ফেসবুক ফ্যাসাদ

কেউ কেউ তাঁকে বলেছেন ‘অ্যাক্সিডেন্টাল বিলিয়নিয়ার’। ক্যাম্পাসে কোন মেয়েটা সবচেয়ে রূপসী-হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ডরমিটরিতে বসে বন্ধুদের মধ্যে এ নিয়ে অনলাইন ভোটাভুটির এক খেলা খেলতে গিয়ে জাকারবার্গ আবিষ্কার করেছিলেন ফেসবুক নামে আশ্চর্য এক অনলাইন পরিসর, যেখানে এখন ২০০ কোটির বেশি মানুষ ঘোরাফেরা করছে। এই সুবাদে তিনি হয়ে উঠেছেন পৃথিবীর কনিষ্ঠতম কোটিপতিদের একজন। তেত্রিশ বছরের এই তরুণ অবশ্য এই মুহূর্তে বিপাকে আছেন। আমেরিকার সিনেটরদের জেরার মুখে নাস্তানাবুদ হয়েছেন, আস্থা হারিয়েছেন সদস্যদের, আয়ও হারাচ্ছেন। ঘটনা জটিল। ফেসবুক নেহাত মানুষে মানুষে যোগাযোগ ঘটিয়ে দেওয়ার মাধ্যম মাত্র নয়, এটি এক বিশাল, জটিল ব্যবসারও জায়গা। বিশ্ব ফেরিওয়ালাদের নজর এড়ায়নি যে ফেসবুক এক বিশাল মানুষের মেলা। কোনো রকমে সেখানে পসরা সাজিয়ে বসতে পারলেই হলো। এই মেলার ইজারাদার জাকারবার্গ। উপযুক্ত মূল্য পরিশোধ করতে পারলে জাকারবার্গ মেলার আশপাশে পসরা নিয়ে বসার অনুমতি দেন।

কিন্তু জাকারবার্গ তাঁর এই ভার্চুযয়াল মেলার প্রতিটি লোককে নামে নামে চেনেন। জানেন তাঁদের নাড়ি-নক্ষত্র। ফলে তিনি জানেন কোথায় গেলে কাচের চুড়ি বিক্রি হবে আর কোথায় গেলে বাতাসা। জাকারবার্গ ফেরিওয়ালাদের ক্রেতা চিনিয়ে দেন। ক্রেতারা কী করেন, কোথায় থাকেন-এসব খবর তো তাঁর কাছে আছেই, সেই সঙ্গে লোকে যে অবিরাম পোস্ট দিচ্ছে, ছবি আপলোড করছে, লাইক দিচ্ছে, শেয়ার করছে, সেখান থেকে তিনি পেয়ে যান লোকের পছন্দ-অপছন্দের খবর। ফেসবুক তার সদস্যদের অনলাইন আচরণের তথ্য অ্যালগরিদমের মাধ্যমে নানা ক্যাটাগরিতে ভাগ করে তা বিক্রেতাদের সরবরাহ করে তাঁদের সুযোগ করে দেয় ‘টার্গেটেড অ্যাডভার্টাইজমেন্টের’। ফলে বিক্রেতারা হুমড়ি খেয়ে পড়েন উপযুক্ত পয়সা দিয়ে ফেসবুক মেলায় হাজির হতে। জাকারবার্গ সাহেবের পকেট ভারী হতে থাকে। এসব তিনি আইনিভাবেই করেন। ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খোলার সময় কে আর খুঁটিয়ে এর শর্তাবলি পড়ে দেখে যে সেখানে ঘুরিয়ে বলা আছে ফেসবুক তাঁদের তথ্যকে অন্যত্র সরবরাহের অধিকার রাখে। ফলে লোকে যখন ফেসবুকে তাঁদের বন্ধুত্ব, ভালোবাসা, ঝগড়া, আত্মপ্রেম, আত্মপ্রচারে ব্যস্ত থাকেন তখন আলগোছে ফেরিওয়ালারা তাঁদের পসরার বিজ্ঞাপন নিয়ে হাজির থাকেন আশপাশে।

কার্ল মার্ক্স সাবধান করেছিলেন যে মুনাফার লোভ বড় ভয়ংকর, সে কেবলই ঠেলে বিপদের দিকে। তেমন এক বিপদের কাজ করেছেন জাকারবার্গ। ব্যবসায়ীদের কাছে ফেসবুক সদস্যদের তথ্য দেওয়ার পর এবার তিনি তাঁর সদস্যদের তথ্য ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছেন ‘কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা’ নামে ব্রিটিশ এক রাজনৈতিক কনসালটেন্সি ফার্মকে। কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা ডিজিটাল পদ্ধতিতে রাজনৈতিক প্রভাব সৃষ্টির পরামর্শদাতা এক অভিনব প্রতিষ্ঠান। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর প্রচারণার জন্য ভাড়া করেছিলেন কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা। এই প্রতিষ্ঠান আমেরিকার প্রায় আট কোটি মানুষের ফেসবুক ডেটা থেকে তৈরি করে তাদের ডিজিটাল প্রোফাইল। তারা মানুষের অনলাইন আচরণ থেকে বের করে কে সম্ভাব্য ট্রাম্পের ভোটার, কে হিলারির, কারা এখনো সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে। এমনকি তারা সদস্যদের পোস্ট, ছবি আপলোড ইত্যাদি থেকে বের করে কে সংবেদনশীল, কে উগ্র, কে জটিল মানসিকতার মানুষ। একে এরা বলে ‘সাইকোগ্রাফি’। প্রতিটি ভোটারের সাইকোগ্রাফি অনুযায়ী তারা তৈরি করে নির্বাচনী ‘টার্গেটেড মেসেজ’। যেমন বিজ্ঞাপনদাতারা করেছে টার্গেটেড অ্যাডভার্টাইজমেন্ট। ট্রাম্পকে কেন ভোট দেওয়া উচিত, সে বিষয়ে মনস্তত্ত্ববিদ আর কমিউনিকেশন বিশেষজ্ঞের সহায়তায় তৈরি করে নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর, ব্যক্তির জন্য নির্দিষ্ট বার্তা এবং সেগুলো তারা পাঠিয়ে দেয় যার যার ফেসবুক পেজে।

সম্প্রতি ব্রিটেনের বিবিসি চ্যানেল ফোরের এক গোপন রিপোর্টিংয়ের মাধ্যমে জানা যায় কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা কত সূক্ষ্ম প্রক্রিয়ায় নির্বাচনকে প্রভাবিত করে। সেই সূত্র ধরেই আসামির কাঠগড়ায় এখন ফেসবুক। জাকারবার্গ অবশ্য বলছেন কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা তাদের বিশ্বাস ভঙ্গ করেছে, গবেষণার কথা বলে তারা সেই সব তথ্য ব্যবহার করেছে নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে।

বিবিসির সেই গোপন রিপোর্টে কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার প্রধান আলেক্সান্ডার নিক্স শ্রীলঙ্কার নির্বাচনের এক ছদ্মবেশী প্রার্থীকে বলছেন, ‘নির্বাচনের সময় কোনো ঘটনা সত্য কি না, সেটা ব্যাপার নয়। আসল ব্যাপার হচ্ছে ঘটনাটাকে সত্যের মতো দেখাচ্ছে কি না। আমরা সেই ব্যবস্থাই করে দিই।’ দেখা যাচ্ছে, ডিজিটাল পৃথিবী এই ছদ্ম সত্য তৈরির এক মহাকারখানা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ইতিহাসবিদ ড্যানিয়েল জে. বুরস্টিন সেই ষাটের দশকে মিডিয়ার প্রবল বিকাশের দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, পৃথিবীতে ক্রমে এখন অনেক বেশি ছদ্ম ঘটনা (psudo-event)। অর্থাৎ যা ঠিক ঘটনা নয় কিন্তু ঘটনার মতো দেখায়, সে রকম ছদ্ম ঘটনা বা ঘটনার ছল তৈরি হতে থাকবে। এই ইন্টারনেট ও ফেসবুকের যুগে যা সত্য হওয়ার কথা নয়, তা-ই সত্য হয়ে উঠছে অবিরাম। ট্রাম্পের আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হওয়া তেমনি এক ছদ্ম ঘটনারই নমুনা।

আমাদের দেশে ডিজিটাল পদ্ধতিতে এ ধরনের ঘটনার ছল তৈরি করা আরও সহজ। প্রযুক্তির সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজন প্রযুক্তি সাক্ষরতা, কিন্তু ঠিকঠাক বুঝে ওঠার আগেই নতুন নতুন নানা প্রযুক্তি যুক্ত হচ্ছে আমাদের জীবনে। ডিজিটাল জগতের যে বিশাল, জটিল সামাজিক মাত্রা, সে সম্পর্কে কি সঠিক সচেতনতা আছে এ দেশের অধিকাংশ মানুষের? কোনো একটা ব্যাপারকে উপরিতলের উত্তেজনার বদলে জ্ঞানতাত্ত্বিকভাবে বোঝার চেষ্টা আছে কি? সন্দেহ করি। ফলে ফেসবুক অনায়াসে হয়ে উঠতে পারে গুজব, হুজুগ বা ছদ্ম ঘটনা তৈরির মাঠ।

তবে সন্দেহ নেই, ফেসবুক আমূল পাল্টে দিয়েছে সামাজিক যোগাযোগের ধরন, তৈরি করে দিয়েছে ভিন্নমত প্রকাশের বিকল্প পথ, পৃথিবীর নানা প্রান্তে জন্ম দিয়েছে যুগান্তকারী সামাজিক আন্দোলনের। ফেসবুকসহ নতুন নতুন ডিজিটাল উদ্ভাবনকে আলিঙ্গন করাই পৃথিবীর ভবিষ্যৎ। কিন্তু দরকার এর বিপদগুলো সম্পর্কেও সতর্কতা। অনলাইনে সক্রিয় একজন একাকী মানুষের সামনে কম্পিউটার স্ক্রিন একটি নিভৃত প্রাইভেট পরিসরের বিভ্রম তৈরি করতে পারে।

শাহাদুজ্জামান: কথাসাহিত্যিক
[email protected]