বেলাল ভাই: পরার্থে যাপিত এক জীবন

বেলাল চৌধুরী।  ছবি: নাসির আলী মামুন
বেলাল চৌধুরী। ছবি: নাসির আলী মামুন

আর কয়েক মাস বেঁচে থাকলে বেলাল চৌধুরীর ৮০ বছর পূর্ণ হতো। তাঁর জন্ম ১২ নভেম্বর ১৯৩৮। মৃত্যুর তারিখটি লিখিত হয়েছে গতকাল, ২৪ এপ্রিল। টি এস এলিয়টের ভাষায়, ‘এপ্রিল নিষ্ঠুর মাস’। এই নিষ্ঠুর মাসেই বেলাল চৌধুরী, আমাদের প্রিয় বেলাল ভাই বিদায় নিলেন।

কবিতায়-চরিত্রে-জীবনযাপনে বেলাল ভাই ছিলেন ব্যতিক্রমী মানুষ। আমাদের দেশের লেখকেরা সাধারণত আটপৌরে জীবনযাপনে অভ্যস্ত, আর যাঁরা দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়ান, তাঁদের মধ্যে একধরনের বিচ্ছিন্নতাবোধ কাজ করে। মাটি ও মানুষের সঙ্গে খুব একটা সম্পর্ক থাকে না। কিন্তু বেলাল চৌধুরী চিন্তা ও মননে চিরকালীন পর্যটক হয়েও এই মাটি ও মানুষের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন।

কৈশোরে বেলাল ভাই যখন স্কুলের ছাত্র, ভাষা আন্দোলনে যোগ দিতে গিয়ে জেল খেটেছেন। পরে বাম রাজনীতির সঙ্গেও যুক্ত হন। পাকস্তানি শাসকদের চোখে তিনি ছিলেন বিপজ্জনক মানুষ। তাঁর নামে হুলিয়া জারি হয়। ষাটের দশকে গ্রেপ্তার এড়াতেই তিনি দেশ ছাড়েন, জাহাজে জাহাজে ঘুরে বেড়ান। ১৯৬৩ সালে যখন পাকিস্তান-ভারত সম্পর্কে দারুণ টানাপোড়েন চলছিল, এক দেশ অপর দেশের নাগরিকদের শত্রু ভাবত, সেই সময়ে তিনি জাহাজযোগ কলকাতায় হাজির হন এবং থেকে যান। সেখানে তিনি পশ্চিমবঙ্গের লেখক-কবি-শিল্পীদের সঙ্গে গভীর সখ্য তৈরি করেন, এপারের মৃত্তিকা ও জলহাওয়া থেকে পাওয়া মুখের ‘বাঙাল ভাষাটি’ অটুট রেখেই। এমনকি পঁয়ষট্টির পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের সেই নিষ্প্রদীপ মহড়ার দিনগুলোতেও তাঁর দিনের আড্ডা ও নৈশবিহার বন্ধ হয়নি। বেলাল ভাই কলকাতায় লিটল ম্যাগ আন্দোলন তথা হাংরি জেনারেশনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে মিলে সম্পাদনা করেন কৃত্তিবাস। কলকাতায় আরও যাঁদের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে, তাঁদের মধ্যে ছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শিবনারায়ণ রায়, তারাপদ রায়, উপল কুমার বসু, কমল কুমার মজুমদার। আবার ১৯৭৪ সালে হঠাৎ করেই কলকাতার পাত গুটিয়ে বেলাল চৌধুরী ঢাকায় চলে আসেন। স্বাধীন বাংলাদেশে শুরু হয় তাঁর নতুন জীবন ও সাহিত্য সাধনা।

এই ঢাকা শহরে বেলাল ভাই ছিলেন অনেক নবীন-প্রবীণ লেখক-কবির অন্যতম সহায়। কেউ বিপদে পড়লে সেটি হোক পারিবারিক কিংবা আর্থিক, ভাবতেন, বেলাল চৌধুরীর কাছে গেলে একটা হিল্লে হবে। যেকোনো কারণেই হোক বাংলাদেশের অনেক ধনাঢ্য ব্যক্তির সঙ্গেও তাঁর সুসম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। কিন্তু বেলাল ভাই কখনো সেই সম্পর্কটি নিজের স্বার্থে ব্যবহার করেননি, সাধ্যমতো অন্যদের সহায়তা করেছেন। ১৯৮৭ সালে এরশাদের সামরিক স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে শামসুর রাহমানকে সভাপতি করে যে জাতীয় কবিতা পরিষদ গঠিত হয়, তারও অন্যতম প্রাণশক্তি ছিলেন বেলাল চৌধুরী।

বেলাল ভাই যখন ভারত বিচিত্রার সম্পাদক ছিলেন, তখন ধানমন্ডিতে তাঁর অফিসটি হয়ে ওঠে ‘বিকল্প ভিসা দপ্তর’। লেখক-শিল্পী তো বটেই, সমাজের অপরাপর মানুষও তাঁর কাছে গেলে সহায়তা পেতেন।

বেলাল চৌধুরীর প্রধান পরিচয় কবি। প্রাবন্ধিক সাইফুল্লাহর ভাষায়, ‘বাংলাদেশের আকাশ, বাতাস, বৃক্ষ, নদী-পাখির কলরব তাঁর কবিতায় প্রবহমান। মানুষের আর্তি, প্রেম-বিরহ ও জীবনসংগ্রামের বর্ণনা তাঁর কবিতায় মূর্ত হয়ে ওঠে। কবিতামাত্রই স্বপ্নমগ্ন। নতুন স্বপ্নে প্রতিদিন লগ্ন হয়ে কবি তুলে আনেন পৃথিবীতে তাঁর বিচরণ আর দিনযাপনের অর্থময়তা। সামাজিক বৈরিতা, দুঃশাসকের রাজদণ্ড ও নীতি তাঁকে স্বপ্ন দেখা থেকে সরিয়ে আনতে পারে না। বেলাল চৌধুরী জীবনকে ইতিবাচক ভঙ্গিতে প্রত্যক্ষ করেন। তাঁর কবিতায় স্বপ্ন ও জাগরণের নিত্যনতুন আভাস লক্ষ করা যায়।’
তাঁর কবিতায় লাতিন কবিতার ছাপ স্পষ্ট; বিশেষ করে ব্যক্তিমানসের আবেগ ও ইচ্ছে যখন উচ্চারিত হয়। বাস্তব আর পরাবাস্তব এক হয়ে যায়।
‘হাওয়া মহল’ কবিতায় তিনি লিখেছেন, বাড়িটায় কেউ থাকে না শুধু হাওয়ায় কুহক/জড়িয়ে আছে পাকে পাকে আইভি লতার আলিফ/লালচে ইটে পড়ন্ত রোদ আর হাহাকার/কেউ থাকে না ও বাড়িটায় শুধু হাওয়ার কুহক/ও বাড়িটায় আনাচ কানাচ অলিগলি কোথাও কেউ থাকে না বাড়িটা বেবাক বাউণ্ডুলে/তত্ত্ব তালাশ কেউ করে না শুধু হাওয়ায় কুহক (হাওয়া মহল)

আমাদের লেখক-কবিদের মধ্যে যে কয়জন বিশ্বসাহিত্যের খোঁজখবর রাখেন, বেলাল চৌধুরী ছিলেন তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য। বিশেষ করে লাতিন আমেরিকার সাহিত্যের প্রতি তাঁর আলাদা টান ছিল। বাইরের দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ লেখকদের যেসব বই তিনি পড়তেন, সেসব নিয়ে সুহৃদ-সতীর্থদেরও পড়তে উৎসাহিত করতেন।

বেলাল ভাইয়ের গদ্যের একটি আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। তিনি ঠিক গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ লিখতেন না, ব্যক্তিগত আলাপ বা গল্পের ঢঙে সাহিত্যের ভেতরে পাঠকদের নিয়ে যেতেন। তাঁর ভ্রমণকাহিনিতে ব্যক্তি ছাপিয়ে সমষ্টি, আর সমষ্টি ছাপিয়ে সর্বজনীন চিত্র ফুটে ওঠে, যা শেষ পর্যন্ত আর ভ্রমণকাহিনি থাকে না; হয়ে ওঠে জীবনবেদ।

অন্য লেখক-কবিরা অসুখে পড়লে, কিংবা বিপদ-আপদের মুখোমুখি হলে বেলাল চৌধুরী ছুটে যেতেন। তাঁর কাছে কোনো অনুরোধ করে কোনো নবীন লেখক বিমুখ হয়েছেন, এ উদাহরণ নেই। কিন্তু তিনি যখন দীর্ঘদিন রোগশয্যায় ছিলেন, আমরা অনেকেই তাঁর খোঁজ নিইনি। রাষ্ট্রের অধিপতিরাও খবর নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি। বেলাল ভাই, আমাদের এই সম্মিলিত অক্ষমতা ক্ষমা করুন। প্রকৃত প্রস্তাবে বেলাল ভাই নিজের জন্য নয়, পরার্থে একটি জীবনযাপন করে গেছেন, নিজের ভালোবাসায় সঞ্চয় দুহাত ভরে বিলিয়েছেন।

প্রতিনায়কের স্বগতোক্তি নামে তাঁর একটি কবিতা আছে। মনে হবে নিজেকে নিয়ে লেখা। তিনি আসলে ছিলেন নায়ক। তাঁর কবিতার শেষ কটি পঙ্ক্তি দিয়েই এই শ্রদ্ধাঞ্জলি শেষ করছি: গোপন পাপের শরশয্যায় শুয়ে আমি/নিদারুণ তৃষ্ণায় ছটফট করছি-হায় রে জলধারা/কিন্তু এবার ওরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ-নিষ্কৃতি নেই আমার/নির্বাসনে মৃত্যুদণ্ড-ঠান্ডা চোখে দেখছি আমি/নীল কুয়াশায় ঢাকা পড়ছে আমার দেহ।

সোহরাব হাসান, প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
[email protected]