কমনওয়েলথে গণতন্ত্রায়ণ

কমনওয়েলথের কথা উঠলেই বাংলাদেশে অনেকের মনে পড়ে স্যার স্টিফেন নিনিয়ানের কথা। আওয়ামী লীগ আর বিএনপি-এ দুই দলের জেদাজেদির রাজনীতিতে মধ্যস্থতার চেষ্টায় কমনওয়েলথের মহাসচিব এমেকা আনইয়াকুর প্রতিনিধি হিসেবে ১৯৯৪ সালে তিনি ঢাকায় এসেছিলেন। নির্বাচনের একটা গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি হিসেবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার দাবিতে অনড় আওয়ামী লীগের (জামায়াতে ইসলামীর সমর্থনে) দেশ অচল করা আন্দোলনের মুখে অচলাবস্থা নিরসনে সে সময় এগিয়ে এসেছিল কমনওয়েলথ। আমাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বিদেশিদের নাক গলানোয় তখন অবশ্য আমাদের জাত যায়নি।

১৯৯১ সালে কমনওয়েলথ হারারে ঘোষণা গ্রহণ করে, যাতে প্রথমবারের মতো গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের প্রতি অঙ্গীকার করা হয়। বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখার স্বার্থে ১৯৯৪ সালে তাদের মধ্যস্থতার উদ্যোগটি ছিল একটি সাহসী প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা থেকে বিচ্যুতির কারণে এই হারারে ঘোষণার আলোকেই ২০০২ সালে কমনওয়েলথ জিম্বাবুয়ের সদস্যপদ স্থগিত করে এবং পরের বছর দেশটি নিজেই জোট থেকে বেরিয়ে যায়। সংস্থাটি নিয়মিতভাবে সদস্যদেশগুলোর নির্বাচনও পর্যবেক্ষণ করে থাকে। বাংলাদেশেও সামরিক শাসন-পরবর্তী নির্বাচনগুলোতে তারা পর্যবেক্ষক পাঠিয়েছে। ব্যতিক্রম শুধু’ ৯৬-এর ফেব্রুয়ারি এবং ২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচন।

২০১৪ সালে অবশ্য গণতন্ত্রের পক্ষে সুদৃঢ় অবস্থান গ্রহণে ব্যর্থতার জন্য কমনওয়েলথ নানাভাবে সমালোচিত হয়েছে। কমনওয়েলথে তখন মহাসচিব ছিলেন ভারতীয় কূটনীতিক কমলেশ শর্মা। ওই বছর মালদ্বীপে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট নাশিদ ক্ষমতাচ্যুত হলেও সংস্থাটি বিস্ময়কর নির্লিপ্ত ভূমিকা নেয়। আবার যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ সত্ত্বেও শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট রাজাপক্ষের হাতে সংস্থার নেতৃত্ব তুলে দেওয়ার বিষয়ে তিনি কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার মতো গণতান্ত্রিক দেশগুলোর আপত্তি কানে তোলেননি। কমনওয়েলথ জোটে প্রয়োজনমতো বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা যে ছোট কার্যনির্বাহী গ্রুপের ওপর ন্যস্ত আছে, সেই কমনওয়েলথ মিনিস্ট্রিয়াল অ্যাকশন গ্রুপে (সিম্যাগ) তখন ভারত ছিল বেশ প্রভাবশালী সদস্য। সিম্যাগে নতুন যেসব দেশ এখন নির্বাচিত হয়েছে, তাতে অবশ্য দক্ষিণ এশিয়ার কেউ নেই।

লন্ডনে সদ্য শেষ হওয়া ৫৩ জাতি জোটের শীর্ষ সম্মেলনে এসব দেশের রাষ্ট্রনেতারা আমাদের অভিন্ন সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ গড়ার লক্ষ্যে কমনওয়েলথে নতুন প্রাণসঞ্চারের ঘোষণা দিয়েছেন। তাঁদের ঘোষিত ৫৪ দফার ইশতেহারে গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও মানবাধিকারের সুরক্ষা, অবাধ বাণিজ্যের প্রসার, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা, সাগর দূষণমুক্ত করা, সবার জন্য অন্তত বারো বছরের মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করা, ম্যালেরিয়া এবং অসংক্রামক রোগের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের মতো অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বেশ উচ্চাকাঙ্ক্ষী অঙ্গীকার রয়েছে। এসব সিদ্ধান্ত আমাদের জীবনে কতটা প্রভাব ফেলবে তা নিয়ে আলোচনা আমার উদ্দেশ্য নয়। কেননা, এসব বিষয়ে জাতিসংঘসহ অন্য আরও অনেক ফোরামেই আলোচনা এবং নানা ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু কমনওয়েলথই হচ্ছে ছয় উপমহাদেশে বিস্তৃত একমাত্র বহুজাতিক ফোরাম, যারা গণতন্ত্র এবং আইনের শাসনের প্রশ্নে বিচ্যুতি ঘটলে সদস্যরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে সক্ষম। ইতিহাস এখানে স্মরণ করার উদ্দেশ্য সেটাই। গণতন্ত্র এবং আইনের শাসন-সম্পর্কিত অঙ্গীকারগুলোর মধ্যেই আমার আলোচনা সীমিত রাখব।

সম্মেলন শেষে স্বাগতিক প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে বলেন, কমনওয়েলথ দেশগুলোতে সবার রাজনৈতিক ও সামাজিক অংশগ্রহণের মাধ্যমে সমৃদ্ধ ও গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ গড়ে তোলায় কমনওয়েলথের নেতারা অঙ্গীকার করেছেন। এবারের ইশতেহারে সবচেয়ে লক্ষণীয় হচ্ছে সদস্যদেশগুলোতে শান্তি ও নিরাপত্তার প্রয়োজনে জাতীয় সংলাপে সহযোগিতার অনুরোধে গঠনমূলক ভূমিকা রাখার জন্য কমনওয়েলথ মহাসচিবের দপ্তরের সামর্থ্য বাড়ানোর বিষয়ে সরকারপ্রধানদের সম্মতি। এই সিদ্ধান্তে ধারণা করা অমূলক হবে না যে’ ৯৪ সালে বাংলাদেশের অভিজ্ঞতার আলোকে ভবিষ্যতেও একই উদ্যোগ কমনওয়েলথভুক্ত কোনো কোনো দেশে দেখা যেতে পারে। বৈঠকে সদস্যদেশগুলোতে নির্বাচন পর্যবেক্ষণে হালনাগাদ নীতিমালা অনুমোদিত হয়েছে। নির্বাচন পরিচালনায় সুচর্চার বিষয়ে প্রকাশিত নীতিমালার অতিরিক্ত এই প্রকাশনা। এতে নির্বাচন পর্যবেক্ষণের ক্ষেত্রে যেসব বিষয় বিবেচনায় নেওয়ার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে, সেগুলো হচ্ছে অন্তর্ভুক্তিমূলক ভোটার নিবন্ধন, প্রার্থী মনোনয়নে স্বাধীনতা, স্বাধীনভাবে নির্বাচনী প্রচার চালানো, গণমাধ্যমে প্রচারিত সংবাদে ভারসাম্য রক্ষা, নারী, তরুণ, সংখ্যালঘু ও প্রতিবন্ধীদের অংশগ্রহণ, সরকারি কর্মকর্তাদের নিরপেক্ষতা, নির্বাচনী প্রক্রিয়ার সততা, গোপনে ভোট প্রদানের ব্যবস্থা এবং ভোট গণনার সততা। তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে যেসব পরিবর্তন এসেছে, সেগুলো বিবেচনায় নিয়ে এই নতুন নির্দেশনা তৈরি করা হয়েছে।

ইশতেহারে নেতারা কমনওয়েলথ সনদের আলোকে সুশাসন, গণতান্ত্রিক নীতিমালা এবং মানবাধিকার ও আইনের শাসনের সুরক্ষা এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছেন। জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ার ক্ষেত্রে সেগুলোকে অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং জবাবদিহিসম্পন্ন করার অপরিহার্যতার কথাও রয়েছে এতে। রাষ্ট্রের তিনটি বিভাগ আইনসভা, নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগের মধ্যে ক্ষমতার পৃথক্করণ নিশ্চিত করার (লাটিমার হাউস) নীতিমালা অনুসরণের বিষয়েও তাঁরা অঙ্গীকার করেছেন। নেতাদের এসব অঙ্গীকার উৎসাহজনক সন্দেহ
নেই। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এর বাস্তবায়ন আদৌ হবে কি না এবং হলেও তা কতটা সম্ভব হবে।

২.
অতীতে রাজদরবারে রাজন্যবর্গকে আমন্ত্রণ করে এনে সিংহাসনের উত্তরাধিকারীকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে আনুগত্য আদায়ের অনেক নজির আছে। সমসাময়িক বিশ্বে এ ধরনের চল আর দেখা যায় না। বিশেষত পশ্চিমা গণতন্ত্রে রাজতন্ত্র অনেকটাই আলংকারিক বিষয়। গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থায় রাজপরিবারের সুযোগ-সুবিধা, বেতন-ভাতাও রাজনীতিকেরা ঠিক করেন। কয়েক বছর আগেও ব্রিটেনে যুবরাজ চার্লসকে নিয়েও জল্পনার শেষ ছিল না। কথা উঠেছিল রানি সিংহাসন ত্যাগ করলে চার্লসের বড় ছেলে উইলিয়ামকেই রাজদণ্ড দেওয়া উচিত। আসলে চার্লসের যে বয়স, সেই ৭৩ বছর তো অবসরেরই সময়।

রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ তাঁর হারানো সাম্রাজ্যের সাবেক উপনিবেশগুলোর (মোজাম্বিক ও রুয়ান্ডা বাদে) নেতাদের তাঁর প্রাসাদে আতিথ্য দিয়ে কমনওয়েলথের আলংকারিক প্রধান হিসেবে তাঁর ছেলেকে সমর্থন দেওয়ার অনুরোধ জানানোয় ৫৩টি দেশের নেতারা তাঁকে বিমুখ করেননি। শনিবার ২১ এপ্রিল ছিল রানির ৯২ তম জন্মদিন। শুক্রবার তাঁর অনুরোধটি রক্ষার সিদ্ধান্ত নিয়ে তাঁরা যেন রানিকে জন্মদিনের উপহার দিলেন। কমনওয়েলথের ২৪০ কোটি লোকের কাছে এই সিদ্ধান্তের কোনো প্রত্যক্ষ প্রভাব নেই বলে বিষয়টি অনেকের কাছেই উপেক্ষণীয় মনে হতে পারে। কিন্তু ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমেই এই প্রক্রিয়ার যথার্থতা নিয়ে খুবই যৌক্তিক একটি প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে। ব্রিটেনের রাষ্ট্রপ্রধান যেভাবে কমনওয়েলথের সরকারপ্রধানদের আমন্ত্রণ জানিয়ে রাজপ্রাসাদে নিয়ে এসে তাঁর পুত্রকে এই প্রতিষ্ঠানের প্রধান পদে বসানোর জন্য সমর্থন চেয়েছেন, তাতে কীভাবে গণতন্ত্রের প্রতিফলন ঘটল? প্রশ্নটি ছিল ঘানার প্রেসিডেন্টের কাছে। প্রেসিডেন্ট নানা আকুফু আদো বললেন, যেহেতু অন্য কোনো প্রস্তাব ছিল না, সেহেতু ধরে নেওয়া যায় যে এটি একটি সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত। সানডে টাইমস-এর সাংবাদিক প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মের কাছে আবারও জানতে চান, কেউ অন্য কোনো প্রস্তাব করেছিল কি না। থেরেসা মে জানান, অন্য কোনো প্রস্তাব ছিল না।

সরকারপ্রধানদের রুদ্ধদ্বার আলোচনার বিবরণ হয়তো নিকট ভবিষ্যতে জানা যাবে না। তবে প্রধানমন্ত্রী মে ও প্রেসিডেন্ট নানার বক্তব্য বিবেচনায় নিলে ধারণা জন্মায় যে আমাদের ৫২টি দেশের নেতারা গণতান্ত্রিক আচার-রীতির চেয়ে রাজকীয় ঐতিহ্যকেই শ্রেয় গণ্য করেছেন। শীর্ষ সম্মেলনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনে বাকিংহাম প্যালেসের জমকালো আয়োজন, সুসজ্জিত সান্ত্রিদের কুচকাওয়াজ, গোলা ছুড়ে স্বাগত জানানো, উইন্ডসর ক্যাসেলের রিট্রিটের (আয়েশ করার ব্যবস্থা) মতো রাষ্ট্রাচারে রাজকীয় ঐতিহ্যের যে প্রদর্শনী হয়েছে, স্পষ্টতই সেখানে ঔপনিবেশিক আমলের ছায়া আসর করেছিল। কমনওয়েলথের ঘোষিত রাজনৈতিক মূল্যবোধ গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করার অঙ্গীকারের প্রতি নেতাদের আন্তরিকতা নিয়ে সংশয় তাই মোটেও অস্বাভাবিক নয়।

কামাল আহমেদ: সাংবাদিক