মৃত্যুর মুখ এবং আমাদের নাগরিক জ্ঞান

ঢাকার কোনো রাস্তা ঝকঝকে দেখলে মন বলে, ‘বাহ, রাস্তাটা তো ভারি সুন্দর! কবে হলো!’
ঢাকার কোনো রাস্তা ঝকঝকে দেখলে মন বলে, ‘বাহ, রাস্তাটা তো ভারি সুন্দর! কবে হলো!’

পাঠাওয়ের মোটরসাইকেলে করে যাচ্ছিলেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রেজাউর রহমান। পয়লা বৈশাখের ঠিক আগের দিন রাত। শ্যামলী সিনেমা হলসংলগ্ন রাস্তার সামনে মোটরসাইকেলের সামনের চাকা পড়ে গেল খোলা ম্যানহোলে। রেজাউর রহমান ছিটকে গিয়ে পড়লেন রাস্তায়। মাথায় প্রচণ্ড চোট পেলেন। বাড়ির বদলে রেজাউর রহমানের ঠিকানা হয়ে গেল হাসপাতাল। বাংলা নববর্ষের হইহল্লার কিছুই টের পেলেন না এই তরুণ শিক্ষক। কারণ, তিনি তখনো অচেতন। মাথায় রক্তক্ষরণ ধরা পড়েছে।

১৫ এপ্রিল রেজাউর রহমানের জ্ঞান ফিরেছে। এর মধ্যে তাঁকে ছেড়েও দেওয়া হয়েছে। তবে পুরোপুরি সুস্থ হতে আরও তিন মাস লাগবে।

‘মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরলেন বিশ্ববিদ্যালয়শিক্ষক’ শীর্ষক খবরটি পড়ে শিক্ষক রেজাউর রহমান সম্পর্কে মোটামুটি এই তথ্য জানা গেল। ২৫ এপ্রিল প্রথম আলোয় প্রকাশিত হয় এ খবর।

সত্যিই মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরেছেন রেজাউর রহমান। তাঁর প্রতি সহানুভূতি আর ভালোবাসা। আশা করি, দ্রুতই সম্পূর্ণ আগের সক্ষমতায় ফিরবেন। মানবাধিকার বিষয়ে আইনি কাজ, রোহিঙ্গাদের অধিকার বিষয়ে এ রকম তৎপর একজন মানুষকে এ দেশের খুব প্রয়োজন। আশা করি, সেই মনোবলও তাঁর আছে।

আমাদের প্রশ্ন, পাঠাও কি তার যাত্রীকে হেলমেট পরিয়েছিল? দিনের পর দিন ম্যানহোলের ঢাকনা খোলা থাকায় কত দুর্ঘটনা ঘটছে, তার দায় কি নগর কর্তৃপক্ষের থাকবে না? সভ্য দেশে এই দুই দায়ের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত নাগরিককে বিপুল পরিমাণ ক্ষতিপূর্ণ দিতে হতো সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের।

এই ঢাকা নগরের জনাকীর্ণ রাজপথে প্রতিনিয়ত কত মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে, হাত-পা খোয়াচ্ছে, তা নিয়ে কি খুব বেশি ভাবি আমরা? এ যেন ডালভাত। রাজীবের হাত হারানোর মতো দু-একটা ঘটনা কদাচিৎ আলোড়ন তোলে, তারপর তা হারিয়ে যায় অন্য কোনো ইস্যুর অতলে। আমরা দেখি, বুঝি, উপলব্ধি করি, তারপর মুখ ঘুরিয়ে ফেলি। সামনে কত ঘটনা, কত সমস্যা, একটা নিয়ে পড়ে কে থাকে?

ঢাকার রাস্তাঘাটে খোলা ম্যানহোল, উদোম নর্দমা, ভাঙাচোরা রাস্তা—এ তো খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। বরং ঝকঝকে সুন্দর একটি রাস্তা দেখলে মন বলে, ‘বাহ, রাস্তাটা তো ভারি সুন্দর! কবে হলো!’

ম্যানহোল ঢাকনাবিহীন হয় দুটো কারণে। হয় চোর ঢাকনা নিয়ে যায়, নইলে ঢাকনা পুরোনো হতে হতে ক্ষয় ধরে ভেঙেচুরে যায়। এর মধ্যে চোরের ঘটনাটি বিপজ্জনক। একটা চোর যখন ম্যানহোল চুরি করে, তখন আক্ষরিক অর্থেই মৃত্যুর মুখ সে খুলে দেয়। ওই ঢাকনা সে ভাঙারি দোকানে বড়জোর এক-দেড় শ টাকায় বিক্রি করে। কিন্তু পথচারীদের জন্য রেখে যায় জীবন্ত মৃত্যুফাঁদ। ম্যানহোলে পড়ে হতাহত হওয়ার ঘটনাও কিন্তু এ নগরে কম নেই।

ম্যানহোলের ঢাকনা লোপাট হলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দিনর পর দিন তা ওভাবেই থাকে। সচেতন দু-একজন অবশ্য দুর্ঘটনা কথা মাথায় রেখে ওই খোলা গর্তে লাঠি বা গাছের ডাল রেখে বিপৎসংকেত বোঝান। কিন্তু এই মৃত্যুফাঁদ চট করে ঘোচানোর মতো ত্বরিত উদ্যোগ সচরাচর দেখা যায় না। অনেকেই ভাবেন, আমার কী দায়? কর্তৃপক্ষও যেন ভাব দেখায়—আমার কী আসে-যায়! অথচ যেকোনো সময় যে-কেউ এই মৃত্যুফাঁদে সেঁধিয়ে যেতে পারে।

এখানে যে মোক্ষম কথাটি অবধারিতভাবে ওঠে, তা হলো সিভিক সেন্স বা নাগরিক জ্ঞান। হ্যাঁ, অনেকেই বাঁকা হেসে বলবেন যে চোরা যেখানে ধর্মের কাহিনি শোনে না, সেখান আবার তার সিভিক সেন্স—হুঃ! চোরের না হয় না-ই থাকল, অন্যদের তো আছে। নগর কর্তৃপক্ষের যেমন মনে করতে হবে এটা মানুষের শহর, তেমনি নাগরিকদেরও অন্যদের মানুষ মনে করে সহমর্মী থাকতে হবে। ঢাকার মতো নগরে থাকতে হলে অবশ্যই নাগরিক জ্ঞান থাকতে হবে। অন্যদের অধিকার রক্ষায় সহযোগিতামূলক মনোভাব থাকতে হবে। কারও বিরক্তি বা ক্ষতির কারণ ঘটানোর মতো কিছু করা যাবে না। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। পাড়া বা মহল্লায় রাস্তা একটু চওড়া হলেই তা নিয়ে চলে নানা ধান্দাবাজি। দেখা যাবে, রাস্তার পাশে ইট-বালু-খোয়া রেখে ব্যবসা ফেঁদেছে একশ্রেণির লোক। খুঁজলে সহজে এদের দেখা মেলে না। ইট-বালু ঠিকই আসে, জায়গা দখল করে ব্যবসা চলে। চলাচলে অন্যদের অধিকার ক্ষুণ্ন করে, বিড়ম্বনায় ভোগায়, কিন্তু ধান্দাবাজদের কি আসে-যায়?

পাড়া বা মহল্লায় আরেকটি বড় দুর্ভোগ সকালে বসা ক্ষণিকের বাজারগুলো। দেখা যাবে, কোনো এলাকার ব্যস্ত সড়কের ধারে রিকশাভ্যানে করে শাকসবজি এনে বসে গেছে সে বাজার। অ্যালুমিনিয়ামের থালায় মাছ নিয়েও বসে যায় অনেকে। আশপাশের মানুষ হাতের কাছে পেয়ে কেনেও দেদার। কিন্তু সেটা যে স্কুল-কলেজগামী শিক্ষার্থী আর কর্মজীবী মানুষের ব্যস্ততায় বাগড়া দিচ্ছে, তা কিন্তু কারও আমলে নেই। এই ক্ষণিক-বাজার ব্যস্ত রাস্তা সড়ক সরু করে দেওয়ায় যানবাহন চলাচলে জট তৈরি হয়। বাড়ে যানবাহনে টেক্কাবাজি। কে কাকে পাশ কাটিয়ে যাবে—এ প্রতিযোগিতা আরও জটিল করে তোলে পরিস্থিতি। তখন দুর্ঘটনা ঘটার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়।

এবার নিজের এক অভিজ্ঞতার কথা বলি। অফিস থেকে বিকেলে রিকশায় করে বাসায় ফিরছি। কারওয়ান বাজার থেকে বের হয়ে রেলক্রসিংয়ের যানজট আটকা পড়লাম। মিনিট বিশেক পর জট একটু হালকা হতেই রিকশা, স্কুটার, ভ্যান—কে কার আগে যাবে, হুড়োহুড়ি। রেলক্রসিং পাশ কাটিয়ে ডিমের আড়তের মাঝ দিয়ে ছুটল রিকশা। এ সময় আরও কয়েকটি রিকশা দৌড়ে অংশ নেয়। আমার রিকশার পাশেই ছিল একটি খালি রিকশা। সেটা কিছুই পথ ছাড়বে না, আমারটাও পিছু হটবে না। একপর্যায়ে পাশাপাশি চলে এল দুটো। একটা চাকার সঙ্গে আরেকটা চাকা জড়িয়ে গেল। আমি আঁতকে উঠে চেঁচালাম, ‘থামো, থামো!’

কেউ থামল না। চাকায় চাকায় জড়িয়ে চরকির মতো পাক খেল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই রিকশা দুটো দুদিকে উল্টে গেল। আমি মিডঅনে ক্যাচ ধরার ভঙ্গিতে ডান হাত সামনে বাড়িয়ে পড়ে গেলাম রাস্তার পাশে। প্রথমে মনে হলো—অগস্ত্যযাত্রা! পরে দেখি—না, বেঁচে আছি। কনুই আর হাঁটুর তীব্র ব্যথা সে কথা জানান দিচ্ছে। ফুল হাতা গেঞ্জির কিয়দংশ নাই করে দিয়ে ডান কনুইয়ের খানিকটা খুবলে গেছে। হাঁটু গেছে ছড়ে। হাত দুয়েক দূরে ভাঙারির দোকানে লোহার শিক পিটিয়ে সোজা করা হচ্ছিল। আরেকটু হলেই হাত ওই নেহাইয়ের ওপর পড়ত। পড়েনি যখন, সে কথা আর বলতে চাই না। তবে ভাঙারির দোকানের খেটে খাওয়া তরুণ ভাইয়েরা যা দেখাল! ছুটে এসে আমাকে টেনে তুলল। হাড়গোড় ভেঙেছ কি না—হাতড়ে দেখল। খুবলে যাওয়া জায়গায় অ্যান্টিবায়োটিক তরল ঢেলে ধুয়ে দিল। আমি তাদের মানবিক আচরণে মুগ্ধ। এখনো এই নগরে এমন মানুষ আছে বলেই আমরা চলতে পারছি।

সেদিন ছিল ১৪ ফেব্রুয়ারি, বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। কয়েকজন তরুণের অন্য রকম ভালোবাসা পেয়ে ধন্য আমি।
শরিফুল ইসলাম ভূঁইয়া: সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
[email protected]