রাজনীতিতে কি নতুন শক্তি আসছে?

অং সান সু চি
অং সান সু চি

গত মাসের শেষ সপ্তাহে অং সান সু চি তাঁর দেশের প্রেসিডেন্ট বদলে নিয়েছেন। প্রেসিডেন্ট পদ্ধতিশাসিত একটি দেশে ভিন্ন এক ব্যক্তির ইচ্ছায় এভাবে রাষ্ট্রপ্রধান পাল্টানো বিশ্বের সেই সব দেশেই সম্ভব, যেখানে এখনো গণতন্ত্রের চর্চা অবিকশিত। তবে মিয়ানমারে এ নিয়ে বিশেষ প্রশ্ন ওঠেনি, যেমনটি ওঠে না দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশেই। তবে অং সান সু চির এই পদক্ষেপকে তাঁর একদফা পিছু হটা হিসেবেও চিহ্নিত করা যায়। এক পা পিছিয়ে দুই পা এগোতে চাইছেন তিনি। নির্বাচনে জয়ী হয়ে এনএলডির সরকার গঠনের দুই বছর পেরিয়ে গেছে মিয়ানমারে। তৃতীয় বছর শুরু হওয়ামাত্রই দেশে-বিদেশে সু চি ও তাঁর দলের পারফরম্যান্স নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ শুরু হয়েছে।

প্রায় ৫০ বছর সামরিক শাসন শেষে যে দেশে জনগণের ভোটে একটি সরকার গঠিত হয়, সেখানে স্বাভাবিকভাবেই বিপুল আশাবাদ থাকে। এ রকম নির্বাচিত সরকারের কার্যক্রম মূল্যায়নের জন্য মাত্র দু-তিন বছর যথেষ্ট সময় কি না, তা নিয়ে বিতর্ক তোলা যায়। তারপরও মিয়ানমারে রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে সু চি ও তাঁর সরকার নিয়ে হতাশা তৈরি হয়েছে। বলা বাহুল্য, কয়েকটি বন্ধুরাষ্ট্রের সহায়তায় রোহিঙ্গা নিপীড়নের কারণে বহির্বিশ্বে সৃষ্ট হতাশাকে যতটা সহজে অবজ্ঞা করা গিয়েছে, অভ্যন্তরীণ জনমতকে ততটাই গুরুত্ব না দিয়ে উপায় নেই সু চির। এমন বাস্তবতা সামাল দিতেই ৭৩ বছর বয়সী এই এনএলডি নেত্রী অপেক্ষাকৃত ‘তরুণ’ এক সহকর্মীকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে বাছাই করে সরকারে গতি আনতে চাইছেন।

কিন্তু মিয়ানমারের ভাষ্যকারেরা মনে করেন, সু চির এই পদক্ষেপ কার্যত দেশটিতে ক্রমবর্ধমান এক রাজনৈতিক শূন্যতার স্মারক। এনএলডি যে ধরনের আদর্শিক ও সাংগঠনিক অবস্থায় রয়েছে, তার তরফ থেকে মিয়ানমারকে এর চেয়ে বেশি কিছু আর দেওয়ার নেই। বিশেষত দলটি পুরোদস্তুর এক ব্যক্তিনির্ভর হয়ে পড়েছে। এরূপ ব্যক্তিনির্ভরতার ছাপ পড়েছে প্রশাসনেও। বেসামরিক পরিসরে গুরুত্বপূর্ণ যেকোনো সিদ্ধান্তের জন্য সু চির ওপরই যেমন নির্ভর করতে হচ্ছে, তেমনি জরুরি নীতিনির্ধারণী অনেক বিষয়ে সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করে চলার যে নীতি সু চি নিয়েছেন, তাতে দেশটিতে কার্যত সংস্কার কার্যক্রম প্রত্যাশিত গতি পায়নি। এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে সু চির স্বাস্থ্য-সম্পর্কিত নানা বাজে গুজব।

দেশের প্রধান বিরোধী দল ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (ইউএসডিপি) এই পরিস্থিতিতে কোনো আশার আলো হতে পারবে, এটা কেউ মনে করে না। ইউএসডিপি হলো দেশটির সশস্ত্র বাহিনীর গড়া রাজনৈতিক দল। অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তারাই এর শক্তির ভিত। সাবেক সেনাশাসক জেনারেল থেন সেইন দলটির প্রধান ছিলেন ২০১৩ সাল পর্যন্ত। এখনো এর সভাপতি থান হাতে নামে একজন সাবেক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল। সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনে সু চির দল যেখানে পার্লামেন্টের দুই কক্ষে গড়ে নির্বাচনযোগ্য আসনের ৫৯ শতাংশ পেয়েছে, সেখানে ইউএসডিপি পেয়েছে মাত্র ৬ শতাংশ। এই ব্যবধান অতিক্রম করা অসম্ভব বলা যায়; কারণ মিয়ানমারে যদিও এখনো সশস্ত্র বাহিনীই পর্দার আড়ালে নিয়ন্ত্রকের আসনে রয়েছে, তবু জনগণ সশস্ত্র বাহিনীর পছন্দের দলকে ক্ষমতায় দেখতে চাইবে না। ইউএসডিপির প্রতি জনগণের সেরূপ আগ্রহ নেই, কারণ তারা অতীতের দুঃস্বপ্ন পেরিয়ে সামনে এগোতে চায়। কিন্তু সু চিকে নিয়ে আশাহত পরিস্থিতিতে নতুন উপাদান যুক্ত হয়েছে অর্থনৈতিক সংকট। দেশটিতে বিপুলভাবে বৈদেশিক বিনিয়োগ আসছে এবং অবকাঠামো গড়ার জোয়ার বইছে, কিন্তু অর্থনীতিতে কার্যত গতিশীলতা আনতে পারেনি এনএলডি। উপরন্তু অতীতে যেভাবে গুটিকয়েকের হাতে সম্পদের পুঞ্জীভবন ঘটছিল, সু চির আমলেও নিরবচ্ছিন্নভাবে তাদেরই ফুলে-ফেঁপে ওঠা দেখে তরুণেরা হতাশ।

এ রকম দৃশ্যপটেই স্থানীয় প্রচারমাধ্যমে ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নতুন রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মের প্রয়োজনীয়তার কথা উঠছে ক্রমাগত। সেই সূত্রেই মিয়ানমারের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে আবারও কো কো জি, হিতা চিয়েউই, মায়া আয়ে প্রমুখের আগমন। কো কো জি, হিতা চিয়েউই—এঁরা হলেন মিয়ানমারের ১৯৮৮ সালের সাড়া জাগানো ছাত্র গণ-অভ্যুত্থানের প্রধান সংগঠক। মিয়ানমারে তাঁদের বলা হয় ‘৮৮৮৮ প্রজন্ম’। ১৯৮৮ সালের ৮ আগস্ট (৮৮-৮-৮) এই গণ-অভ্যুত্থান শুরু হয়েছিল বলেই আন্দোলনের সংগঠকদের এভাবে সম্বোধন করা হয়।

বাংলাদেশেও অনেকেই জানেন, মিয়ানমারে সমাজজীবনে সংখ্যাতত্ত্বের ব্যাপক প্রভাব। সেই সূত্রেও ‘৮৮৮৮’ সেখানে রাজনীতির পরিমণ্ডলে সর্বজন শ্রদ্ধেয় এক সংখ্যা। দেশটিজুড়ে রাজনীতি-সচেতনদের কাছে ‘৮৮৮৮ প্রজন্ম’ এখনো তারুণ্যের প্রতীক, যদিও সেই সংগঠকদের অনেকেরই বয়স এখন ষাটের কাছাকাছি। উপরন্তু দীর্ঘ কারাজীবন ও ব্যক্তিজীবন গণতান্ত্রিক সংগ্রামের সেই সব নায়ককে ছিটকে ফেলেছে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রান্তে। প্রধান নেতাদের মধ্যে কো কো জি ১৭ বছর কারাগারে ছিলেন। হিতা চিয়েউই ১৯৮৮ থেকে চারবার গ্রেপ্তার হন। অন্যদের ক্ষেত্রেও একই চিত্র। ২০১২ সালে এসে এসব ছাত্রনেতাকে কারামুক্তি দিতে শুরু করে সামরিক বাহিনী প্রভাবিত সরকার।

এনএলডির রাজনৈতিক উত্থান ঘটেছিল এই ‘৮৮৮৮ জেনারেশন’-এর জমিনে দাঁড়িয়ে। কিন্তু ২০১৫ সালের নির্বাচনে এ রকমের ছাত্রনেতাদের খুব কমজনকেই মনোনয়ন দিয়েছিল সু চির দল। এনএলডির পুরোনো নেতৃত্ব সমাজের তরুণ তুর্কিদের জাতীয় পরিসরে জায়গা দিতে এখনো প্রস্তুত নয়। ফলে দেশটিতে গণতন্ত্রের সংগ্রামকে নবপর্যায়ে টেনে নিতে রাজনৈতিক মানবসম্পদের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। যদিও দেশটিতে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সংখ্যা প্রায় ৯০, কিন্তু তার মধ্যেই দেশে-বিদেশে অনেকেই চাইছেন ২০২০ সালের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কো কো জি এবং তাঁর ‘৮৮৮৮ প্রজন্ম’-এর পুরোনো সহযোদ্ধারা আরেকবার দেশের জন্য এগিয়ে আসুক। এরূপ আকাঙ্ক্ষা ২০১৫ সালের নির্বাচনের আগেও এক দফা প্রকাশ পেয়েছিল, তবে পরিণতি পায়নি। বর্তমানে উদ্যোগটি আবার সক্রিয় হয়েছে। অনেকেই মনে করছেন, ১৯৮৮ সালে গণতন্ত্রের জন্য তরুণেরা যে আত্মত্যাগ করেছিলেন, সেটাকে এখন তাঁরাই পূর্ণতা দিতে পারেন রাজনৈতিক পরিসরে পুনরায় দায়িত্ব নিয়ে। বস্তুত, এরূপ ভাবনারই ফসল হতে চলেছে মিয়ানমারের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে একটি নতুন দলের আগমনধ্বনি।

বলা বাহুল্য, গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন এবং গণতন্ত্র নির্মাণের সংগ্রামে ফারাক আছে। কো কো জি প্রমুখ ‘৮৮৮৮ প্রজন্ম’-এর নেতারা ইউনিয়ন নির্বাচন কমিশনে গত ডিসেম্বরে ‘ফোর এইটস্ পার্টি’ নামে আলোচ্য নতুন দল গঠনের আবেদন করামাত্র তাঁদেরই সাবেক অনেক সহযোদ্ধা এর বিরোধিতা করছেন। আপত্তি তুলেছেন অতীতে গণতন্ত্রের সংগ্রামে যুক্ত ছিলেন এমন প্রভাবশালী ভিক্ষুদের কয়েকজনও। বিরোধিতাকারীদের বক্তব্য, ফোর এইটস্ বা ‘৮৮৮৮’ মিয়ানমারবাসীর একটা ঐতিহাসিক রাজনৈতিক সম্পদ। কারও উচিত নয় ইতিহাসের ওই স্মারককে ব্যবহার করে রাজনৈতিক দল গঠন করা।

আন্দাজ করা কঠিন নয়, বিরোধিতাকারীরা অনেকে সু চির দলকে আরও সময় দেওয়ার পক্ষপাতী। এনএলডি নেতৃত্ব মনে করেন, যেহেতু ১৯৮৮ সালের ছাত্র গণ-অভ্যুত্থানেরই ফসল আজকের রাজনৈতিক পরিবর্তন, সে কারণে ‘৮৮৮৮ প্রজন্ম’-এর পৃথক রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম গঠনে তাৎক্ষণিকভাবে তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আর ইউএসডিপি মনে করছে, এরূপ নতুন দলমাত্রই তারা দ্বিতীয় অবস্থান থেকে তৃতীয় অবস্থানে চলে যাবে। এরূপ দ্বিবিধ বিরোধিতার কারণেই মনে করা হচ্ছে ‘৮৮৮৮ প্রজন্ম’-এর প্রতিনিধিরা ‘ফোর এইটস পার্টি’ নামে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত হতে পারবেন না। সে ক্ষেত্রে তাঁদের নতুন নাম নিতে হবে।

এদিকে ইউএসডিপির একাংশ মনে করছে, যদি সু চিকে রাজনৈতিক পরিসর থেকে সরাতে সশস্ত্র বাহিনী দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে ওঠে, তাহলে নিজেদের গড়া পুরোনো দল ছেড়ে ভবিষ্যতে ‘৮৮৮৮ প্রজন্ম’কেও মদদ দিয়ে ফেলতে পারে তারা। তবে নতুন দলের উদ্যোক্তারা বলছেন, তাঁদের প্রধান দাবিই হবে সেনাবাহিনীর তৈরি ২০০৮-এর সংবিধানের সংশোধন। এরূপ সব বিবেচনাতেই মিয়ানমারে আসন্ন নতুন দলটিকে ঘিরে ব্যাপক রাজনৈতিক আগ্রহ তৈরি হয়েছে। মিয়ানমারের নবীন প্রচারমাধ্যম জগতেও সম্ভাব্য দলটির প্রতি বিশেষ সহানুভূতি রয়েছে। কারণ, দেশটিতে গণমাধ্যমের পুনর্জন্ম ঘটেছে ‘৮৮৮৮ প্রজন্ম’-এর অবদান হিসেবেই।

এখনো নির্বাচন কমিশনের অনুমোদন না পেলেও ইতিমধ্যে দলের উদ্যোক্তারা ঘোষণাপত্র প্রস্তুত করেছেন। অনুমোদন পেলে নিয়ম অনুযায়ী চার মাসের মধ্যে দলটিকে গঠনতন্ত্র ও ঘোষণাপত্র প্রকাশ করতে হবে। এ ছাড়া এ বছরই প্রথম মিয়ানমারজুড়ে ১৯৮৮-এর ছাত্র অভ্যুত্থানের ৩০তম বার্ষিকী স্মরণ করে ‘৮ আগস্ট’কে গণতন্ত্র দিবস হিসেবে পালনের তোড়জোড় চলছে। হয়তো এসবই মিয়ানমারে দূরবর্তী এক পালাবদলের আপাত এক মৃদু লক্ষণ। তবে মিয়ানমারের ‘৮৮৮৮ জেনারেশন’-এর এই রাজনৈতিক প্রত্যাবর্তন বাংলাদেশসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশের জন্যই তাৎপর্যবহ ঘটনা হয়ে উঠতে পারে, যদি ওই সব দেশের বিভিন্ন সময়ের ছাত্র-রাজনৈতিক সংগঠকেরা নিজ নিজ দেশের রাজনীতিতে গণতন্ত্রের শূন্যতা পূরণে অবদান রাখতে এগিয়ে আসেন।

আলতাফ পারভেজ দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ে গবেষক