ইসলামের আলোকে পথশিশুদের অধিকার

পথশিশু
পথশিশু

আল্লাহ তাআলা মানবজাতিকে খেলাফতের দায়িত্ব দিয়ে দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন। দায়িত্ব সফলভাবে প্রতিপালন করলে বন্ধুত্বের সম্মানে বিভূষিত করবেন। ইসলাম সর্বকালের সর্বযুগের সব মানুষের জন্য। ইসলামে রয়েছে পথশিশুদেরও ন্যায্য অধিকার। পথশিশু বলতে তাদের বোঝানো হয়, যাদের থাকার কোনো জায়গা নেই। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান এবং চিকিৎসা ও শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার। পথশিশুরা এসব মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। ইসলামের বিধানে পথশিশুদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে।

যারা পথশিশু, তারা তাদের এ অবস্থার জন্য দায়ী নয়। এমনকি তাদের এ অবস্থার জন্য তাদের পিতা-মাতা বা অভিভাবকও সর্বাংশে দায়ী নন। সুতরাং যাঁরা ভালো অবস্থায় ও ভালো অবস্থানে আছেন, তাঁদেরও ভাবতে হবে এবং বিশ্বাস করতে হবে যে এ অবস্থা আমার এবং আমার পরিবারের বা আপনজনদের কারও হতে পারত।

আল্লাহ যখন কোনো মোমিনকে পরীক্ষায় ফেলেন, অর্থাৎ কষ্টে নিপতিত করেন; তখন তিনি তাকে ভালোবাসেন এবং অন্যদের থেকে তাকে অগ্রাধিকার দেন। তাই তিনি নবীগণকে সবচেয়ে বেশি বিপদাপদের মাধ্যমে পরীক্ষা করেছিলেন। নবীজি (সা.) বলেন, ‘নবীগণ সবচেয়ে বেশি পরীক্ষিত হন, অতঃপর তাঁদের থেকে যারা নিকট স্তরের। মানুষকে তার বিশ্বাস অনুযায়ী পরীক্ষা নেওয়া হয়। যদি তার ইমান শক্তিশালী হয়, তাহলে তার পরীক্ষাও কঠিন হয়। আর যদি তার ইমান দুর্বল হয়, তাহলে তার পরীক্ষাও সে অনুপাতে হয়। বিপদ বান্দার পিছু ছাড়ে না, পরিশেষে তার অবস্থা এমন হয় যে সে পাপমুক্ত হয়ে জমিনে চলাফেরা করে। (তিরমিজি, হাদিস নম্বর ১৪৩ ও ইবনে মাজাহ)।

ইসলামের দৃষ্টিতে সব মানুষ সমান। ইমান ও তাকওয়া হচ্ছে মানুষ মর্যাদার মানদণ্ড। যে যত বেশি মুত্তাকি, আল্লাহ তাকে তত বেশি ভালোবাসেন। আল্লাহ পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করেন, ‘হে মানুষ! আমি তোমাদের সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ ও এক নারী হতে, পরে তোমাদের বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে, যাতে তোমরা একে অপরের সঙ্গে পরিচিত হতে পারো। তোমাদের মধ্যে ওই ব্যক্তিই আল্লাহর নিকট অধিক মর্যাদাসম্পন্ন, যে অধিক মুত্তাকি।’ (সুরা-৪৯ হুজুরাত, আয়াত: ১৩)।

পথশিশু এবং ছিন্নমূল ও গৃহহীন নারী বা পুরুষ সবার সমান অধিকার ও সম্মান রয়েছে। ইসলামের ভারসাম্যপূর্ণ বিধানে দুর্বলদের জন্য রয়েছে সহজতা ও সহনশীলতা। তাই এমন মানুষ যারা ইসলামের বিধিবিধান পালনে অক্ষম, তাদের ওপর ইসলাম তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী পালনের সুযোগ দিয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আল্লাহ কাউকে তাঁর সাধ্যাতীত কোনো কাজের ভার দেন না।’ (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ২৮৬)। আমাদের উচিত নিজের সচ্ছলতা ও আর্থসামাজিক নিরাপত্তার জন্য আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা এবং ছিন্নমূল, গৃহহীন ও পথশিশু ভাইবোনদের জন্য দোয়া করা। যথাসম্ভব তাদের সাহায্য-সহযোগিতা করা। ছিন্নমূল, গৃহহীন ও পথশিশুদের দেখাশোনা করা সমষ্টিগতভাবে সমাজের সবারই দায়িত্ব।

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা ক্ষুধার্তকে খাদ্য দাও, অসুস্থ ব্যক্তির খোঁজখবর নাও এবং বন্দীকে মুক্ত করে দাও।’ (বুখারি)। ইসলামের নির্দেশনা অনুযায়ী পথশিশুদের সঙ্গে সদাচার করা, তাদের সাহায্য-সহযোগিতা করা আবশ্যক। পথশিশুদের পাশে দাঁড়ানো মানবতার দাবি এবং ইমানি দায়িত্ব। পথশিশুদের সঙ্গে অসদাচরণ বা তাদের উপহাস, ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ বা ঠাট্টা-তামাশা করা আল্লাহকে উপহাস করার শামিল।

মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘সমগ্র সৃষ্টি আল্লাহর পরিজন। আল্লাহর কাছে প্রিয় সৃষ্টি সে, যে তাঁর সৃষ্টির প্রতি সদয় আচরণ করে।’ প্রিয় নবীজি (সা.) আরও বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ক্ষুধার্তকে অন্ন দান করে, আল্লাহ তাকে জান্নাতে ফল খাওয়াবেন। যে তৃষ্ণার্তকে পানি পান করায়, আল্লাহ জান্নাতে তাকে শরবত পান করাবেন। যে কোনো দরিদ্রকে বস্ত্র দান করে, আল্লাহ তাকে জান্নাতে উত্তম পোশাক দান করবেন।’ (তিরমিজি)।

একদা নবীজি (সা.) ঈদের ময়দানে যাচ্ছিলেন। দেখলেন পথের ধারে একটি শিশু কাঁদছে। নবীজি (সা.) তাকে আদর করে কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করলেন। শিশুটি বলল, ‘আমার বাবা-মা নেই, আমি এতিম; আজ এই ঈদের দিনে আমার নতুন জামাকাপড়ও নেই।’ নবীজি (সা.) শিশুটিকে নিয়ে বাড়ি ফিরে গেলেন। হজরত আয়িশা (রা.) কে বললেন, ‘তোমার জন্য একটি ছেলে এনেছি। একে গোসল করিয়ে ভালো পোশাক পরাও।’ শিশুটিকে বললেন, ‘আজ থেকে আয়িশা তোমার মা, ফাতিমা তোমার বোন, আমি তোমার বাবা।’ এভাবেই শিশুটির মুখে হাসি ফুটল। (সীরাতুন নবী সা.)। হাদিস শরিফে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যার পিতা নেই, যে এতিম, আমি তার পিতা। যার অভিভাবক নেই, যে অভিভাবকহীন; আমি তার অভিভাবক। যার আশ্রয়স্থল নেই, আমি তার আশ্রয়স্থল। যার ঘর নেই, আমার ঘরই তার ঘর।’ (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া)।

মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী: বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতির যুগ্ম মহাসচিব ও আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজমের সহকারী অধ্যাপক
[email protected]