ভাই সাহেব, ভালো হয়ে যান

প্রতিদিন একটা খবর পেতে আমরা অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি—ধর্ষণের খবর। একটা ধরনের খবর একটু কম পাই, কিন্তু হচ্ছে প্রতিদিন, ক্ষণে ক্ষণে। সেটা হলো ফেসবুকের মাধ্যমে নারীদের কুপ্রস্তাব পাঠিয়ে যাওয়ার খবর বা যেকোনোভাবে হয়রানি করার খবর। কিছু কিছু পুরুষ সামাজিক মাধ্যমে নারীদের হেনস্তা করেন। ভাবেন, এটা কোনো ব্যাপার না। এক চলচ্চিত্র পরিচালককে জড়িয়ে একটা ঘটনা ঘটল। সেটার সমাপ্তি হলো যেভাবে, মনে হলো উনি কিছু করেননি, কিন্তু কোনোভাবে পড়ে গেছেন কারোর চক্রান্তে। কিন্তু মন্দের ভালো এই যে অনলাইন যৌন নিপীড়ন নিয়ে অনেক কথা হয়েছে এই সুযোগে।

বলা বাহুল্য, এটা নতুন কিছু নয়। কিন্তু এটা নিয়ে কথা বলা প্রয়োজন, কারণ এটা নিয়ে আমরা কথা সাধারণত বলি না। বলি না, কারণ আমরা ভাবি, এটা তো অল্পের ওপর বেঁচে যাওয়া। যে দেশে প্রতিদিন ধর্ষণ হয়, এমনটা ভাবা খুব ভুল না। ধরা যাক, ভালো উদ্দেশ্য থেকেই হয়তো এটা ভাবা।

কিন্তু এমন কাজ কে করে?

বেশির ভাগ মানুষ ভাবেন, এসব করে মহল্লার বখাটে ছেলেরা। কিন্তু তা ঠিক নয়। রুচিশীল, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত বা শিক্ষাঙ্গনে বহুল পরিচিত লোকেরাও এমন কাজ করে থাকেন বলে আমরা জানি। এ রকম লোকদের থেকে আমরা আরেকটু বেশিই আশা করি, তাই বিশ্বাস করতে অসুবিধা হয়। আমরা মনে করি, তাঁরা যেহেতু সমাজ ও বৈষম্য নিয়ে ভাবেন অথবা বলেন, তাঁরা নিজেরাই সেই বৈষম্যের প্রসারে শামিল হবেন না। যেহেতু তাঁদের আমরা শিল্পী বা আঁতেল হিসেবে গণ্য করি, আমরা আগে-পিছে তেমন চিন্তা না করেই তাঁদের ছোটখাটো একটি মঞ্চে বসিয়ে রাখি, তাঁদের গুণীজন হিসেবে মেনে নিই, শ্রদ্ধা করি।

কিন্তু দোষ হয় নারীদের। তাঁরাই নিশ্চয়ই এই লোকদের উসকানি দেন?

তাই এটা বলতেই হয়—এসব কুপ্রস্তাব, যৌন হয়রানি, যৌন নিপীড়ন ইত্যাদি নিয়ে নারীরা তেমন মিথ্যা বলেন না। বলেন না, কারণ সেটার ভার পড়ে তাঁদেরই ওপর। মেয়েরা যে তাঁদের নিজেদের নিপীড়নের জন্য দায়ী, এমনটা বিশ্বাস করেন অনেকেই। শুধু আমাদের দেশে না, সব জায়গায়। এবং এই বিশ্বাস করা নিয়ে কারোর কোনো লজ্জা নেই। তাঁরা অবলীলায় বলে ফেলবেন, এত রাতে পুরুষ মানুষের সঙ্গে কথাইবা কেন বলতে গেলেন ওই নারী? উনি জানেন না পুরুষ মানুষ কী জিনিস?

আসলে জানি। কিন্তু মাঝেমধ্যে তাঁদেরও সম্মান করতে ইচ্ছা হয়। কী করব। মেয়েলি স্বভাব বলতে পারেন। জি, টিটকারি মেরেই বললাম। তা ছাড়া আর কী আছে। পুরুষতান্ত্রিক নিয়ম দ্বারা শাসিত এই সমাজে পুরুষ মানুষের টিটকারি খেয়ে বড় হওয়া নারী আমরা। তাঁদের থেকেই হয়তো শেখা। পুরুষতন্ত্র যখন সর্বত্র আধিপত্য বিস্তার করে আছে, আমরা নারী বলেই যে তা মানব না বা সেটাকে সাধারণ ব্যবস্থা ভেবে নেব না, তা তো না। সামাজিক পরিবেশ থেকে আমরা সবাই কিছু না কিছু শিখি। এবং আমরা যারা বুঝি, এই সমাজের সমস্যাগুলো কী, আমরা নিজেদের সঙ্গে প্রতিদিন একটা লড়াই করি, সমাজ থেকে শেখা অসভ্য চিত্রগুলোকে ভুলে যাওয়ার জন্য, যুদ্ধ করি ছোটবেলা থেকে আত্মস্থ করা জ্ঞানকে প্রত্যাখ্যান করার জন্য।

সমস্যা হয় যখন আমরা ভুল জিনিস শিখি, সেটার প্রয়োগও করি, কিন্তু মনে করি যে খুব ভালো কাজ করছি।

একটা উদাহরণ দিই। নৈর্ব্যক্তিক উদাহরণ বুঝতে হয়তো আরেকটু সুবিধা হবে।

‘লিন ইন বাংলাদেশ’ নামে একটি আলাপের আয়োজন করা হয়েছিল সম্প্রতি আইপিডিসির আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতায়। ফেসবুকের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা শেরিল স্যান্ডবার্গ প্রথম ‘লিন ইন’ নিয়ে বলেছিলেন তাঁর ২০১৩ সালে প্রকাশিত বইয়ে। তাঁর মতে, কর্মক্ষেত্রে নারীদের পিছিয়ে থাকার কারণ অনেকটা তাঁরা নিজেরাই। তিনি বলেন, নারীদেরই অফিস কর্মকাণ্ডে আরও আগ্রহী হয়ে অংশগ্রহণ করতে হবে। ক্যারিয়ারে সাফল্য থেকে শুরু করে সুখী সংসার জীবন—আমরা চাইলে সবকিছুই পেতে পারি, আমাদের সমস্যা হলো, আমরা আসলে চাই-ই না।

কথাগুলো শুনতে সুন্দর। তবে সুন্দর হলেও বোঝা খুব কঠিন না যে স্যান্ডবার্গ মূলত তাঁর সমগোত্রীয় নারীদের কথা বলছেন। অর্থাৎ উচ্চশিক্ষিত, উচ্চবিত্ত শ্রেণির প্রফেশনাল নারী। নিম্নমধ্যবিত্ত কাতারের নারীর কথা তিনি বলছেন না, একসঙ্গে তিন-চারটি পার্টটাইম চাকরি করে হিমশিম খাওয়া নারীদের কথাও উনি বলছেন না। তিনি বলছেন তাঁর শ্রেণির নারীদের শামিল হওয়ার কথা, পুরুষদের সঙ্গে, এমনকি পুরুষতন্ত্রের সঙ্গেও। তিনি বলছেন অধিকারপ্রাপ্ত নারীদের কথা।

অথচ সত্যি কথা হলো যে স্যান্ডবার্গের উপদেশবাণী যুক্তরাষ্ট্রের বেশির ভাগ খেটে খাওয়া নারীর ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নয়। কারণ, অধিকাংশ চাকরিজীবী নারী শেরিল স্যান্ডবার্গের মতো সমাজের উঁচু স্তর থেকে নন, তাঁদের জীবনও তাঁর মতো এত আলিশান নয়। তাঁরা ইচ্ছামতো চাইলেই কিছু করতে পারবেন, তাও না। নানা কাঠামোগত কারণে তাঁরাও পিছিয়ে আছেন।

তো স্যান্ডবার্গের বক্তব্য যদি তাঁর নিজ দেশেই না খাটে, তাহলে এটা আমাদের দেশের নারীদের জন্য প্রযোজ্য হলো কীভাবে? হয়নি। এ ধরনের আয়োজন প্রমাণ করে যে আমরা আসলে আমাদের নিজেদের অবস্থান নিয়ে কিছুই জানি না, মনে করি যুক্তরাষ্ট্রে যে হালফ্যাশনের আলাপ হচ্ছে, সেটার সঙ্গে তাল মেলালেই হবে। ওই দিকে যে শত শত নারী নিপীড়িত হচ্ছেন প্রতিদিন, সেদিকে খেয়াল নেই। পাশ্চাত্য থেকে আমরা ভুলভাল শিখছি, অপ্রাসঙ্গিক বিষয় শিখছি, তোতাপাখির মতো ‘লিন ইন’ নিয়ে আলাপ করছি, আরে তাই তো, আমরা একটু এগিয়ে বসলেই হবে।

যা-ই হোক, এই উদাহরণের পেছনে মূল বক্তব্য এই যে আমরা ভুল শিক্ষা শিখে যাচ্ছি নিয়মিত। প্রচুর লোক শিখেছেন যে এ রকম প্রস্তাব করা যায়। আমরা যে ধরনের অতিযৌনায়িত (হাইপারসেক্সুয়ালাইজড) সমাজে বাস করি, এমন প্রস্তাব করা হয়তো অস্বাভাবিক কিছু না। অন্যদিকে, আবার আমরা নারীরা একটু একটু করে শিখছি আমাদের নিজেদের শরীর সম্বন্ধে। কেউ চাইলেই আমাদের যা ইচ্ছা বলতে পারবে, সেই যুগ আর নেই। এই মেমোটা হয়তো অনেক পুরুষের চোখে পড়েনি এখনো।

যে দেশে বউ পিটালেও সবাই নারীর দোষ খোঁজেন, সেই দেশে ফেসবুকের কুপ্রস্তাবের কথা শুনে মানুষ চটেছিল জেনে আমার ভালোই লেগেছিল। ঘটে যাওয়া এসব ঘটনার পর আমরা হয়তো আশা করতে পারি, যাঁরা এমন কাজ করে থাকেন, তাঁরা জানেন অশ্লীল প্রস্তাব পাঠানো ঠিক না। আমরা আশা করতে পারি, তাঁরা লজ্জিত বোধ করছেন। এই বিতর্কের মাধ্যমে আমরা জেনেছি, মানুষ যৌন নিপীড়ন নিয়ে কী ভাবেন। কী বলেন। কিছু কিছু যৌন নিপীড়কের মুখোশও খুলে এসেছে বোধ করি।

তাঁদের উদ্দেশ করে একটু বলি:

আপনারা যাঁরা নিপীড়ক, যাঁরা যৌন নিপীড়ন করেন, বাস্তবে কিংবা অনলাইন, স্বীকার করুন যে আপনি ভুল করেছেন। বিবেচনা করে দেখুন, কেন আপনি এ রকম কাজ করলেন। কেন আপনার মতো মানুষ এ রকম করে থাকে। বিবেচনা করুন, আপনার কারণে আরেকজনের কী ধরনের ক্ষতি হলো। চিন্তা করুন, এ ধরনের আচরণ কী প্রভাব ফেলে সমাজের ওপর। পারলে সহমর্মিতা প্রকাশের চেষ্টা করুন। এরপর মাফ চান। এ রকম যাতে আর না ঘটে, তার ব্যবস্থা করুন। আপনার কোনো মানসিক সমস্যার কারণে আপনি এ রকম করে থাকলে সাহায্য নিন। আর সবচেয়ে গুরুতর যে উপদেশ, নারীদের মানুষ হিসেবে গণ্য করুন। তাঁরা আপনার খেলার পুতুল নন—এটা মেনে নিন।

নাদিন শান্তা মুরশিদ: সহকারী অধ্যাপক, ইউনিভার্সিটি অ্যাট বাফালো, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্ক