সেনা মোতায়েন নিয়ে রশি-টানাটানি

আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা উচিত-এ ধরনের একটি মন্তব্য করে কয়েক মাস আগে নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার বিপাকে পড়েছিলেন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদা পাল্টা মন্তব্য করে বলেছিলেন, কমিশনে এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। আবার কয়েক দিন আগে সিইসি বললেন, নির্বাচনের সময় সেনা মোতায়েন থাকা উচিত। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, এটা তাঁর ব্যক্তিগত মত।

সিইসি বা কোনো নির্বাচন কমিশনার ব্যক্তিগত মতামত কেন দিতে যান, এ নিয়ে তর্ক হতে পারে। এবার অবশ্য সিইসির মন্তব্য নিয়ে কমিশনের অন্য কোনো সদস্য প্রকাশ্যে কিছু বলেননি। তাহলে কি এটাই ধরে নিতে হবে যে, কয়েক মাস আগে মাহবুব তালুকদার যা বলেছিলেন সিইসি কে এম নুরুল হুদা সেটির পুনরুক্তি করলেন? বোঝা যাচ্ছে, সেনা মোতায়েনের ব্যাপারটি নিয়ে নির্বাচন কমিশনে কথাবার্তা হচ্ছে।

কিছুদিন আগে রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের এক পশলা সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ওই সংলাপে যেসব মতামত পাওয়া গিয়েছিল, তাতে দেশের বিরাজমান রাজনৈতিক বিভক্তির প্রতিফলন ছিল। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোটের শরিকেরা কেউ সেনা মোতায়েনের পক্ষে বলেননি। তাঁরা বরং বলেছেন, সেনা মোতায়েনের প্রয়োজন নেই। বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটের শরিকেরা সবাই এক সুরে নির্বাচনে সেনা মোতায়েনের পক্ষে বলেছেন, এমনকি কেউ কেউ ওই সময় সেনাবাহিনীকে ‘ম্যাজিস্ট্রেসি’ ক্ষমতা দেওয়ারও প্রস্তাব করেছিলেন।

নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে গণমাধ্যম এবং নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের বৈঠক হয়েছিল। সেখানেও সেনা মোতায়েন সংক্রান্ত প্রস্তাবে জাতীয় রাজনীতির বিভক্তি ফুটে উঠেছিল। অর্থাৎ এ বিষয়টি নিয়ে যে ‘জাতীয় ঐকমত্য’ নেই, তা স্পষ্ট।

সিইসি নুরুল হুদার সাম্প্রতিক মন্তব্য মাটিতে পড়ার আগেই লুফে নিয়েছিলেন ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তিনি মন্তব্য করেছিলেন, সেনা মোতায়েনের বিষয়টি নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ারবহির্ভূত। এ নিয়ে টেলিভিশনের টক শো এবং ফেসবুক কয়েক দিন বেশ গরম ছিল।

ওবায়দুল কাদের কোনো সদ্য গজিয়ে ওঠা নেতা নন। ছাত্রলীগ-আওয়ামী লীগে তাঁর সরব উপস্থিতি দীর্ঘ পাঁচ দশকের। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন। একটি জাতীয় দৈনিকের সম্পাদকীয় বিভাগে কাজ করেছেন অনেক বছর। আমার ধারণা ছিল, তিনি আমাদের সংবিধান দেখেছেন এবং পড়েছেন। তাঁর মন্তব্য শুনে আমার খটকা লাগল।

আমাদের সংবিধানের ১২৬ অনুচ্ছেদে লেখা আছে, ‘নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পালনে সহায়তা করা সকল নির্বাহী কর্তৃপক্ষের কর্তব্য হইবে।’ এর মানে কী? সরল বুদ্ধিতে আমি যা বুঝি তা হলো, নির্বাচন কমিশনের চাহিদা অনুযায়ী সব ধরনের সহযোগিতা দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারের বাধ্যবাধকতা আছে। এটা উচিত-অনুচিতের ব্যাপার নয়, বাধ্যবাধকতার ব্যাপার। সংবিধানের ইংরেজি ভাষ্যে কথাটি এভাবে লেখা হয়েছে: ‘ইট শ্যাল বি দ্য ডিউটি অব অল এক্সিকিউটিভ অথরিটিজ টু অ্যাসিস্ট দ্য ইলেকশন কমিশন ইন দ্য ডিসচার্জ অব ইটস ফাংকশনস।’ ‘শ্যাল বি দ্য ডিউটি’র সোজা বাংলা
হলো ‘অবশ্যপালনীয়’। অর্থাৎ নির্বাচন কমিশন যদি সেনা মোতায়েন করতে চায়, তাহলে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এই ‘অনুরোধ’ তামিল করতে বাধ্য। যদি
তা না করে, তাহলে সেটা হবে সংবিধানের নির্দেশনার বরখেলাপ।

প্রশ্ন হলো, নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের সময় সেনা মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নেবে কি না, বা নিলে কী কারণে নেবে। আমাদের সিভিল প্রশাসন ও পুলিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে দলীয়করণের ঢালাও অভিযোগ আছে। নির্বাচনের সময় অনেকেই তাদের ওপর আস্থা রাখতে পারেন না। এ প্রসঙ্গে একটি উদাহরণ না টেনে পারছি না। ২০০৭ সালে সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় এ টি এম শামসুল হুদার নেতৃত্বে তিন সদস্যের নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়েছিল। ২০০৮ সালে কমিশনের সঙ্গে সংলাপে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিরা নির্বাচনে সেনাবাহিনীর দায়িত্ব পালনের পক্ষে ছিলেন। প্রতিনিধিদলে ছিলেন জিল্লুর রহমান, সাজেদা চৌধুরী, আব্দুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, মতিয়া চৌধুরী প্রমুখ। ১০ বছরের মধ্যে এমন কী পরিস্থিতি তৈরি হলো যে, আওয়ামী লীগ সেনা মোতায়েনের বিপক্ষে অবস্থান নিল?

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পর নারায়ণগঞ্জের মেয়র নির্বাচনে নির্বাচন কমিশন সেনা মোতায়েনের দাবি জানিয়েছিল। সরকার ওই দাবিতে সাড়া দেয়নি। নির্বাচনে অবশ্য তেমন গোলযোগ হয়নি, ভালোভাবেই উতরে গেছে নির্বাচন কমিশন। কিন্তু কমিশনের দাবি না মেনে সরকার স্পষ্টতই সংবিধান লঙ্ঘন করেছিল। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ হারলেও আওয়ামী লীগই জিতেছিল এবং একই সঙ্গে বিএনপিও মনে করেছে
যে তাদেরও জিত হয়েছে। কারণ, তাদের অপছন্দের প্রার্থী হেরেছেন। ফলে, সেনা মোতায়েন না করা নিয়ে জল বেশি ঘোলা হয়নি।

নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হবে কি না, সে বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের সদস্যরা নিশ্চয়ই জেনে-বুঝে একটি সিদ্ধান্ত নেবেন। ধারণা করি, তাঁরা নিশ্চয়ই পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছেন এবং জনমতের দিকেও তাঁদের খেয়াল আছে। ভোটার উপস্থিতি এবং ভোটারের নিরাপত্তা নিয়েও তাঁদের উদ্বেগ আছে বলেই মনে হয়। তবে সেনা মোতায়েন নিয়ে এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। কমিশনের সদস্যরা বুঝেশুনে সিদ্ধান্ত নেবেন এবং পরিস্থিতি সামাল দেবেন বলে আমি আশাবাদী।

তবে একটা প্রশ্ন থেকেই যায়। নির্বাচনের দিন বা ওই সপ্তাহটি যদি আমরা সিভিল প্রশাসনের ওপর আস্থা রাখতে না পারি এবং সেনাবাহিনীর উপস্থিতি বা অংশগ্রহণ ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচন না হওয়ার আশঙ্কা করি, তাহলে এর পরের পাঁচ বছর আমরা কার ওপর নির্ভর করব? আমরা কি একটি টেকসই নির্বাচন ব্যবস্থার কথা ভাবব না?

নির্বাচনে প্রার্থীদের ওপর প্রতিপক্ষের মাস্তানদের চড়াও হওয়া, ভোটারদের ভয়-ভীতি দেখানো, অপছন্দের দলের পোলিং এজেন্টদের ভোটকেন্দ্রে ঢুকতে না দেওয়া কিংবা ভোটকেন্দ্র থেকে জোর করে বের করে দেওয়া, নির্বাচনের হাওয়া উল্টো পথে বইছে-এমন ধারণা হলে ভোটের বাক্স মাথায় তুলে দৌড় দেওয়া, ভোটকেন্দ্র দখল করে পছন্দের প্রার্থীর পক্ষে ইচ্ছেমতো ব্যালট পেপারে সিল মেরে বাক্সে ঢোকানো-এসব চলে আসছে অনেক দিন ধরে। একটা ভালো নির্বাচনের নিশ্চয়তা দিতে পারে শুধু রাজনৈতিক দলগুলো। ক্যাডার সামলানোর দায়িত্ব তো তাদেরই।

গণতন্ত্রের জন্য সবাই মুখে ফেনা তুলে ফেলেন। কিন্তু ভোটের দিন আচরণটি অনেক সময় হয় বিপরীত। সেনাবাহিনী ডান্ডা দিয়ে মাস্তানদের ঠান্ডা করে আর কয়টি নির্বাচনে করবে? এ দেশে যাঁরা সেনাশাসন চান, তাঁরা তো বলতেই পারেন, সেনাবাহিনী যদি একটা ভালো নির্বাচন করিয়ে দিতে পারে, তাহলে দেশটা তো তা‍রাই ভালোভাবে শাসন করতে পারে।

নির্বাচন কমিশনের হাতে যে ক্ষমতা, তার ছিটেফোঁটাও তাঁরা ব্যবহার করেন না। কোথাও গোলমাল হলে তাঁরা বলেন, লিখিত অভিযোগ পেলে তাঁরা ব্যবস্থা নেবেন। এটা কোনো কথা হলো? সংবাদমাধ্যমের রিপোর্ট দেখে তাঁরা কি দ্রুত যথাযথ পদক্ষেপ নিতে পারেন না? পরিস্থিতি ঘোলাটে
দেখলে তাঁরা তো ওই কেন্দ্রের ভোট স্থগিত বা বাতিল করে দিতে পারেন। পারেন পুরো নির্বাচনটাই বাতিল করে দিতে। একটা ‘খারাপ’ নির্বাচনের দায় কেন তাঁরা নেবেন?

মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক
mohi 2005 @gmail. com