলনকারী নেতাকে উঠিয়ে নিয়েছিল, পরে ছেড়ে দিয়েছে। এ আন্দোলনের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। সর্বশেষ সুফিয়া কামাল হল থেকে মুঠোফোন তল্লাশি করে বেশ কয়েকজন আন্দোলনকারী ছাত্রীকে মধ্যরাতে বের করে দেওয়া হয়েছে। এসবের ফলে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা গভীর শঙ্কা ও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে।

প্রিয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি জানেন, সাংবিধানিকভাবেই সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা চালু হয়। বাস্তবতার নিরিখে বিভিন্ন সময়ে তা সংস্কারও করা হয়েছে। বর্তমানে সরকারি চাকরিতে ৫৬ শতাংশ কোটার ব্যবস্থা চালু আছে। শিক্ষার্থীরা এটার সংস্কারের দাবি জানিয়ে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছিল। সম্প্রতি তারা ঢাকার শাহবাগ চত্বরে একত্র হলে পুলিশ তাদের ওপর টিয়ার শেল ও রাবার বুলেট ছোড়ে এবং লাঠিচার্জ করে। ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। আহত হয় অনেকেই; সারা দেশে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ পর্যন্ত দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়ে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করতে থাকে। রাজধানীর সড়ক অবরোধ করে তারা আন্দোলন শুরু করে। এতে জনজীবন হয়ে পড়ে বিপর্যস্ত। এই সবকিছুর ইতি ঘটিয়ে নাগরিক জীবনে প্রশান্তি বয়ে আনল সংসদে আপনার বক্তব্য। কিন্তু এ প্রশান্তির স্থায়িত্ব নিয়ে শিক্ষার্থীরা এখন সন্দিহান। কারণ, হয়রানি ও ভয়ভীতি প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে আন্দোলনকারীদের আবারও বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠার দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।

সম্মানীয় প্রধানমন্ত্রী, আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা কোনো মামলা এখন পর্যন্ত প্রত্যাহার করা হয়নি। সম্প্রতি মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে তারা সংবাদ সম্মেলন করেছে। সম্মেলন শেষে তিন আন্দোলনকারী নেতাকে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) চোখ বেঁধে গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে যায় বলে অভিযোগ। পরে ছেড়ে দেয়। একজনের বাবাকেও পুলিশ হেনস্তা করেছে বলে অভিযোগ। অবশ্য ডিবির দাবি, আটক নয়, আলোচনার জন্য ওই তিনজনকে ডাকা হয়েছিল।  শিক্ষার্থীরা পুলিশের এ দাবির প্রতি আস্থা রাখতে পারেনি। তাদের প্রশ্ন, যদি আলোচনার জন্যই হয়, তাহলে এভাবে টেনেহিঁচড়ে, চোখ বেঁধে কেন? প্রতিবাদে শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে আবারও বিক্ষোভ মিছিল বের করে। আমাদের প্রশ্ন, আপনি যেখানে এই আন্দোলনের পরিসমাপ্তি টেনেছেন, সেখানে কারা এবং কার নির্দেশে, কাদের স্বার্থ হাসিলের জন্য শিক্ষার্থী ও তাদের পরিবারকে হয়রানি করা হচ্ছে? তাদের রাজপথে ঠেলে দিয়ে কিংবা জনজীবনকে আবারও অশান্ত করার অপচেষ্টায় কার লাভ? আমরা চাই না ক্যাম্পাস আবারও উত্তাল হয়ে উঠুক; চাই না শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশ ব্যাহত হোক।

শ্রদ্ধেয় প্রধানমন্ত্রী, ইতিমধ্যে আন্দোলনকারী কয়েকজন নেতাকে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে, এ আন্দোলনকে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী বলার চেষ্টা হচ্ছে। প্রমাণ হিসেবে একটি জাতীয় পত্রিকায় এক আন্দোলনকারী নেতাকে নিয়ে প্রকাশিত সংবাদের উল্লেখ করা হয়েছে। অথচ ওই সংবাদটি ওই দিনই প্রত্যাহার করে পত্রিকার কর্তৃপক্ষ দুঃখ প্রকাশ করেছে। তারপরও অপপ্রচার থেমে নেই। অথচ এ আন্দোলন কোনো স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির আন্দোলন বা সরকারবিরোধী আন্দোলন ছিল না। এটি শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন। এ আন্দোলন মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধেও ছিল না। কারণ, কেউ মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিল চায়নি। তারা চেয়েছে সংস্কার, ৫৬ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশে নামিয়ে আনা। তবে আমাদের বিশ্বাস, ২০ শতাংশ কোটা থাকলেও শিক্ষার্থীরা মেনে নিত। এই ২০ শতাংশে মুক্তিযোদ্ধা-পোষ্য, আদিবাসী, প্রতিবন্ধী ও নারী কোটা অন্তর্ভুক্ত হতে পারত। অনেক মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, আদিবাসী, প্রতিবন্ধী ও নারী শিক্ষার্থীও কোটা সংস্কার আন্দোলনে একাত্মতা ঘোষণা করেছে। এমনকি কোটা নিয়ে আপনার বক্তব্যের পর সরকার-সমর্থক ছাত্রসংগঠনও সাধুবাদ জানিয়েছে। কাজেই এ আন্দোলনকে নতুন করে প্রশ্নবিদ্ধ করা কিংবা এ নিয়ে পরিস্থিতি ঘোলাটে করার চেষ্টা কারও জন্যই মঙ্গলজনক হবে না।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আন্দোলনকারীদের সবচেয়ে বড় আতঙ্ক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবন ভাঙচুরের মামলায় তাদের ফাঁসানো হয় কি না; কিন্তু হামলার পরপর উপাচার্য তাঁর বক্তব্যে তিনটি কথা বলেছেন: এক. হামলাকারীরা বহিরাগত, দুই. হামলাকারীরা প্রশিক্ষিত এবং তিন. তাঁকে হত্যার উদ্দেশ্যে এ হামলা করা হয়েছে। সাধারণ জ্ঞানেই বলা যায়, এ তিনটি বিষয়ের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সম্পর্ক থাকতে পারে না। তারা বহিরাগত কিংবা প্রশিক্ষিতও নয়। আমাদের দাবি, অবিলম্বে উপাচার্যের বাসায় প্রকৃত হামলাকারীদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হোক। সাধারণ শিক্ষার্থীদের হয়রানি করা হলে তা হবে ওই অপরাধীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়া।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আন্দোলনকারীরা বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসে। তাঁর কন্যা হিসেবে আপনার প্রতি তাদের আস্থা অপরিসীম। আপনি তা পূরণ করার ব্যবস্থাও নিলেন। কিন্তু মামলা, হয়রানি ও হেনস্তা করে তাদের আস্থা দুর্বল করা উচিত নয়। মামলা প্রত্যাহার করতে এবং হয়রানি-হেনস্তা ও অপপ্রচার রোধে আমরা আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। দেশ এখন উন্নয়নশীল দেশের কাতারে। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার জন্য কোটার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমরা বিশ্বাস করি, আপনার নেতৃত্বে দেশ এমন জায়গায় পৌঁছেছে এবং পৌঁছাবে, যেখানে একসময় কোটার দরকারই হবে না। কারণ, একটি বৈষম্যহীন সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে, যে রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখতেন বঙ্গবন্ধু, দেখছেন আপনি। এমন রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখি আমরাও।

রোবায়েত ফেরদৌস, সৌরভ শিকদার, শেখ শফিউল ইসলাম, এম মাহবুব আলম, সজীব সরকার, মামুন আ. কাইয়ুম, মাহবুবুল হক ভুঁইয়া, জুনায়েদ হালিম, তৌফিক ই-এলাহী, নাসরিন আকতার ও কাজী আনিছ

লেখকেরা বিভিন্ন পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক