কাজের ক্ষেত্রে নারী প্রথা ভাঙছেন

রেলস্টেশনে কফি বিক্রেতা এক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী
রেলস্টেশনে কফি বিক্রেতা এক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী

কোনো দুর্ঘটনা ছাড়া আমাদের রেল তার সময়সীমা মেনে চলছে। এত অনিয়মের মধ্যে রেলের এই নিয়ম আমাদের স্বস্তি দেয়। তাই মানুষ আগের চেয়ে অনেক বেশি রেলনির্ভর হয়েছে। রেল এখনো সরকারের, মানে জনগণের। কিন্তু যাত্রীদের কাছে এখনো ‘সরকারি মাল, দরিয়ামে ঢাল’। লোকজন সিটে বসে চারপাশে বাদামের খোসা ছড়িয়ে, চিপস-বিস্কুটের প্যাকেট ফেলে, এমনকি মুরগির হাড়গোড় পর্যন্ত চিবিয়ে রেখে আসে ট্রেনের বগিতে।
কেউ কেউ গল্প করতে করতে সিটের কভার ছিঁড়তে থাকে। ফেলে রাখা খাবারের গন্ধে আরশোলারা বংশবিস্তার করে চলেছে। নারীকণ্ঠে প্রতি স্টেশনে ঘোষণা শোনা যায় ‘গাড়ি দাঁড়ানো অবস্থায় টয়লেট ব্যবহার থেকে বিরত থাকুন। কিছু ফেলে গেলেন কি না, দেখে নিন।’ কিন্তু একবারও বলেন না ‘দয়া করে গাড়ির মধ্যে খাবারের উচ্ছিষ্ট ফেলবেন না। গাড়িটি আপনার। এর সুরক্ষার দায়িত্বও আপনার।’

এই গৌরচন্দ্রিকার কারণ আছে। ট্রেনের অপেক্ষায় আমরা দুই বোন বিশ্রামাগারে বসে আছি। সেদিনের ট্রেন কোনো কারণে দেরিতে আসবে। প্রথম শ্রেণির বিশ্রামাগারে একটু স্বাচ্ছন্দ্য আশা করতেই পারি। কিন্তু সেখানেও একই চিত্র। একই নোংরামি। তার ওপরে কুলিমজুর–ফেরিওয়ালা–ভিক্ষুক যে যেমন পারছেন কক্ষে ঢুকে টয়লেট ব্যবহার করে চলে যাচ্ছেন। যাচ্ছেন ভালো, কিন্তু কেউ টয়লেটের দরজা বন্ধ করে যাচ্ছেন না।
যথেষ্ট পানি না ঢালার কারণে খোলা দরজা দিয়ে প্রবাহিত দুর্গন্ধ-দূষিত বায়ুর তোড়ে কক্ষে বসে থাকাই দায়। এরই মধ্যে এক ইংরেজি জানা বয়সে তরুণ ভিক্ষুকের প্রবেশ। রোগা পটকা। ঘাড়ে ঝোলা। যথারীতি মুখস্থ গৎবাঁধা ইংরেজিতে বলতে লাগলেন, তিনি শিক্ষিত কিন্তু এক দুর্ঘটনার কারণে এখন আর কর্মক্ষম নেই। তার হাত-পা অচল। পরিবারের ভরণপোষণের জন্য তাঁকে বাধ্য হয়ে ভিক্ষাবৃত্তি বেছে নিতে হয়েছে।

একটু ঝুঁকে হাঁটছিলেন তিনি। কিন্তু লক্ষ করলাম, তাঁর হাত-পা স্বাভাবিক। হাত পাতছিলেন সবার কাছে। প্রত্যুত্তরে কেউ বড় একটা হাত বাড়ালেন না। তিনি ‘অল আর মাইজারস’ বলে কেটে পড়লেন। তিনি বেরিয়ে যেতেই অপেক্ষমাণ যাত্রীরা সমালোচনায় মুখর হলেন। কেউ বললেন ‘এত ভালো ইংরেজি জানে তো একটা চাকরি জোটাতে পারে না?’ কেউ আবার ‘শুধু ইংরেজি জানলেই তো হবে না, আত্মমর্যাদাবোধ থাকা লাগে’ বললেন।
কেউ সরাসরি বলে দিলেন, ‘নেশাখোর! এদের কাজ করার শক্তি আছে?’ কেউ আবার উদারতা দেখিয়ে বললেন, ‘দিলে কিছু দেন, বেশি কথা বলার কী আছে?’ যদিও জাপানি প্রবাদে বলে, ‘এটাই ভিক্ষুকদের অহংকার যে তারা চুরি করে না।’
ট্রেন আসতে আরও খানিক দেরি হবে। চা পেলে বেশ হতো ভাবতে ভাবতেই ‘কফি লাগবে, কফি?’ বলে ঘাড়ে-পিঠে শক্ত করে বেল্ট দিয়ে পুরো একটা কফির দোকান পেটে বেঁধে ঢুকলেন এক তরুণী। অতি সাধারণ সুতির সালোয়ার-কামিজের সঙ্গে পায়ে কেডস। মাথায় লাল রঙের ক্যাপ। মুখে বিনয়ের ছাপ কিন্তু অনুকম্পা প্রার্থনার কোনো চিহ্ন নেই। বলিষ্ঠ আহ্বান।
কফি চাইলাম। মুহূর্তের মধ্যে তাঁর পেটে সাজানো দোকানের বিভিন্ন খোপ থেকে কাপ, দুধ, কফি, চিনি নিয়ে গরম পানি মিশিয়ে কফি পরিবেশন করলেন। একটা ছবি তোলার অনুমতি চাইলাম এবং তাঁকে নিয়ে লেখার আগ্রহ প্রকাশ করলাম। দ্বিধাভরে রাজি হলেন।

ওয়েটিং রুমের প্রায় সবাই কফি খেলেন। এরই মধ্যে তাঁকে ব্যক্তিগত কয়েকটি কথা জিজ্ঞাসা করার লোভ সামলাতে পারলাম না। তিনি উত্তরায় অবস্থিত একটি ইউনিভার্সিটির ছাত্রী। আগে ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসেই কফি বিক্রি করতেন। কিন্তু ক্লাস করা ও ক্লাসের ফাঁকে বিক্রি করে তেমন পোষাচ্ছিল না। কারণ, এ কাজ করেই তাঁকে পড়ার খরচ চালাতে হয়। তিনি বেছে নিলেন রেলস্টেশন। এখানে বিক্রিবাট্টা ভালো। বিকেল ৪টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত একটানা কফি বিক্রি করেন। নারী হয়ে এই নতুন কাজে কোনো অসুবিধা বা কেউ উত্ত্যক্ত করেন কি না, জানতে চাইলে তিনি বললেন, ‘কিছু নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির মানুষ তো আছেনই। কিন্তু বেশির ভাগই ভালো। আমি কোনো কথা গায়ে মাখি না। কাজটা চ্যালেঞ্জিং। আয়ও খারাপ না।’

বিস্ময়ে আর শ্রদ্ধায় আমরা অনেকেই তাঁকে অভিবাদন জানালাম। তিনি অনুরোধ করলেন, কফি পান শেষে সবাই যেন কাগজের কাপগুলো কাছের ডাস্টবিনে ফেলে দিই। যাঁরা তা সত্ত্বেও মেঝের ওপর ফেলে দিচ্ছিলেন, মেয়েটি সেগুলো কুড়িয়ে নিয়ে নিজেই জায়গামতো ফেলে দ্রুত অন্য ভিড়ে পা বাড়ালেন। ভিড়ই যে তাঁর বাণিজ্যে লক্ষ্মী।
জয় হোক শ্রমজীবী নারীর। ইংরেজি ভাষায় বাচ্চাদের লেখাপড়া শেখানোর জন্য অভিভাবকেরা যতই প্রাণান্ত হোন না কেন, ইংরেজি জানা শিক্ষিত ভিক্ষুকদের যে ভাত নেই, তার প্রমাণ পাওয়া গেল। আমাদের সাহসী নারীরা অনেক কটূক্তি উপেক্ষা করেও স্কুটি চালাচ্ছেন, নিজের গাড়ি নিজে চালাচ্ছেন।
তাঁরা বলেন, মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনে সময় লাগে। কিন্তু বিরূপ মন্তব্যের ভয়ে হাল ছেড়ে দিলে উন্নয়ন স্থবির হয়ে পড়বে। তবে কোনো বিশেষ গোষ্ঠী যাতে নারীর প্রথাবিরোধী দক্ষতাকে অন্যায়ভাবে ব্যবহার না করতে পারে, সেদিকেও সজাগ থাকতে হবে। শ্রম বিভাজনের অভিশাপ থেকে মুক্ত হয়ে মানবিক দৃষ্টিগ্রাহ্য হয়ে উঠুক নর-নারীর কাজ। একই সঙ্গে পরিচ্ছন্নতার বোধ আমাদের জাতীয় সম্পদকে দিক সুরক্ষা।

উম্মে মুসলিমা: কবি ও কথাসাহিত্যিক
[email protected]