পাকিস্তানের সেনাশাসকদের কথার প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছে সেনাপ্রধান বাজওয়ার কণ্ঠেও

সেনাপ্রধান কামার জাবেদ বাজওয়া। নওয়াজ শরিফকে সরিয়ে দেওয়ায় তাঁরই ভূমিকা বলে মনে করা হয়। এএফপির ফাইল ছবি
সেনাপ্রধান কামার জাবেদ বাজওয়া। নওয়াজ শরিফকে সরিয়ে দেওয়ায় তাঁরই ভূমিকা বলে মনে করা হয়। এএফপির ফাইল ছবি

পাকিস্তানের তিনবারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ। প্রতিবারই মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে পদ ছাড়তে হয়েছে পাকিস্তান মুসলিম লিগের (এন) এই নেতাকে। তিন মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় মোট ছয়জন সেনাপ্রধানকে পেয়েছিলেন তিনি। বলা হয়ে থাকে, এর মধ্যে অন্তত চারজনকে নওয়াজ নিজের পছন্দে সেনাপ্রধান করেছিলেন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের ডিঙিয়ে। পরে এই সেনাপ্রধানেরাই প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে তাঁকে সরিয়ে দিতে ভূমিকা রেখেছেন।

এবার তো শুধু প্রধানমন্ত্রিত্ব নয়, আদালতের নির্দেশে রাজনীতি থেকেই নির্বাসিত হয়েছেন নওয়াজ। দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত নওয়াজকে আজীবন রাষ্ট্রীয় কোনো পদে নিষিদ্ধ করেছেন সুপ্রিম কোর্ট। নিজের দলের প্রধানের পদেও নিষিদ্ধ করা হয়েছে তাঁকে। আর এতে বর্তমান সেনাপ্রধান ‘কামার জাবেদ বাজওয়ার হাত রয়েছে’ বলে মনে করেন অনেকে। গত কয়েক মাসে কামার জাবেদের কিছু কথাবার্তা-কর্মকাণ্ডে এই হিসাব মিলিয়েছেন তাঁরা। পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর ইতিহাসও এই হিসাবের পক্ষে কথা বলে।

পাকিস্তানের প্রথম সামরিক শাসক আইয়ুব খান। ১৯৫৮ সালে ক্ষমতা দখল করেন তিনি। ক্ষমতা দখলের আগে তাঁর বিভিন্ন বক্তব্যে দেশের অর্থনীতি, রাজনীতিসহ নানা বিষয়ে নেতিবাচক বিষয় উঠে আসে। যেটা আসলে ছিল তাঁরা ক্ষমতা দখল করার ‘গ্রাউন্ড’ তৈরির অংশ। আইয়ুব খান বলেছিলেন, ‘আমি দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে হতাশাজনক প্রতিবেদন পাচ্ছি। আসলে রাজনৈতিক শাসনের দোহাই দিয়ে দেশে অপশাসন চলছে। এ কারণে রাজনৈতিক নেতাদের প্রতি জনগণের আস্থার অভাব প্রকট হয়ে উঠেছে...সাধারণ মানুষ মনে করে, দেশ থেকে অপশাসনের মূলোৎপাটন করার মতো সততা, সাহস ও দৃঢ়তা এই নেতাদের নেই।’

নওয়াজ শরিফ। তিন মেয়াদে দায়িত্ব পালনের সময় নিজের পছন্দে অন্তত চারজনকে সেনাপ্রধান বানিয়েছিলেন। তাঁরাই প্রতিবার নওয়াজকে সরিয়ে দেওয়ার কলকাঠি নাড়েন। রয়টার্সের ফাইল ছবি
নওয়াজ শরিফ। তিন মেয়াদে দায়িত্ব পালনের সময় নিজের পছন্দে অন্তত চারজনকে সেনাপ্রধান বানিয়েছিলেন। তাঁরাই প্রতিবার নওয়াজকে সরিয়ে দেওয়ার কলকাঠি নাড়েন। রয়টার্সের ফাইল ছবি

আইয়ুবের পর আরও যাঁরা ক্ষমতা দখল করেছিলেন, তাঁদের কণ্ঠেও আইয়ুবের বার্তার প্রতিধ্বনি শোনা গেছে। সর্বশেষ ১৯৯৯ সালে রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানে দেশটির ক্ষমতা দখল করেছিলেন পারভেজ মোশাররফ। তিনি ক্ষমতা দখলের আগে বলেছিলেন, ‘আমাদের চারপাশে হতাশা ঘিরে ধরেছে, কোথাও কোনো আশার আলো নেই...আমরা এমন একপর্যায়ে পৌঁছেছি, যেখানে আমাদের অর্থনীতি ভঙ্গুর হয়েছে, আমরা বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছি; আমাদের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোও ধ্বংস হয়ে গেছে।’ এটাও ছিল মোশাররফের ক্ষমতা দখলের আভাস। পূর্বসূরি আইয়ুব ও মোশাররফের কণ্ঠের প্রতিধ্বনি পাওয়া যাচ্ছে বর্তমান সেনাপ্রধান কামার জাবেদ বাজওয়ার কণ্ঠেও।

২০১৬ সালের ২৯ নভেম্বর পাকিস্তানের সেনাপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেন কামার জাবেদ বাজওয়া। গণতন্ত্রের সমর্থক বলে সুনাম থাকায় পাকিস্তানের শক্তিশালী পদটি পেতে অন্যদের চেয়ে এগিয়ে রেখেছিল তাঁকে। কিন্তু এখন বলা হচ্ছে, বালুচ রেজিমেন্ট থেকে আসা ৫৭ বছর বয়সী কামার জাবেদ বাজওয়া আসলে আদালতকে সামনে রেখে নওয়াজকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে দিতে মূল ভূমিকা পালন করেন। গত মাসে বাজওয়া অবশ্য সরাসরিই বলেন, পার্লামেন্টের সঙ্গে বিচার বিভাগের বিরোধ হলে সেনাবাহিনী বিচার বিভাগের পক্ষে থাকবে।

পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট ভবন। দেশটির সর্বোচ্চে আদালতের রায়ে রাষ্ট্রীয় যেকোনো পদে আজীবন নিষিদ্ধ হয়েছেন নওয়াজ শরিফ। রয়টার্সের ফাইল ছবি
পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট ভবন। দেশটির সর্বোচ্চে আদালতের রায়ে রাষ্ট্রীয় যেকোনো পদে আজীবন নিষিদ্ধ হয়েছেন নওয়াজ শরিফ। রয়টার্সের ফাইল ছবি

এর আগে বাজওয়া দেশটির সাবেক অর্থমন্ত্রী ও ক্ষমতাসীন দলের নেতা ইসহাক দারকে নিয়ে নজিরবিহীন মন্তব্য করেন। বলেন, ইসহাক দার দেশের জন্য পুরোপুরি ধ্বংসাত্মক একজন মানুষ। প্রায় ২১ কোটি মানুষের দেশে মাত্র ১ কোটি ২০ লাখ মানুষ কর দেয়—এটা লজ্জাজনক।

বাজওয়া গত মাসেই দেশটির জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনায় বসেছিলেন। বলা হয়েছিল, এই আলোচনার কোনো কিছু প্রকাশ করা যাবে না। তবে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিভিন্ন কলামে সাংবাদিকেরা তা তুলে ধরতে শুরু করছেন। সেনাপ্রধানের সঙ্গে আলোচনায় অংশ নেওয়া একজন সাংবাদিক বলেন, সেই অনুষ্ঠানে সেনাপ্রধানের শারীরিক ভাষা ছিল একেবারেই অন্য রকম। আত্মবিশ্বাসী বাজওয়াকে মনে হচ্ছিল, তিনি নতুন রাজা। তাঁর সঙ্গে আলোচনায় মনে হলো, দেশের বিভিন্ন বিষয়ে সংস্কার আনতে তিনি বেশ উৎসাহী। তাঁর কথাবার্তায় মনে হয়েছে, তিনি সেনাপ্রধানের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও ক্ষমতায় থাকবেন।

সম্প্রতি দেশটির বেসরকারি জিও টেলিভিশনের সম্প্রচার বন্ধ করে দিয়ে সেনাবাহিনী তাঁর অভিপ্রায়ের জানানও দিয়েছে। সেনাবাহিনীর দুর্নীতিসংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করায় এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। যদিও সেনাবাহিনী এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি। তবে এর মাধ্যমে সবাইকে যে বার্তা দেওয়ার দরকার ছিল, সেই বার্তা ঠিকই দিতে পেরেছেন বাজওয়া।

বাজওয়ার সামরিক বাহিনী অবশ্য বিভিন্ন সময়ে বলছে, বর্তমান সরকারের মেয়াদ শেষে নির্দিষ্ট সময়েই নির্বাচন হবে। আগামী জুলাইয়ে সেই নির্বাচন হতে পারে। কিন্তু সার্বিক পরিস্থিতিতে তাদের এই বক্তব্যে আস্থা রাখার মানুষ বোধ হয় খুব বেশি পাওয়া যাবে না। যদিও ২০১৪ সালে বাজওয়া তাঁর পূর্বসূরিকে ক্ষমতা দখল করার অভিপ্রায় থেকে সরে আসার পরামর্শ দিয়েছিলেন বলে শোনা যায়। শেষ পর্যন্ত ওই সময় আর সামরিক হস্তক্ষেপের ঘটনা ঘটেনি।

৭১ বছর বয়সী পাকিস্তানে বেশির ভাগ সময় ক্ষমতায় ছিল সেনাবাহিনী বা বেসামরিক ছদ্মাবরণে সেনা একনায়কেরা। এ পর্যন্ত কোনো নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীই পাঁচ বছরের মেয়াদ পূরণ করতে পারেননি। এই প্রথম দেশটিতে টানা দুটি নির্বাচিত সরকার ক্ষমতার মেয়াদ শেষ করতে যাচ্ছে। কিন্তু পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর ইতিহাস আর বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে কেউ যদি দেশটিতে আবারও গণতান্ত্রিক যাত্রার ছেদ দেখার আশঙ্কা করেন—তাঁকে তো দোষ দেওয়া যায় না!

মাহফুজার রহমান: সাংবাদিক
[email protected]