গুজবের বাঘ ও সুফিয়া কামাল হলের রাত

কবি সুফিয়া কামাল হল। ছবি: ফাইল ছবি
কবি সুফিয়া কামাল হল। ছবি: ফাইল ছবি

সরকারের শত্রু তালিকায় নতুন নাম যোগ হয়েছে। তার নাম গুজব। গুজব আগে কানে কানে বলা হতো, এখন বলা হয় ফেসবুকে। গুজবে গজব নেমে আসতে পারে, যেমন দেখা গিয়েছিল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে হামলার সময়। আবার গুজব গর্জন হয়ে আন্দোলন ছড়িয়ে দিতে পারে। শাহবাগ গণজাগরণ উসকে দিয়েছিল এই গুজব যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় নিয়ে সরকার আপস করছে। এর আগে ‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধে বিএনপি-জামায়াতের ষড়যন্ত্র’ বিষয়ে সরব ছিল সরকারি মহল। এই গুজবের ওপর ভিত্তি করে সরকার অনেক দমনমূলক কর্মসূচিও চালায়। তাদের বিশ্বাস, এই গুজবের বাস্তব ভিত্তি রয়েছে। যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে আপসের গুজবেরও বাস্তব ভিত্তি ছিল, তেমনি কোটা সংস্কার আন্দোলনে দমন-পীড়নের গুজবেরও বাস্তব ভিত্তি পাওয়া গেছে। যা রটে তা কিছুটা বটে।

কোটা সংস্কার আন্দোলনের তুঙ্গে মধ্যরাতে পুলিশ ও ছাত্রলীগের যৌথ হামলার মধ্যে কয়েকজন ছাত্র বারুদ, বুলেট ও রাবার বুলেটে লুটিয়ে পড়লে গুজব ছড়িয়ে পড়ে। মধ্যরাতে সুফিয়া কামাল হলে আন্দোলনকারী একটি মেয়ের রগ কাটার গুজবও সবাইকে চমকে দিয়েছিল। সেই হল থেকে আবারও মধ্যরাতে ছাত্রী বহিষ্কারের খবর গুজবের দ্রুততায় ছড়িয়ে পড়লে নিন্দা-প্রতিবাদ ছড়াল। গুজবগুলো মিথ্যা ছিল না, সেগুলো আসলে খবরের ভগ্নাংশ। ঢাবিতে সেই রাতে সত্যিই গুলি চলেছিল এবং আশিকুর নামে এক ছাত্র সত্যিই প্রাণঘাতী বুলেটবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছিল। তা ছাড়া রাবার বুলেটেও আহত হয়েছিল বেশ কজন ছাত্র। সত্যি সত্যিই একটি মেয়ের পায়ে ধারালো কিছুর পোচ দেওয়া হয়েছিল এবং রক্ত ঝরেছিল। হলে হলে নির্যাতন চলার খবরটিও সঠিক। কিন্তু খবরগুলো সঙ্গে সঙ্গে গণমাধ্যমে আসতে পারল না। গুলিবিদ্ধ আশিকুর এবং রক্তাক্ত পায়ের মেয়েটিকে লুকিয়ে ফেলা হলো। অথচ ঢাকা বিশ্বিবদ্যালয়ের ভিসি ও প্রক্টর স্বয়ং এশা নামের মেয়েটির বিরুদ্ধে রগ কাটার অভিযোগের সত্যতা পেয়েছেন বলে গণমাধ্যমে জানান। তাহলে কি তাঁরাও গুজব রটনাকারী হিসেবে চিহ্নিত হবেন?

এমন পরিস্থিতিই গুজবের বসন্তকাল। সময়ের জ্বলন্ত প্রশ্নগুলোয় মিডিয়া হাত দিতে পারবে না, চোখ ঝলসানোর ভয়ে টিভি ক্যামেরা তা দেখবে না। সরকারি প্রেসনোটের মাঝখানে বিরাট ফুটো দেখা গেলে জানা যায়, সত্যটা ওই পথেই পগার পার। এমন দিনেই তারে বলা যায়, ‘শুনেছ নাকি, আসলে কী হইছে?’...আমাদের কালের দুর্ধর্ষ গুজবগুলো সেসব প্রশ্নেরই উত্তর অফার করে, যার উত্তর মিডিয়া কিংবা সরকারি ভাষ্যে নিখোঁজ। ধামাচাপা দেওয়া খবরই গুজবের জনক। কোনো আইন বা শাস্তিই গুজব একেবারে বন্ধ করতে পারে না। সঠিক খবর ও সত্যের প্রকাশ করুন, গুজব মিলিয়ে যাবে।

কিন্তু গুজবেরও সমস্যা আছে। গুজব কখনোই পূর্ণ সত্যটা জানাতে পারে না। কারণ, গুজবের কোনো লাইসেন্সপ্রান্ত এজেন্সি নেই, গুজবের লাইসেন্স কেবল প্রশ্ন করার। উত্তরের দায়, প্রমাণের গরজ তার নেই। গুজব অনেক সময় সঠিক প্রশ্নটাই করে, অর্থাৎ ঘটনা সম্বন্ধে কৌতূহল প্রকাশ করে। গুজব খণ্ডনের দায়িত্ব কিন্তু সরকারের, মিডিয়ার। মিডিয়া যদি ক্যাম্পাসে গুলি, ভিসি ভবনে জ্বালাও-পোড়াও বিষয়ে সঙ্গে সঙ্গে পরিষ্কার খবর দিতে পারত, তাহলে গুজবের সুযোগই থাকত না। গুজবের তালি তাই এক হাতে বাজে না। একটি সঠিক খবরই কিন্তু গুজবের ডানা কাটার জন্য যথেষ্ঠ। যখন জনগণের সত্য জানার তৃষ্ণা মেটে না, তখন গুজবই তাদের কান ধরে টানে। সবচেয়ে বড় কথা, সরকার কিংবা গণমাধ্যম আস্থা হারালে গুজব ডালপালা ছড়াবেই। এসব গুজবে জনগণের কৌতূহল প্রকাশ পায় মাত্র, হিংসা নয়।

গুজব দমনমূলক পরিস্থিতির বাইপ্রোডাক্ট। তা জানায়, দেশে জবাবদিহি নেই, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নেই। সরকারি পানিব্যবস্থা দূষিত হলে মহামারি লাগে, তেমনি প্রতিষ্ঠিত তথ্যব্যবস্থা আস্থা হারালে গুজবের মহামারি আসে। গুজব ভয়ানক সংক্রামক। উদ্বিগ্ন জাতি গুজবে কান পাতবেই। মানুষ কী বলছে তা বোঝার জন্য সরকারি সংস্থাও গুজবে কান পাতে, কিন্তু বিশ্বাস করে ‘আসল’ জিনিসটাই। কারণ, ‘আসল’ ঘটনা জানার জন্য তাদের আছে প্রশাসন, গোয়েন্দা সংস্থা ইত্যাদি। গুজবে কান পাতে তারাই, যারা জানতে পারে না ‘আসলে’ কী ঘটেছে। গুজবের সহজ সমাধান হলো সত্যটা স্বীকার করা, মানুষের জানার অধিকারকে শ্রদ্ধা করা।

গুজব মিথ্যার বিরুদ্ধে ক্লান্তিহীন গেরিলা। গুজব জনগণের মিডিয়া। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান বাহিনীকে গুজবের গেরিলা আক্রমণও মোকাবিলা করতে হয়। এসব গুজব বাড়িয়েছিল মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল আর ভীত করেছিল হানাদারদের। উত্তরহীনতার পরিবেশে গুজবের পাল্লাই ভারী হয়। তখন তা এমন সব ‘সত্য’ পয়দা করে, যা আর প্রমাণের ধার ধারে না। সত্য তখন জানার বিষয় থাকে না আর, বেছে নেওয়ার বিষয় হয়। গুজবের বাজারে এখন অনেক ‘সত্য’। নিজ নিজ রাজনৈতিক পক্ষ অনুসারে মানুষ পছন্দের ‘সত্য’ বেছে নিচ্ছে।

হিংসা ও নির্যাতনের উদ্দেশ্যেও গুজব ছড়ানো হয়। ক্ষমতাসীন পক্ষের গুজব কিন্তু নিরীহ না। আন্দোলন ও ভিসি ভবনে হামলা সম্পর্কে ‘রাজাকার তত্ত্ব’ তাঁদেরই অবদান। তারপর আন্দোলনকারীদের মধ্যে রাজাকার খোঁজার ছাঁকনি ফেলা হলো। এসব গুজবের ভিত্তিতে দমন-পীড়ন ও ধরপাকড় চলতে দেখা গেল। সত্যহীনতার অন্ধকারে, বিভক্ত জাতির হট্টগোলে গুজবের ডানায় ভর দিয়ে আসে ভয়। সামাজিক মাধ্যমে, গণমাধ্যমে, নেতা-নেত্রীদের বক্তৃতায় ভয়ের গুজব ছড়ানো হচ্ছে, বিভিন্ন রকম তালিকা নাকি তৈরি হচ্ছে ইত্যাদি। ঢাকা বিশ্বিবদ্যালয়ের প্রশাসন আন্দোলনকারী মেয়েদের ফেসবুক তল্লাশি করে তাদের গুজব রটনাকারী বলে অভিযুক্ত করছে। এভাবে সত্যকে গুজব, আর গুজবকে সত্য বলার ফাঁদে ফেলা হচ্ছে অনেককে।

মিথ্যাবাদী রাখালের গল্পটা আমরা জানি। বারবার মিথ্যা হুঁশিয়ারি দিয়ে দিয়ে এতই ফালতু হয়ে গিয়েছিল সেই রাখাল যে সত্যিই যখন বাঘ এল, তখন কেউ তার ডাকে সাড়া দিল না। গল্পটা এবার বাঘের দিক থেকে পাঠ করা যাক।

সব বাঘ মিলে এক বাঘকে দায়িত্ব দিল, গরু-মহিষ এলেই তুমি আমাদের খবর দেবে, আমরা একসঙ্গে খাব। চতুর বাঘ প্রায়ই গরু গরু বলে চেঁচায়। বাঘেরা এসে দেখে সব ভাঁওতা। অবশেষে একদিন সত্যিই গরুর পাল পথ ভুলে বনের পাশে এল। ধূর্ত বাঘ সেদিনও সবাইকে ডাকল; যথারীতি কেউ এল না। এই সুযোগে বাঘটি একাই গরুটিকে সাবাড় করল। গল্পের শিক্ষাটা মূল্যবান। মিথ্যাবাদী হওয়ার সুবিধা কেবল বাঘই, অর্থাৎ ক্ষমতাবানেরাই পায়, রাখাল ও তার গরুরা কেবল শিকারই হয়।

ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সাংবাদিক।
[email protected]