বিশ্বকাপে চাঙা রাশিয়ার লাভের খাতা

ফুটবল বিশ্বকাপ সামনে রেখে মস্কো সেজেছে বর্ণিল সাজে। নগরের বিপণি বিতানগুলোতে শোভা পাচ্ছে বিশ্বকাপের ব্যানার, ফেস্টুন ও বিজ্ঞাপন বোর্ড। সম্প্রতি মস্কোর আরবাটস্কায়া এলাকা থেকে ছবিটি তুলেছেন মিজানুর রহমান খান
ফুটবল বিশ্বকাপ সামনে রেখে মস্কো সেজেছে বর্ণিল সাজে। নগরের বিপণি বিতানগুলোতে শোভা পাচ্ছে বিশ্বকাপের ব্যানার, ফেস্টুন ও বিজ্ঞাপন বোর্ড। সম্প্রতি মস্কোর আরবাটস্কায়া এলাকা থেকে ছবিটি তুলেছেন মিজানুর রহমান খান
ফুটবল বিশ্বকাপ আয়োজন করে চাঙা রাশিয়ার অর্থনীতি। দর্শকের ঢল সামলাতে তৈরি দেশটা। সাংবাদিকেরা তৈরি সেরা সংবাদ পরিবেশনায়। রাশিয়া থেকে লিখেছেন মিজানুর রহমান খান


প্রতিদিন ২০ লাখ দর্শনার্থীর স্পোর্টস ওয়েবসাইট চ্যাম্পিয়নেটডটকম। এই সাইটের এক্সক্লুসিভ নিউজ সার্ভিসের প্রধান ইভান কারপভ একজন ফুটবল বিশেষজ্ঞ। ১৩ বছর ধরে শুধু ফুটবলই লিখছেন। মালি গিনিয়েজনিকোভস্কি পেরিলিকের একটি বারে তাঁর সঙ্গে কয়েক ঘণ্টা আড্ডা হলো। ফুটবলে বাংলাদেশের প্রেস ও মানুষের বিরাট আগ্রহ জেনে ইভান তাঁর ছানাবড়া চোখ নিয়ে খ্যাতির শিখরে থাকা মস্কোর কিছু বড় ফুটবল কলামিস্টের কাছে আমার আগমনবার্তা ডিজিটালি রটিয়ে দিলেন। এমনকি তাঁর উৎসাহের আতিশয্যে আমাকে ভিডিও শুভেচ্ছাবাণী দিতে হলো ইউরি দুদকে। দুদ রাশিয়ার বৈচিত্র্যপূর্ণ সমাজব্যবস্থার এক জীবন্ত প্রতীক। ইউক্রেনীয় বংশোদ্ভূত বলে তাঁর গায়ে একরত্তি বৈষম্যের ছিটে লাগেনি। ৩১ বছর বয়সী এই তরুণের নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেলের শ্রোতা ৩২ কোটি (আমাদের জনসংখ্যার দ্বিগুণ) ছাড়িয়েছে। বর্তমানে শীর্ষস্থানীয় রুশ স্পোর্টসডটরু এর প্রধান সম্পাদক। ইউরি হরদম উদ্ধৃত হন পশ্চিমা মিডিয়ায়। দুদ গাড়ি চালাতে চালাতেই আমাকে তাঁর ‘বাংলাদেশি কলিগ’ হিসেবে ভিডিও শুভেচ্ছা পাঠালেন। ইভানের কথায়, প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন যদিও একজন হকিভক্ত, কিন্তু তিনি বিশ্বকাপ সফল করতে বড় প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন ব্যক্তিগতভাবে তদারকি করেছেন। 

বিশ্বকাপ সামনে রেখে নবরূপে সাজছে মস্কো। মস্কোর সবচেয়ে বড় বইয়ের দোকানটি বিশ্বকাপের ডিজিটাল ডিসপ্লেতে ঝলমল করে। পানীয় ও নানা পণ্যদ্রব্যে স্মারক-স্টিকার যুক্ত হতে শুরু করছে। গত কয়েক দিনে বিশ্বকাপ ফুটবলের প্রস্তুতি কমিটির সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তা এবং মস্কোর শীর্ষস্থানীয় ফুটবলবিষয়ক সাংবাদিকের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে মনে হয়েছে, ক্রিমিয়া ইস্যুতে নিষেধাজ্ঞা, লন্ডনে গ্যাস হামলা কিংবা সিরীয় পরিস্থিতি নিয়ে রুশ ফেডারেশনের সঙ্গে বহির্বিশ্বের টানাপোড়েন, যা কিছুই চলমান থাকুক না কেন, আগামী জুন থেকে শুরু হওয়া ধরিত্রীর শ্রেষ্ঠতম প্রদর্শনীর জন্য রাশিয়ায় সাজ সাজ রব পড়ে গেছে। প্রায় ৫ লাখ ফুটবলপ্রেমী বিদেশি অতিথিকে বরণ করতে রাশিয়ার অবকাঠামোগত প্রস্তুতি এখন শেষ পর্যায়ে।
কয়েক বিলিয়ন পাঠক-শ্রোতা রয়েছে, এমন কয়েকটি সংবাদমাধ্যমের দপ্তর পরিদর্শনে গিয়ে দেখা গেছে, প্রযুক্তির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করে কী করে বিশ্বকাপকে সব থেকে কার্যকরভাবে বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরা যায়, তার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা চলছে। বিশ্বকাপের প্রভাব নানা ক্ষেত্রে কী প্রভাব ফেলবে, তা নিয়ে সরকারি-বেসরকারি নানা রুশ সংস্থা অবশ্য পুরোদমে কাজ করছে ২০১০ সাল থেকেই। রুশ অর্থনীতির ওপর অনেক আগে থেকেই প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। অর্থনীতি, সমাজ ও পরিবেশের ওপর কী প্রভাব পড়বে, তার ওপর বিশ্বকাপ সাংগঠনিক কমিটির প্রধান অ্যালেক্সি সরোকিনের নেতৃত্বাধীন বিশ্বকাপের মূল সাংগঠনিক কমিটি একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রস্তুত করেছে। সরোকিন রুশ বিশ্বকাপ ফুটবল প্রস্তুতির ১ নম্বর কর্তাব্যক্তি। ইভানের মাধ্যমেই ২৭ এপ্রিল রাতে সরোকিন প্রথম আলোকে একটি লিখিত সাক্ষাৎকার দিতে রাজি হয়েছেন। তবে বিশ্বকাপের প্রস্তুতি বিষয়ে ২৮ এপ্রিল রাশিয়ার শীর্ষস্থানীয় ক্রীড়াবিষয়ক দৈনিক মুদ্রণ পত্রিকা স্পোর্টস এক্সপ্রেসকে দেওয়া তাঁর একটি সাক্ষাৎকার চোখে পড়ল। বিশ্বকাপের সাংগঠনিক কমিটির প্রধান অ্যালেক্সি সরোকিন বলেছেন, ৫ লাখ বিদেশি বিশ্বকাপ দেখতে রাশিয়ায় আসবেন। চূড়ান্ত প্রস্তুতির জন্য দরকার ৫০ দিন, আর আমাদের হাতে এখন সেই সময়টুকুই অবশিষ্ট আছে। মস্কোর বিখ্যাত রেডস্কয়ারে বিশেষভাবে নির্মিত হয়েছে ঝলমলে কালগণনাস্তম্ভ। দিন-রাতে এর সামনে নানা বয়সের মানুষ ছবি কি সেলফি তুলছে।
রাশিয়ার ১১ টি শহরে খেলা হবে। বহু শহর রয়েছে, যারা বছরে যা আয় করে, এবার এক মাসে সেটা আয় করবে। পাভেল গিউরিভিচ একজন স্বনামধন্য ক্রীড়া সাংবাদিক। স্পোর্টস এক্সপ্রেসের পক্ষে সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে সরোকিনের কাছে তাঁর প্রশ্ন ছিল, জার্মান ফুটবল-গুন্ডারা কি আসবে না? সোরোকিনের উত্তর: জার্মানির প্রকৃত ভক্তরাই শুধু আসবে। কারা অনুরাগী নয়, তাদের তথ্য আমাদের হাতে রয়েছে। কোনো বিশেষ দেশ বলে কথা নয়, বিশ্ব নিরাপত্তা-ব্যবস্থাগুলোর মধ্যে ইতিমধ্যেই নিবিড় যোগাযোগ স্থাপন করা হয়েছে। আর স্টেডিয়ামের দর্শকদের জন্য পালনীয় আচরণবিধির খসড়া চূড়ান্ত করার কাজ চলছে। এতে কী কী বিষয় নিষিদ্ধ থাকবে, তারও তালিকা থাকবে। নবনির্মিতসহ সব স্টেডিয়াম খেলার জন্য হস্তান্তর করা হয়েছে।
ওই গবেষণা রিপোর্টটি কিন্তু বলেছে, ২০১৩ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে রুশ অর্থনীতিতে বিশ্বকাপের প্রভাব ৮৬৭ বিলিয়ন রুবল আশা করা হচ্ছে। এই সময়ে ২ লাখ ২০ হাজার কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করবে। প্রতিবছর (২০১৩-২০২০) জিডিপির ওপর গড় প্রভাব দেড় শ থেকে ২১০ বিলিয়ন রুবল হবে বলেও অনুমান করা হচ্ছে। আর বিশ্বকাপের প্রস্তুতি নিতে গিয়ে যে ধরনের কর্মযজ্ঞ চলেছে এবং চলমান রয়েছে, তাতে কেন্দ্রীয় সরকার ও আঞ্চলিক সরকারগুলো কতটা অতিরিক্ত কর আদায় করতে পারছে, তার অঙ্কটাও নেহাত খাটো নয়। ৫ বছরে (২০১৩-২০১৭) অতিরিক্ত কর সংগ্রহ বিবেচনায় নিয়ে চলতি বছরের শেষে এই অতিরিক্ত করের প্রকৃত আদায় দাঁড়াবে ১৫০ বিলিয়ন রুবল। ২৫ এপ্রিল রুশ উপপ্রধানমন্ত্রী আর্কদি দেভোরকোভিচ এক ব্রিফিংয়ে বলেন, বিশ্বকাপই এই মুহূর্তে রাশিয়ার সব ধরনের আর্থিক প্রবৃদ্ধির প্রাণশক্তি। বিশ্বকাপ ছাড়া রাশিয়া এখন প্রবৃদ্ধির স্ফীতি দেখতে পেত না। দুই বছর নিম্নমুখী থাকার পর এবং পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা ও তেলের দাম বৃদ্ধি পাওয়া সত্ত্বেও রুশ অর্থনীতি বিশ্বকাপের কারণে গত বছর দেড় শতাংশ প্রবৃদ্ধি প্রত্যক্ষ করেছে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক অর্থনীতি কিছুটা চাঙা হওয়ার কথা স্বীকার করলেও সতর্ক করেছে যে, ভোগ্যপণ্যের দাম বেড়ে যেতে পারে। বিশ্বকাপ উপলক্ষে হোটেলের ভাড়া ৫ হাজার গুণ পর্যন্ত বেড়ে গেছে।
সরোকিন আশাবাদী যে সব টিকিটই বিক্রি হয়ে যাবে। নির্দিষ্ট পরিমাণ আসন থাকলেও প্রতি স্টেডিয়ামে কিছু টিকিট তাঁরা হাতে রেখেছেন। কৃষ্ণ সাগর তীরবর্তী উত্তর কাফকাজ প্রদেশের ক্রাসনাদার অঞ্চলের নয়নাভিরাম পর্যটন নগরী শচির ‘ফিস্ট’ স্টেডিয়ামে এ রকম ১২০০ সংরক্ষিত আসন রয়েছে। রুশ জাতীয় ফুটবল দলে যদিও বেশির ভাগ মস্কোকেন্দ্রিক তারকায় ঠাসা। কিন্তু তার পরও ফুটবল নিয়ে রুশ আন্তপ্রদেশে চাপানউতোর থেমে নেই। ভলগা নদীতীরবর্তী সামারস্কাইয়া প্রদেশটি সোভিয়েত আমলের ফুটবল নগরী হিসেবে পরিচিত ছিল। এই প্রদেশের শক্তিশালী ফুটবল দলের নাম ছিল সোভিয়েতের ডানা, এখনো তা-ই আছে। সামারা নগরীর ভারপ্রাপ্ত গভর্নর দিমিত্রি আজারভ বলেছেন, সামারার ফুটবল অন্যান্য অঞ্চলকে ঈর্ষান্বিত করে তুলেছে।
এদিকে মস্কো টাইমস তাসের বরাতে ২৭ এপ্রিল এক প্রতিবেদনে বলেছে, বিশ্বকাপ সামনে রেখে রুশ অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সংস্থা এফএসবি শুক্রবার বলেছে, তারা আইএসের কিছু উচ্চ মাপের সন্ত্রাসী হামলা পরিচালনার একটি পরিকল্পনা নস্যাৎ করেছে। এটা সাইবেরিয়ার একটি সিলিপারি সেলের কাজ বলে জানিয়েছে এফএসবি। এই সংস্থাটি গত বছর ১৮টি এবং এ বছর ৬টি সন্ত্রাসী পরিকল্পনা নস্যাৎ করেছে। রুশ পাতাল রেলস্টেশনে প্রশিক্ষিত কুকুর নিয়ে পুলিশের চৌকস টহল ও কোথাও তল্লাশি নজরে পড়েছে।