বাংলাদেশ গ্যাপ ও গ্লোবাল গ্যাপ

প্রথম আলো ফাইল ছবি
প্রথম আলো ফাইল ছবি

একবার সারা দেশে হইচই পড়ে গেল যে অসাধু ব্যবসায়ীরা মাছ, শাকসবজি, ফলমূল এমনকি দুধেও ফরমালিন দেন। আর আমরা সেই বিষ খেয়ে ক্যানসার থেকে শুরু করে কত রোগেই না ভুগছি। বড় বড় চেইন শপে কোটি কোটি টাকা দিয়ে ফরমালিন পরীক্ষার যন্ত্রপাতি কেনা হলো। বাজারে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরীক্ষা করে ফরমালিন দেওয়া খাদ্যদ্রব্যের অসাধু ব্যবসায়ীদের ধরলেন। জরিমানা এমনকি জেল হয়ে গেল। ফরমালিন আমদানি ও ব্যবহারে কড়াকড়ি হলো। এরপর এখন সরকার বলছে ফরমালিন আর নেই। যা আছে সেটা প্রাকৃতিক। সব খাদ্যদ্রব্যেই থাকে।

এখন প্রশ্ন হলো, আমরা কি নিশ্চিন্ত মনে বাজার থেকে নিরাপদ খাদ্যদ্রব্য কিনতে পারি? এর উত্তর হ্যাঁ এবং না।

৮ এপ্রিল প্রথম আলোর গোলটেবিল বৈঠকে এ নিয়ে কঠিন আলোচনা হয়। ফুড সেফটি অথরিটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মাহফুজুল হক বেশ জোর দিয়ে বলেন, এখন কোনো ফরমালিন নেই। নকল ডিম বলে কিছু নেই। চাষের মাছ নিরাপদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক মো. ইকবাল রউফ মামুন বললেন, ক্যালসিয়াম কার্বাইড দিয়ে ফল পাকানো হয় ঠিকই, তবে গাছে যে ফল পাকে, সেটা তার ভেতর থেকেই আসে। নিজের নিঃসৃত ক্যালসিয়াম কার্বাইড বা ইথিলিন প্রাকৃতিক উপায়ে ফল পাকায়।

কথাটা ঠিক, তবে সমস্যা অন্যখানে। কৃত্রিমভাবে বাইরে থেকে এই রাসায়নিক দ্রব্য প্রয়োগে একটাই ভয়-প্রয়োজনের অতিরিক্ত ব্যবহার। স্বাস্থ্যের জন্য বিপদ হতে পারে। সেটা নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য অভিযান চালাতে হবে।

আমাদের গোলটেবিল বৈঠকে সহযোগিতায় ছিল সুপার স্টোর চেইন শপ স্বপ্ন। এসিআই লজিস্টিকসের (স্বপ্ন) নির্বাহী পরিচালক সাব্বির হাসান নাসির বলেন, তাঁরা ‘গ্লোবাল গ্যাপ’ অনুসরণ করে খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন ও বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছেন। বিভিন্ন এলাকায় কৃষকদের সচেতন ও সংগঠিত করছেন। মাছের খামার থেকে শুরু করে ডিম, মুরগি, মাংস উৎপাদনে কাজ করছেন। ক্রেতারা যেন নিরাপদ খাদ্য পায়, সেই ব্যবস্থা করছেন।

এই ‘গ্লোবাল গ্যাপ’ কী? এটা হলো আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মান নিশ্চিত করে এমন ভালো কৃষি অনুশীলন বা গুড অ্যাগ্রিকালচারাল প্র্যাকটিস (গ্যাপ)। অধ্যাপক রউফও বলেছেন, গ্লোবাল গ্যাপের আলোকে আমরা বাংলাদেশ গ্যাপ অনুসরণ করার উদ্যোগ নিয়েছি। যদি তা-ই হয়, তাহলে আমরা কিছুটা আশার আলো দেখি।

তারপরও কিন্তু থাকে। সেটা একেবারে সোজাসাপ্টাভাবে বলে গেছেন চ্যানেল আইয়ের পরিচালক ও বার্তাপ্রধান শাইখ সিরাজ। তিনি যেটা বলেছেন, এককথায় তা ভয়াবহ। কয়েক মাস পর কোরবানির ঈদ। বাজারে যেসব মোটাতাজা গরু আনা হয়, তা কতটা স্বাস্থ্যসম্মত, সেই প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, অনেক অসাধু ব্যবসায়ী গ্রোথ হরমোন খাইয়ে গরু মোটাতাজা করে বেশি দামে বিক্রি করেন। কিন্তু ওগুলো স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। প্রতিবছরই আমরা মোটাতাজা গরুর সমস্যার কথা শুনি। এখন থেকেই কর্তৃপক্ষকে সাবধান হতে হবে, যেন ঈদের বাজারে হরমোন খাওয়ানো গরু কেউ আনতে না পারে।

শাইখ সিরাজ বলেন, নিরাপদ খাদ্যের অনেক আধুনিক প্রযুক্তি আসছে। আমরা তার খবর রাখি না। যেমন বেগুনের পোকা মারার জন্য এমন সব কীটনাশক দেওয়া হয়, যা স্বাস্থ্যের খুব ক্ষতি করে। তাই আমরা ফেরোমিন ট্র্যাপ ব্যবহার করি। কিন্তু এখন বিশ্বে কালার ট্র্যাপ, স্মেল ট্র্যাপসহ আরও কত প্রযুক্তি এসে গেছে, আমরা ওগুলোর ব্যবহারে তেমন গুরুত্ব দিই না। শাইখ সিরাজ প্রশ্ন তোলেন, অনেক জেলায় মাটির জৈব উপাদান শূন্যের কোঠায়। তাহলে ভালো ফসল পাব কীভাবে? চাষের মাছের জন্য যে খাবার ব্যবহার করা হয়, তার মান নিয়ন্ত্রণের নির্ভরযোগ্য ব্যবস্থা কতটা কার্যকর? নদীদূষণ চলছে, তাহলে নদীর মাছই বা কতটা নিরাপদ? এসব দিকে নিশ্চয়ই কর্তৃপক্ষের খেয়াল রাখতে হবে।

স্বপ্ন অঞ্চল ভিত্তিতে কৃষকদের সচেতন করছে। প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। কৃষকও রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারের নিয়মকানুন শিখছেন। শুধু তা-ই নয়, মুখে মুখোশ ও হাতে দস্তানা ব্যবহার করে কাজ করছেন। এতে তাঁর নিজের স্বাস্থ্যঝুঁকিও থাকছে না। আর তা ছাড়া স্বপ্ন কৃষি উৎপাদন সরাসরি তাদের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কৃষকদের কাছ থেকে কিনছে। ফলে কৃষক ও ক্রেতা উভয়েই লাভবান হচ্ছেন।

নিরাপদ খাদ্যের জন্য ঠিক এ রকম উদ্যোগই চাই। স্বপ্নের মতো অন্যান্য সুপার স্টোর চেইন শপও উদ্যোগ নিচ্ছে। ফলে আমরা নিরাপদ খাদ্যের একটা অনুকূল পরিবেশ হয়তো পাব।

এখানে ক্রেতাদেরও সচেতনতা দরকার। যেমন শাকসবজি, ফলমূল কিনে এনে খাওয়ার আগে ভালো করে ধুয়ে কিছুক্ষণ পানিতে ভিজিয়ে রাখলে ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ থাকলেও সেগুলো হয়তো চলে যাবে। বেগুনের ব্যাপারে সাবধান। আমরা বলি, একেবারে ঝকঝকে বেগুনের চেয়ে দু-একটা পোকা ধরা বেগুন ভালো। অন্তত বোঝা যাবে ওই বেগুনে কীটনাশক নেই।

অনেক সময় নানা রকম অপপ্রচারে ক্রেতারা বিভ্রান্ত হন। যেমন ফুড সেফটি অথরিটির চেয়ারম্যান বলেছেন, তরমুজ বা অন্য কোনো ফলে ইনজেকশন দিয়ে রং মেশানো যায় না। অধ্যাপক মো. ইকবাল রউফ মামুন বলেন, মিনিকেট চাল খেলে নাকি ক্যানসার হয়! এটা একদম ভুল কথা। পরিশোধিত ধবধবে সাদা চালে হয়তো পুষ্টি কমে যায়, কিন্তু এই চালের ভাত খেলে কোনো দিন ক্যানসার হতে পারে না। এসব কথা সরকারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হলে মানুষ বিভ্রান্ত হবে না।

প্রায় চার দশক আগে একবার আমরা কয়েকজন মস্কোতে পড়তে গিয়েছিলাম। তখন সোভিয়েত ইউনিয়ন। প্রথম সাত দিন আমাদের দূর গ্রামের এক নির্জন ভবনে কোয়ারেন্টাইনে রেখে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হলো। পরে সোভিয়েত ডাক্তার আমাদের জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের দেশে কি কৃমির হাসপাতাল নেই? আমরা তো অবাক। কৃমি দূর করতে আবার বিশেষায়িত হাসপাতাল! ডাক্তার বললেন, সবার পেটই তো কৃমিতে ভরা। তিনি সবাইকে কৃমির ওষুধ দিলেন। পরে বুঝলাম আমাদের দেশে মানুষের বর্জ্য নিয়মিত মাঠঘাট, পুকুরপাড় দূষিত করে। সেই মাটিতে উৎপন্ন ফলমূলই কৃমির মহামারি ঘটিয়েছে। এখন অবশ্য স্বাস্থ্যসম্মত পয়োব্যবস্থা হয়েছে। অবস্থার উন্নতি ঘটেছে। তারপরও সাবধান থাকতে হয়। বিশেষত শিশুদের প্রতিবছর কৃমির ওষুধ খাওয়াতে হয়।

নিরাপদ খাদ্য ছাড়া আমরা ২০৩০ সালের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারব না।

আব্দুল কাইয়ুম: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক
quayum@gmail. com