আর কবে হুঁশ হবে?

ছবি: হাসান রাজা
ছবি: হাসান রাজা

ঘরে প্লাস্টিকের পণ্য বা পলিথিন নেই, সারা দেশে এমন পরিবার একটাও মিলবে কি না সন্দেহ। কিন্তু এসব জিনিস স্বাস্থ্য বা পরিবেশের জন্য যে কতটা ক্ষতিকর, তা আমরা কজনই-বা খতিয়ে দেখি?

২২ এপ্রিল বিশ্বজুড়ে ঘটা করে উদ্‌যাপিত হলো ৪৮তম ধরিত্রী দিবস। এবার এই দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল প্লাস্টিক দূষণ বন্ধ করা। একই সঙ্গে পুনরায় ব্যবহারযোগ্য জিনিসের বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করাও ছিল এ দিবসের লক্ষ্য।

প্লাস্টিক ও পলিথিন উভয়ই স্বাভাবিকভাবে নষ্ট হয় না বা পচে না। এগুলো মাটিতে গেলে মাটির স্বাভাবিক উর্বরতা নষ্ট হয়। প্লাস্টিক এমন এক পদার্থ, যা মাটির নিচে ৫০০ বছরও অক্ষয় থাকার ক্ষমতা রাখে। আবার প্লাস্টিক পুড়িয়ে ধ্বংস করতে গেলে পরিবেশদূষণ ঘটার মতো উপাদান বায়ুতে মেশে। অথচ এসব ক্ষতিকর জিনিস আমাদের দৈনন্দিন জীবনে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে। দিন দিন এর ব্যবহার বরং বাড়ছে।

প্লাস্টিকের জিনিস অন্যান্য সামগ্রীর চেয়ে তুলনামূলকভাবে সস্তা আর টেকসই বলে ঘরোয়া জীবনে এসবের কদর বেশি। সত্তরের দশকে আমাদের দেশে যেসব পণ্য কাচের বোতলজাত করে বিক্রি করা হতো, এসব পণ্য বেশির ভাগই এখন প্লাস্টিকের বোতলে বিক্রি হচ্ছে। এর মধ্যে কোল্ড ড্রিংকস বা ঠান্ডা পানীয় রয়েছে প্রথম সারিতে। কাচের বোতল ভঙ্গুর এবং তুলনামূলকভাবে প্লাস্টিকের বোতলের চেয়ে দামি। এ জন্য প্লাস্টিকের আধারের কদর বেশি। কিন্তু কাচের বোতল যে প্লাস্টিকের বোতলের তুলনায় স্বাস্থ্য সুরক্ষা দিচ্ছে, তা আমরা মাথায় রাখছি না।

প্লাস্টিকের বোতলজাত এসব পানীয় বাসায় নিয়ে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বোতল কিন্তু ফেলে দেওয়া হয় না। তা হয়ে পানি রাখার বোতল। আর অনেকেরই এটা জানা নেই যে এসব বোতল ব্যবহারে নির্দিষ্ট একটা মেয়াদ থাকে। এই মেয়াদ শেষে প্লাস্টিকের বোতল ব্যবহার করলে তা স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে।

শুধু ঠান্ডা পানীয়র বোতল কেন, নানা ধরনের জুস, তেলজাতীয় পণ্য, লোশন, এমনকি ওষুধের আধার হিসেবেও এখন প্লাস্টিকের শিশি-বোতলের ব্যবহার দেদার। দোকান থেকে পানি কিনতে গেলে সেটাও ওই প্লাস্টিকের বোতলেই পাওয়া যায়।

একটা সময় ছিল, যখন গ্রাম-বাংলার ঘরে ঘরে চীনামাটি বা টিনের থালার বেশ কদর ছিল। ছিল কাঁসা, পিতল, অ্যালুমিনিয়ামের ঘটি, বাটি, গামলা। বালতি, লোটা, মগ, বদনা সবই ছিল ধাতব। গত তিন-চার দশকের মধ্যে এসবের জায়গা দখল করেছে প্লাস্টিকের সামগ্রী। এগুলো সস্তা, সহজে ক্ষতিগ্রস্ত হয় না এবং বহন বা রাখায়ও কোনো ঝামেলা নেই। এ কারণে একচেটিয়াভাবে অন্য সব কাঁচামালকে কুপোকাত করেছে প্লাস্টিক। আজকাল বাথরুম ফিটিংসেও উন্নত মানের টেকসই প্লাস্টিকসামগ্রী ব্যবহৃত হচ্ছে।

এখানে প্লাস্টিক যদি পরিবেশবান্ধব হতো আর মানবস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি না হতো, তাহলে কোনো কথা ছিল না।

প্লাস্টিক যে কেবল ভূভাগেই বিড়ম্বনা বাড়াচ্ছে, তা নয়। সাগর-মহাসাগরের প্রতিনিয়ত জমছে রাজ্যের প্লাস্টিক-বর্জ্য। এই জঞ্জাল সাগরের প্রাণিসম্পদ ও উদ্ভিদ তথা জীববৈচিত্র্যের বারোটা বাজাচ্ছে।

খাদ্য ভেবে ভুল করে সাগরে ভাসা প্লাস্টিকের বিভিন্ন জিনিস খাচ্ছে হাঙর, তিমি, ব্যারাকুডার মতো রাক্ষুসে প্রাণী। সিল, সামুদ্রিক পাখি ইত্যাদির মাইক্রোপ্লাস্টিক বলে পরিচিত প্লাস্টিকের খুদে উপাদান খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ছে।

কিছু প্লাস্টিকপণ্য এমন কিছু উপাদান দিয়ে তৈরি, যার মধ্যে ক্যানসারের ঝুঁকি রয়েছে। এর মধ্যে প্লাস্টিকের খেলনাগুলো বেশি বিপজ্জনক। ছোট শিশুরা নরম ও স্থিতিস্থাপক খেলনা পেলেই মুখে দেয়। এই অভ্যাস সবার অগোচরে শিশুর স্বাস্থ্যের জন্য বিপদ ডেকে আনে। হয়তো তাৎক্ষণিকভাবে শিশুটি অসুস্থ হবে না। কিন্তু বিষাক্ত উপাদানের ক্ষতিকর প্রভাবে কোনো এক সময় ওই শিশুর গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গে ত্রুটি দেখা দিতে পারে। বিশ্বে শিশুদের প্লাস্টিকের খেলনা রপ্তানিতে চীনের বড় বাজার রয়েছে। কিন্তু তাদের এই প্লাস্টিকপণ্যে ক্ষতিকর উপাদান রয়েছে বলেও অভিযোগ কম নয়। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র আর যুক্তরাজ্যের বিশেষজ্ঞরা এ ব্যাপারে অনেক দিন ধরেই সোচ্চার।

প্লাস্টিকের ক্ষতিকর উপাদানের প্রভাবে প্রাণঘাতী নানা রোগই কেবল হয় না, ছেলেমেয়ের বেলায় আগাম তা বয়ঃসন্ধির কারণও ঘটায়।

বিভিন্ন সূত্র বলছে, বিশ্বে এখন প্রতিবছর মাথাপিছু ৬০ কেজি প্লাস্টিক ব্যবহার করা হয়। উত্তর আমেরিকা, পশ্চিম ইউরোপ ও জাপানের মতো শিল্পোন্নত দেশগুলোয় এই পরিমাণ মাথাপিছু ১০০ কেজিরও বেশি। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বর্তমান অবস্থা চলতে থাকলে ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বে প্লাস্টিক-বর্জ্যের পরিমাণ গিয়ে দাঁড়াবে ১২ বিলিয়ন টনে। তা হবে এক মহাবিপর্যয়ের অশনিসংকেত!

তাহলে এই বিপর্যয় থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় কী?

উপায় হচ্ছে সচেতনতা ও পদক্ষেপ। প্লাস্টিকসামগ্রীর ওপর নির্ভরতা কমানোর বিষয়ে সচেতন হতে হবে। প্লাস্টিকের উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। আর প্লাস্টিকপণ্য যেখানে-সেখানে না ফেলার বিষয়েও কঠোর হতে হবে।

মুশকিল হলো যে তোতাপাখির মতো উপায় বাতলানো সোজা, কিন্তু পদক্ষেপ নেওয়াটা কঠিন। কিছু জিনিস এড়ানোও যায় না। যেমন বৃষ্টিবাদলার দিনে অনেক কাজেই প্লাস্টিকের পর্দা লাগে। প্লাস্টিকের জুতো বা চপ্পল লাগে। ঝুম বৃষ্টিতে কাপড়চোপড় বা কাগজপত্র রক্ষায় প্লাস্টিকের ব্যাগ যে কতটা উপকারী, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। শিশু বা রোগীর প্রাকৃতিক উপাদান থেকে বিছানার চাদর-তোশক রক্ষায় এক টুকরো প্লাস্টিক না বিছিয়ে উপায় কী? কাঠের বিকল্প হিসেবে ঘরের চেয়ার, টেবিল, দেরাজে প্লাস্টিক ব্যবহৃত হয়ে রক্ষা করছে অনেক গাছ।

এরপরও কিছু জিনিস ব্যবহারে আমরা সতর্ক হতে পারি। যেমন পলিথিনের ব্যাগ। এটি ওই প্লাস্টিকেরই খালাতো ভাই। পচে যাওয়া বা নষ্ট হওয়ার নাম নেই। এগুলোও পরিবেশের জন্য হুমকিস্বরূপ। অথচ এ জিনিস ছাড়া আমাদের চলেই না।

রোজকার কেনাকাটায় কাঁচাবাজার বা মোড়ের দোকান যেখানেই যান, সওদা বহনে পলিথিন ব্যাগ উত্তম বলেই মনে হয়। দোকানিও ওতে স্বচ্ছন্দে এটা-সেটা ভরে দেয়, আর আমরাও অবলীলায় নিয়ে আসি। ঘরে আসার পর এসব পলিথিন ব্যাগ আবার অন্য কাজেও ব্যবহৃত হচ্ছে। রান্নাঘরের ময়লা ফেলবেন? আঁশটে-কুটো? সে ওই পলিথিন ব্যাগ ছাড়া গতি কী?

অনেকের তো আবার নাগরিক জ্ঞান বেশ সরেস। পলিথিন ব্যাগে ময়লার পোঁটলা একটা করতে পারলে হয়, তারপর—যা রে যা পোঁটলা, এক জায়গায় গিয়ে পড়লেই হলো। এ কারণে আবর্জনার আধার আর রাস্তাঘাটে পলিথিনের ছড়াছড়ি। এসব পলিথিন আবার পয়োনালিতে একবার ঢুকতে পারলেই হলো, একটা সময়ে ঠিকই নর্দমা আটকে ময়লা উপচানোর মতো বিড়ম্বনা সৃষ্টি করবে। ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় এ সমস্যা হরদম নগর জীবনকে মাছের মতো কচলাচ্ছে।

অথচ একটু সচেতন আর কঠোর হলেই কিন্তু পলিথিন ব্যাগের বিকল্প কিছু মেলে।

ক্রেতারা যদি পলিথিন বর্জন করেন বা দোকানিকে এ ব্যাপারে সচেতন করেন, তাহলে আপনা-আপনি এর ব্যবহার কমে যাবে। এ যুগে চাহিদা বুঝে বিকল্প জিনিস বাজারে আসতে সময় লাগে না। প্রযুক্তি এখন রকেটের গতিতে ছুটছে। আজ যা অত্যাবশ্যক, কাল তা পরিত্যাজ্য। প্লাস্টিক আর পলিথিনের বিকল্প হওয়ার মতো উপাদানেরও কমতি নেই। আমাদের সোনালি আঁশকেই তো প্রক্রিয়াজাত করে আমরা পণ্য বহনের মতো কত রূপ দিতে পারি!

এটি পরিবেশবান্ধব এবং পচনশীল। একবার ব্যবহার করা পণ্য থেকে পুনরায় ভালো মানের মোড়ক ও ব্যাগ তৈরি সম্ভব। আর আমাদের দেশেই তা হচ্ছে। প্রয়োজন শুধু এর পরিধি বাড়ানো।

পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য, সর্বোপরি মানবকুল রক্ষায় সাধারণ মানুষ সচেতন না হলে, সবাই এসব বর্জনে এককাট্টা না হলে, কেবল ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান চালিয়ে প্লাস্টিক বা পলিথিনের ব্যবহার রোধ করা যাবে না। আইনগত বা প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার চেয়ে জনসচেতনতা অনেক বেশি শক্তিশালী। কাজেই প্লাস্টিকের ব্যবহারের বিষয়ে সতর্ক হওয়ার এখনই সময়। এখনই যদি হুঁশ না হয়, তবে আর হবে কখন?
শরিফুল ইসলাম ভূঁইয়া: সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
[email protected]