কেমন আছে রংপুর বিভাগের নদ-নদী

রংপুর বিভাগে নদ-নদীর সংখ্যা কত, তার এখন পর্যন্ত কোনো পরিসংখ্যান নেই। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড বাংলাদেশের নদ-নদী শীর্ষক ছয় খণ্ডের বই প্রকাশ করেছে। বইটিতে রংপুর বিভাগের মোট ৮২টি নদীর কথা বলা হয়েছে। কিন্তু প্রকৃত নদ-নদীর সংখ্যা ১৬০টির অধিক। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ব্রহ্মপুত্র, আত্রাই, করতোয়া, কাটাখালী, কুলিক, ঘাঘট, চাওয়াই, ডাহুক, তালমা, তিস্তা, তীরনই (ঠাকুরগাঁও), দুধকুমার, দেওনাই, ধরলা, ধাইজান, নাগর, পাথরাজ, বাঙ্গালী, মহানন্দা, গঙ্গাধর।

বাংলাদেশ-ভারত-মিয়ানমার স্বীকৃত আন্তসীমান্ত নদ-নদীর সংখ্যা ৫৭টি। এই ৫৭টি নদীর মধ্যে রংপুর বিভাগের আছে মোট ১৮টি। যৌথ নদী কমিশন স্বীকৃত এই নদীর সংখ্যার বাইরে আরও প্রায় ১০টি আন্তসীমান্ত নদী আছে।

রংপুর বিভাগের বেশ কিছু নদ-নদী এখন প্রায় বিলীন। এ রকম কয়েকটি নদ-নদী—কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার মাসামকুড়া, নাগেশ্বরীর পয়রাডাঙা, রাজারহাট উপজেলার চাকিরপশা, কোটেশ্বর, ঠাকুরগাঁওয়ের ভক্তি, রংপুরের ইছামতী, লালমনিরহাটের চাতলা, দেউল, নীলফামারীর বামনডাঙ্গা, সৈয়দপুরের সরমংলা প্রায় বিলীন। এ রকম আরও অনেক নদ-নদী আছে, যেগুলো নামমাত্র নদীর কঙ্কাল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

রংপুর বিভাগের নদ-নদীগুলো রংপুর বিভাগের প্রায় দুই কোটি মানুষের আশীর্বাদ ছিল। অথচ পরিচর্যার অভাবে এখন এগুলো পরিণত হয়েছে অভিশাপে। প্রতিবছর রংপুর বিভাগে যে ভয়াবহ বন্যা দেখা দেয়, তারও কারণ এই নদীগুলো। নদীগুলোর প্রতি সরকারি-বেসরকারি উদাসীনতা দিনের পর দিন নদীগুলোকে মেরে ফেলার পথ রচনা করেছে। নদী কখনো আপনা থেকে মরে যায় না, তার গতি পরিবর্তন করে। কিন্তু আমরা নদীগুলোকে মেরে ফেলি।

দিনাজপুর শহর গড়ে উঠেছে পুনর্ভবা নদীর পারে। এই নদীর প্রশস্ততা দিনের পর দিন কমছে। আদি রংপুর মাহিগঞ্জ শহর গড়ে উঠেছিল ইছামতী নদীর পারে। সেই নদী এখন একটি নালার চেয়েও সরু। খোকসা ঘাঘট নদ দেখার কেউ নেই। নীলফামারী শহর গড়ে উঠেছিল বামনডাঙ্গা নদীর তীরে। এখন সেই নদীও নালায় পরিণত হয়েছে। কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া বুড়িতিস্তা দখলদারদের কবলে। কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলায় চাকিরপশা নদীর ওপর আড়াআড়িভাবে সরকারি সড়ক করা হয়েছে। পঞ্চগড় জেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া করতোয়া, ঠাকুরগাঁও জেলার টাঙন, গাইবান্ধা জেলার ঘাঘট, নীলফামারীর সরমংলা, রংপুরের চিকলি নদীর শাখা দখলদারদের হাতে পড়ে মৃতপ্রায়।

রংপুর বিভাগের অনেকগুলো নদ-নদীতে বোরো মৌসুমে এখন ধানের চাষ হয়। পঞ্চগড়ের টাঙন, করতোয়া, ভেরসা, বেরং, গোবরা, রণচণ্ডী, তীরনই, ডাহুক, নাগর, যমুনা, কুরুম নদীতে ধান হচ্ছে। নীলফামারীর নাউতারা, বুড়িতিস্তা, ধাইজান, চারা, চারালকাটা, বুড়িখোড়া, বুল্লাই, ইছামতী, বুড়া, নেংটিছেড়া, সরমংলা নদীর বুকেও ধানের চাষ হচ্ছে। লালমনিরহাটের সতী, চাতলা, মালদহ, সঁাকোয়া, ভেটেশ্বের, স্বর্ণামতী, রত্নাই নদীতে ধান ফলানো হয়। তিস্তায় ধান-ভুট্টাসহ বিভিন্ন শস্য উৎপাদিত হচ্ছে। গাইবান্ধার ঘাঘট, কালাপানি, হলহলি, লেংগা, মরুয়াদহ, মাসামকুড়া, তিস্তার শাখা নদীসহ প্রায় সব কটি নদীতেই প্রচুর চাষাবাদ হয়। রংপুরের মানাস, ধুম, খোকসা ঘাঘট, আলাইকুড়ি, বুড়াইল, ভেলুয়া, আখিরা নদীতে অবাধে ধান চাষ করা হচ্ছে। কুড়িগ্রামের ধরলা, বামনি, বুড়িতিস্তা, চাকিরপশা, দেউলা, খলিশাকুড়ি, অর্জুনডারা, কোটেশ্বর, গোদ্ধার, পায়রাডাঙ্গাসহ অনেক নদীতেই চলছে ধানের চাষ। ঠাকুরগাঁওয়ের ভক্তি, শুক, কুলিক, তীরনইসহ অনেক নদ-নদীতেই ধানের চাষ হচ্ছে। দিনাজপুরের পুনর্ভবা, গর্ভেশ্বরী, আত্রাই, ঢেপা, চিরি, করতোয়া, ছোট যমুনা, তিলাইসহ অনেক নদ-নদীতে ধানের চাষ করা হচ্ছে। নদীর মালিক সরকার। যাঁরা ধানের চাষ করেন, তাঁরা মনে করেন, তাঁরা ভূমি অফিসের অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশে একসময় কাগজপত্রও তৈরি করে নেন।

রংপুর বিভাগে কলকারখানা কম হওয়ার কারণে নদীর পানি দূষিত হওয়ার আশঙ্কা অনেক কম। তারপরও অনেক স্থানেই রয়েছে নদীদূষণ। রংপুর শহরের যত ময়লা পানি, তা পতিত হয় ঘাঘটে। মাহিগঞ্জ শহরের ইছামতী নদীও দূষণের শিকার। নীলফামারীর সৈয়দপুরের কারখানার বর্জ্য গিয়ে পড়ে খড়খড়িয়া নদীতে। নীলফামারীর বামনডাঙ্গা নদীর শেষ অস্তিত্বটুকু বিলীন হতে বসেছে মূলত দূষিত পানি ও ময়লা-আবর্জনা ফেলার কারণে। পঞ্চগড়ের বোদা পৌরসভার পাথরাজ নদী পরিণত হয়েছে ভাগাড়ে। বিশেষ করে যে নদীগুলোর পাশে শহর গড়ে উঠেছে, সেগুলোই দূষণের শিকার হচ্ছে।

যখন বর্ষা মৌসুম আসে, তখন রংপুর বিভাগের দেড় শতাধিক নদী যৌবন ফিরে পায়। নদীগুলো খনন না করার কারণে বর্ষা মৌসুমে পানি ধারণ করতে পারে না। পাড় উপচে বন্যা নেমে আসে। গত বছর কুড়িগ্রামের কাঁঠালবাড়ীসহ বেশ কিছু নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে।

দখল ও দূষণ থেকে নদীগুলোকে কে বাঁচাবে? এ ব্যাপারে সরকার ও স্থানীয় জনগণের সম্মিলিত উদ্যোগ প্রয়োজন। নদী বাঁচানো না গেলে আমাদের কৃষি-অর্থনীতি, জীববৈচিত্র্য, পরিবেশ—সবকিছুই বিপর্যয়ের মুখে পড়বে।

তুহিন ওয়াদুদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক এবং রিভারাইন পিপলের পরিচালক