স্বাধীন কমিশনের স্বাধীনতার সীমাবদ্ধতা

নির্বাচনী ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠানের (ইলেকশন ম্যানেজমেন্ট বডি, আমাদের জন্য নির্বাচন কমিশন) তিনটি স্বীকৃত মডেল রয়েছে। এসব মডেল হলো স্বাধীন নির্বাচন কমিশন (ইনডিপেনডেন্ট মডেল), সরকারি বা সরকারনিয়ন্ত্রিত কমিশন বা নির্বাচন ব্যবস্থাপনা সংস্থা (গভর্নমেন্টাল) এবং মিশ্র ব্যবস্থাপনা সংস্থা (মিক্সড মডেল)। নির্বাচনী মডেল নিয়ে কয়েক বছর আগে ইন্টারন্যাশনাল আইডিইএ (ইন্টারন্যাশনাল আইডিইএ) নামক সংস্থা বিশ্বের ১৮৭টি দেশে এক জরিপ চালিয়েছিল। ওই জরিপের ফলাফলে দেখা গেছে, বিশ্বের উঠতি ও উন্নয়নশীল গণতান্ত্রিক দেশে স্বাধীন নির্বাচন কমিশন প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। ১৮৭টি দেশের মধ্যে ১৩১টি দেশে (৭০ শতাংশ) স্বাধীন নির্বাচন কমিশন, ৩৩টি দেশে (১৮ শতাংশ) সরকারনিয়ন্ত্রিত এবং ২৩টি দেশে (১২ শতাংশ) মিশ্র নির্বাচনী সংস্থা রয়েছে। এই জরিপের ফলাফল থেকে ধরে নেওয়া যায় যে স্বাধীন নির্বাচন কমিশন বিশ্বব্যাপী গ্রহণযোগ্য। তবে বহু দেশে নামেমাত্র স্বাধীন কমিশন প্রতিষ্ঠিত রয়েছে, যেখানে সরকারের পরোক্ষ প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে একধরনের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত রয়েছে।

একটি দেশ কী ধরনের নির্বাচনী ব্যবস্থাপনা মডেল গ্রহণ করবে, তা নির্ভর করে সে দেশের মানুষের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা, সামাজিক ব্যবস্থাপনা, শিক্ষার হার এবং রাজনৈতিক সংস্কৃতির ওপর ভিত্তি করে। তবে যেকোনো মডেলের ব্যবস্থাপনা হোক, তা অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য; নির্বাচন শুধু ব্যবস্থাপনা সংস্থার ওপরই নয়, আরও অনেক শরিকের কার্যকর সহযোগিতা এবং নির্বাচন কমিশনের প্রত্যয়ের ওপর নির্ভর করে। নির্বাচন কমিশন বা ব্যবস্থাপনা সংস্থা সমগ্র নির্বাচন প্রক্রিয়ার সবচেয়ে কার্যকর ও প্রধান সংস্থা হলেও যদি আইনের প্রয়োগ সঠিক না হয় এবং প্রধান শরিকদের মধ্যে সরকার ও বিচার বিভাগ সম্পূর্ণভাবে সহযোগিতা না করে, তবে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়।

এই উপমহাদেশের সব কটি দেশেই সাংবিধানিক কাঠামোর আওতায় স্বাধীন নির্বাচন কমিশন প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। সর্বশেষ সংযোজন শ্রীলঙ্কা। শ্রীলঙ্কা ২০১৭ সালে নির্বাচন কমিশনকে সাংবিধানিকভাবে স্বাধীন কমিশন হিসেবে পুনর্গঠন করেছে। উপমহাদেশের অন্যান্য দেশের মতো আমাদের সংবিধান রচয়িতারা ১৯৭২ সালে সংবিধানের আওতায় শুধু স্বাধীন নির্বাচন কমিশনই গঠন করেননি, বরং এর পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য ধারা ১১৮ থেকে ১২৬ পর্যন্ত সবিস্তারে বিন্যস্ত করেছেন। এসব ধারার মাধ্যমে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে। তদুপরি মূল নির্বাচনী আইন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২-এ (আরপিও) সংবিধানের ধারার আওতায় স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতাকে শুধু নিশ্চিতই নয়, কার্যকর করার ধারাগুলো সবিস্তারে বিস্তৃত রয়েছে। প্রথমে ২০০৮ সালে অধ্যাদেশ এবং পরে ২০০৯ সালে আইনের মাধ্যমে কমিশন সচিবালয় নির্বাহী বিভাগের অধীন থেকে নির্বাচন কমিশনের ওপর ন্যস্ত করা হয়েছে। এর মাধ্যমে কাঠামোগত নির্বাচন কমিশন কর্তৃক গৃহীত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নও নির্বাচন কমিশনের আওতায় রয়েছে।

বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন নির্বাচনী আইন, আরপিও-১৯৭২ এবং অন্যান্য আইনকে অধিকতর কার্যকর ও প্রয়োগযোগ্য করতে বিধি তৈরির ক্ষমতাও রাখে। নির্বাচনকালীন আইন ও বিধির বাইরে সংবিধানের ধারা ১১৯-এর আওতায় পরিপত্র দ্বারাও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। নির্বাচনের সময় নির্বাচন কমিশনের পরিপত্রও আইনের সমতুল্য বলে স্বীকৃত। যদিও ওই পরিপত্র কোন বিদ্যমান আইনে, এ বিষয়ে শুধু ভারতেই নয়, বাংলাদেশেও উচ্চতর আদালতের ব্যাখ্যা রয়েছে।

ওপরের সংক্ষিপ্ত আলোচনা, বিভিন্ন গবেষণা এবং তুলনামূলক বিশ্লেষণেও প্রতীয়মান যে উপমহাদেশের অন্যান্য নির্বাচন কমিশনের তুলনায় বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন আইনের দিক থেকে অনেক শক্তিশালী। অথচ ওই বিশ্লেষণেই প্রতীয়মান হয় যে আইন প্রয়োগের এবং সিদ্ধান্ত ও আইনের প্রয়োগে উপমহাদেশের অন্যান্য কমিশন থেকে বাংলাদেশ অনেকাংশে দুর্বল। এর প্রধান কারণগুলো হলো বেশির ভাগ সময়ে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন প্রধান শরিকদের কাছ থেকে তেমন সহযোগিতা না পাওয়া এবং অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা।

এ পর্যন্ত বাংলাদেশে ১২টি নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছে (বর্তমান নুরুল হুদা কমিশনসহ) এবং ১১টি কমিশনের ৩টি ছাড়া ৮টি কমিশন ১০টি জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিচালনা করেছে। এসব নির্বাচনের মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় চারটি নির্বাচন ছাড়া বাদবাকি নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। এ প্রসঙ্গে এইচ এম এরশাদের নির্বাচনগুলো বাদ দিলেও ১৯৯৬ ও ২০১৪ সালের নির্বাচন নিয়ে নতুন করে বলার তেমন কিছু নেই। তবে সবচেয়ে খারাপ নির্বাচনের উদাহরণ হয়ে থাকবে ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন।

যেমনটা আগেই বলেছি, নির্বাচন কমিশন কার্যকর হতে পারেনি রাজনৈতিক সরকারের অধীনে সব ধরনের নির্বাচন পরিচালনার ক্ষেত্রে। বিশেষ করে, রাজনৈতিক সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদসহ অন্যান্য স্থানীয় সরকার নির্বাচনের সময় নিরপেক্ষভাবে সর্বাত্মক সহযোগিতা না করার কারণে প্রায় সব নির্বাচন কমিশনকে নানা ধরনের প্রতিকূলতার মধ্যে কার্যক্রম পরিচালনা করতে হয়েছে। অনেক নির্বাচন কমিশন নিজের দুর্বলতার কারণেও কার্যকর হতে পারেনি। অনেক সময় সরকারের ভিন্ন অবস্থানের কারণে নির্বাচন কমিশনের অনেক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা যায়নি। বিশেষ করে, নির্বাচনের নিরাপত্তা বিধানে সেনা নিয়োগের প্রশ্নে। যেমনটা হালে সেনা নিয়োগ নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের একজন নেতার বক্তব্য। এই বক্তব্যের সূত্রপাত বর্তমান প্রধান নির্বাচন কমিশনারের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সম্ভাব্য সেনা মোতায়েনের সম্ভাবনার মতামত ব্যক্ত করার পর। প্রশ্ন উঠেছে, সেনা মোতায়েন করা বা না করার এখতিয়ার নির্বাচন কমিশনের রয়েছে কি না।

যে ধরনের বক্তব্য, যাকে ঘিরে রাজনৈতিক অঙ্গনে বিতর্ক উঠেছিল, তা মোটেই কাম্য নয়। বাংলাদেশের ১১টি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সেনা মোতায়েন অপরিহার্য ছিল। তবে এ ধরনের বিতর্কের কারণে আরপিওতে সামরিক বাহিনী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে সংজ্ঞায়িত ছিল। পরে বাদ দেওয়া হয়। কেন দেওয়া হয়, তার ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি। আমাদের দেশে ভারতের মতো আলাদা কেন্দ্রীয় সরকারের কোনো বাহিনী নেই। ভারতে নির্বাচন কমিশন রাজ্য পুলিশের সহায়তা নিলেও কেন্দ্রীয় বাহিনী স্ট্যাবিলাইজিং এবং অনেকটা নিরপেক্ষ ফোর্স হিসেবে নিরাপত্তার বেশির ভাগ দায়িত্বে নিয়োজিত থাকে। বাংলাদেশে এ কাজটিই সামরিক বাহিনী করে থাকে। তা ছাড়া, বেসামরিক বাহিনীগুলোর নিরপেক্ষতা নিয়েও জনমনে ধোঁয়াশা রয়েছে। অতীতে বহুলাংশে বিভিন্ন ঘটনার কারণে এমন অবিশ্বাসের জন্ম দিয়েছে। আরও বিশেষ কিছু কারণেই সেনা মোতায়েন আবশ্যক হয়ে পড়ে।

অতীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন ছাড়া বহু সময় সেনাবাহিনী নিয়োগ নিয়ে নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্ত সরকারগুলো মোটেও গুরুত্ব দেয়নি। এর সূত্রপাত হয় ১৯৯১ সালে পূর্ণ গণতন্ত্র পুনর্বহালের পর থেকে। ২০০৩ সালে তৎকালীন নির্বাচন কমিশন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের প্রাক্কালে তৎকালীন বিএনপি সরকারের কাছে একাধিকবার সেনাবাহিনীর প্রয়োজনীয়তার সিদ্ধান্ত জানালেও সরকার কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি।

তৎকালীন প্রধান নির্বাচন কমিশনার মরহুম আবু সাঈদ আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন, সেনাবাহিনী মোতায়েন না করলে ব্যাপক রক্ত ঝরতে পারে। সেনা মোতায়েন নিয়ে নির্বাচন কমিশন ও সরকার প্রায় মুখোমুখি অবস্থানে ছিল। দুঃখজনক হলো, স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সরকার সহযোগিতা করেনি। শুধু সেখানেই থেমে থাকেনি, প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে নিয়ে সংসদেও সরকারি দলের কিছু সদস্য বিরূপ মন্তব্য করে অভিশংসনের দাবিও করেছিলেন।

এ ধরনের দাবি বাংলাদেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন। ওই সময়ে নাগরিক সমাজে প্রশ্ন উঠেছিল, এতে নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হয়েছে কি না? সংবিধান লঙ্ঘিত হয়েছে কি না? অবশ্যই হয়েছিল কিন্তু এর প্রতিকার ছিল আইনের আশ্রয় অথবা সংবিধানের রক্ষক হিসেবে উচ্চ আদালতের হস্তক্ষেপে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশে এরপরও এ ধরনের ঘটনা ঘটলেও কেউ আদালতের দ্বারস্থ যেমন হননি, তেমনি আদালত স্বপ্রণোদিত হয়ে কোনো পদক্ষেপ নেননি। অবশ্য নিতে পারতেন কি না, তা সংবিধান বিশেষজ্ঞরাই ভালো বলতে পারবেন। বিভিন্ন পত্রপত্রিকার সূত্রমতে, ওই নির্বাচনে শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়।

সেনা মোতায়েন নিয়ে বিতর্ক এবং নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে মতভেদ সেখানেই শেষ হয়নি। ২০০৪ সালে ঢাকা-১০ আসনের উপনির্বাচনে একজন প্রার্থীকে আদালতে যেতে হয়েছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সেনা মোতায়েনের জন্য। আদালতের রায় সত্ত্বেও নির্বাচন কমিশন পরিকল্পনা মোতাবেক সেনা মোতায়েন করতে পারেনি। ওই নির্বাচনও দারুণভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছিল। সময়কাল ছিল বিএনপির শাসনামল। ২০১১ সালেও নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সেনা নিয়োগ নিয়ে নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্ত সরকার বাস্তবায়ন করেনি। তখনো সংবিধানের প্রশ্ন উঠেছিল এবং তা অমীমাংসিত থেকে যায়। ওই সময় নির্বাচনী আইনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংজ্ঞায় সামরিক বাহিনী অন্তর্ভুক্ত ছিল। তথাপি ওই সময়ের সর্বতোভাবে অধিকতর স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত না হওয়ায় ওই নির্বাচন অনুষ্ঠানে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছিল।

যাই হোক, বাংলাদেশের ইতিহাসে হাতে গোনা কয়েকটি কমিশন ছাড়া প্রায় প্রতিটিকেই অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা এবং অন্যান্য কারণে তেমন কার্যকর হতে দেখা যায়নি বা পারেনি। যদিও আইনের দিক থেকে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন সর্বতোভাবে স্বাধীন হলেও প্রধান শরিকদের, বিশেষ করে দলীয় সরকারের তরফ থেকে সুষ্ঠু, অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে যদি সর্বতোভাবে সহযোগিতা না করা হয়, তবে নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনভাবে কাজ করা কষ্টকর হয়। নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা রক্ষায় যেমন সরকারের ভূমিকার প্রয়োজন, তেমনি অন্যান্য সংস্থার সক্রিয় সহযোগিতারও প্রয়োজন। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো বিচারব্যবস্থার সক্রিয় ভূমিকা। নির্বাচন কমিশন স্বাধীনভাবে তার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে না পারলে কাগজ-কলমে শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন কার্যকর হতে পারে না।

এম সাখাওয়াত হোসেন : সাবেক নির্বাচন কমিশনার, কলাম লেখক ও পিএইচডি গবেষক
hhintlbd@yahoo. com