আখিরাতে বিশ্বাস সত্কর্মের অনুপ্রেরণা

মানব জীবনে তাওহিদ, রিসালাত ও আখিরাতে বিশ্বাস
মানব জীবনে তাওহিদ, রিসালাত ও আখিরাতে বিশ্বাস

ধর্মের মূল হলো বিশ্বাস, আশা ও ভালোবাসা। বিশ্বাস মানুষের জীবনের মূল চালিকাশক্তি। বিশ্বাসই মানুষের সব কর্মকাণ্ডের মূল নিয়ন্তা।

বিশ্বাসের মৌলিক বিষয় তিনটি। যথা:

  • তাওহিদ বা আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাস,

  • রিসালাত তথা নবী-রাসুলদের প্রতি বিশ্বাস ও

  • আখিরাত অর্থাৎ পরকালের প্রতি বিশ্বাস।

আখিরাত বা পরকালের প্রতি বিশ্বাসই মানুষকে সৎকর্মে অনুপ্রেরণা জোগায়। পরকালে বিশ্বাস মানে হলো মৃত্যুর পর পুনরায় অনন্ত জীবন লাভ করা। এই জীবনের সকল কর্মের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার ও যথাযথ ভালো বা মন্দ ফল প্রাপ্তি এবং পরিণাম হিসেবে জান্নাত ও জাহান্নাম ভোগ করা। বিশ্বাসীদের পঞ্চ বৈশিষ্ট্যের অন্যতম হলো আখিরাত বা পরকালের প্রতি বিশ্বাস।

মানবজীবন পরিক্রমা চারটি জগতে পরিব্যাপ্ত। যথা:

  • আলমে আরওয়াহ,

  • আলমে দুনিয়া,

  • আলমে বারজাখ ও

  • আলমে আখিরাত।

মানুষ হলো রুহ, নফস ও দেহের সম্মিলিত রূপ। আলমে আরওয়াহ বা রুহের জগতে শুধু রুহ ছিল, সঙ্গে ছিল নফস। এটি মানবজীবন চক্রের প্রথম জগৎ। আলমে দুনিয়া বা দুনিয়ার জগতে রুহ ও নফসের সঙ্গে দেহ বা শরীর যোগ হয়েছে, মৃত্যুর মাধ্যমে এই জগতের পরিসমাপ্তি হবে। এটি মানবজীবন চক্রের দ্বিতীয় জগৎ।

মৃত্যুর মাধ্যমে রুহ ও নফস দেহ ছেড়ে আলমে বারজাখে পাড়ি দেয়। এটি হলো ব্যক্তির কিয়ামত বা ব্যক্তির জাগতিক জীবনের পরিসমাপ্তি।

হাদিস শরিফে রয়েছে, ‘যখন কারও মৃত্যু হয়, তখন তার কিয়ামত সংঘটিত হয়।’ আলমে বারজাখ বা বারজাখ জগতে (মৃত্যুর পর থেকে কিয়ামত তথা হাশর-নশরের পূর্ব পর্যন্ত সময়ে) রুহ ও নফস ইল্লিন বা ছিজ্জিনে অবস্থান করবে এবং দেহ হয়তো বিলীন হয়ে যাবে, নয়তো সুরক্ষিত থাকবে। দ্বিতীয় কিয়ামত তথা শিঙায় প্রথম ফুত্কারে বড় কিয়ামত তথা সমগ্র সৃষ্টিকুলের প্রলয় বা ধ্বংস সংঘটিত হবে।

কোরআন কারিমে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘এ জগতে যা কিছু আছে সবই লয়প্রাপ্ত হবে, শুধু আপনার রবের অস্তিত্বই টিকে থাকবে।’ (সুরা-৫৫ আর রহমান, আয়াত: ২৬-২৭)। মৃত্যু বা প্রথম কিয়ামতের পর থেকে এবং দ্বিতীয় কিয়ামত বা শিঙায় প্রথম ফুত্কারের পর থেকে পুনরুত্থান পর্যন্ত আলমে বারজাখ বা বারজাখ জীবন। এটি মানবজীবন চক্রের তৃতীয় জগৎ। তৃতীয় কিয়ামত, অর্থাৎ শিঙায় দ্বিতীয় ফুত্কারের পর হাশর ও নশর তথা পুনরুত্থান ও মহামিলন বা মহাসম্মিলন অনুষ্ঠিত হবে। এটিই চূড়ান্ত কিয়ামত। এই দিনই বিচারের দিন এবং আখিরাত বা পরকালের অনন্ত জীবনের সূচনা এদিন থেকেই হবে, যে জীবনের আর কোনো শেষ নেই, নেই কোনো সীমা। এটি মানবজীবন চক্রের চতুর্থ বা শেষ জগৎ। এই জগতের কোনো পরিসমাপ্তি নেই।

আখের অর্থ শেষ বা চূড়ান্ত। আখিরাত মানে পরকাল বা ভবিষ্যত্কাল ও অনাগতকাল। আখিরাত বা পরকালীন জীবনের প্রতি বিশ্বাস মানবজীবনাচার সুসংযত ও সুসংহত করে। কারণ, এর সঙ্গে বিচার ও কর্মফল জড়িত। জান্নাত-জাহান্নাম এরই সঙ্গে সম্পর্কিত। বলতে গেলে পরকালে বিশ্বাসই ইমানের তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়। হাদিস শরিফে রয়েছে, ‘ইমান আশা ও ভয়ের মধ্যে অবস্থান করে।’ আর আশা ও ভয় হলো পরকালের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিষয়।

আশা মানুষকে সৎকর্মে উদ্বুদ্ধ করে, ভয় মানুষকে অন্যায় কর্ম থেকে বিরত রাখে। আশা না থাকলে ইহকালীন ও পরকালীন কোনো উন্নতিই সম্ভবপর নয়; ভয় না থাকলে সংযম ও সংযত আচরণ অসম্ভব প্রায়। আখিরাত সম্পর্কে কোরআনে বহু আয়াত রয়েছে। যেমন: ‘আর অবশ্যই আপনার জন্য প্রথম জগৎ দুনিয়া অপেক্ষা আখিরাতই উত্তম বা শ্রেয়। অচিরেই আপনার রব আপনাকে দান করবেন, যাতে আপনি সন্তুষ্ট হয়ে যাবেন।’ (সুরা-৯৩, ওয়াদ-দুহা, আয়াত: ৪-৫)।

মোমিন হলো দুনিয়াতে পরবাসী। আখিরাত বা পরকাল হলো মোমিন বা বিশ্বাসীদের আপন বাড়ি। আল্লাহ তাআলা আদি পিতা-মাতা হজরত আদম (আ.) ও হজরত হাওয়া (আ.)-কে সৃষ্টি করে জান্নাতেই রেখেছিলেন। কুদরতের হেকমতে বা কৌশলগত কারণে দুনিয়ায় প্রেরণ করেছেন। আর বলে দিয়েছেন, তোমরা আমার হিদায়াত ও পথনির্দেশ অনুসরণ করলে আবার এখানেই ফিরে আসবে। আল্লাহ তাআলা মহানবী হজরত মুহাম্মাদ (সা.)-কে মিরাজ রজনীতে এই জান্নাত দেখিয়ে এনেছেন, যাতে তিনি উম্মতকে এ বিষয়ে জানাতে পারেন। জান্নাত বা পরকালের আটটি বাড়ি হচ্ছে জান্নাতুল ফিরদাউস, জান্নাতুল মাওয়া, জান্নাতুল আদন, দারুন নাঈম, দারুস সালাম, দারুল কারার, দারুল মাকাম বা দারুল মুকাম, দারুল খুলদ।

দুনিয়ায় মানুষ হলো প্রবাসী বা পরবাসী। প্রবাসকালীন জীবনে প্রবাসী সব সময় আপন বাড়ির স্মরণ করে। এই স্মরণই তাকে উপার্জনে ও সঞ্চয়ে উৎসাহিত করে; কষ্টসহিষ্ণু, সংযমী ও আত্মপ্রত্যয়ী করে তোলে। এভাবেই প্রবাসজীবন শেষে একটি স্থিতিশীল, সুখী, সমৃদ্ধিশালী ও স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবনযাপনে সক্ষমতা লাভ করে।

পরকালীন নিবাস সম্পর্কে কোরআন কারিমে বহু আয়াত রয়েছে। যেমন: ‘হে রাসুল (সা.), আপনি বলুন! হে আমার জাতি, তোমরা তোমাদের অবস্থান থেকে সামর্থ্যমতো সৎকর্ম করো, আমিও করছি; অচিরেই তোমরা জানতে পারবে পরিণতির শুভ নিবাস কাদের জন্য।’ (সুরা-৬ আনআম, আয়াত: ১৩৫)। ‘তোমাদের প্রতি শান্তি! যেহেতু তোমরা ধৈর্য ধারণ করেছ, পরিণতি জান্নাতের বাড়ি কত না উত্তম। (সুরা-১৩ রাআদ, আয়াত: ২৪)। ‘যারা সৎকর্ম করবে, তারা দুনিয়াতেও কল্যাণ লাভ করবে, পরকালের নিবাস অতি উত্তম; মুত্তাকিদের নিবাস কত না উত্তম।’ (সুরা-১৬ নাহল, আয়াত: ৩০)। ‘নিশ্চয়ই পরকালের নিবাস চিরস্থায়ী, যদি তারা জানত।’ (সুরা-২৯ আনকাবুত, আয়াত: ৬৪)। ‘নিশ্চয়ই আখিরাত হলো স্থিতিশীল স্থায়ী নিবাস।’ (সুরা-৪০ মোমিন, আয়াত: ৩৯)।

যারা দুনিয়াতে এসে আপন নিবাস জান্নাতের কথা ভুলে গিয়ে অসংযত ও অন্যায় আচরণ করবে, তারা জাহান্নাম বা দোজখে যাবে। সাতটি দোজখের নাম হলো জাহান্নাম, হাবিয়াহ, জাহিম, ছাকার, ছায়ির, হুতামাহ, লাজা। উল্লেখ্য যে আটটি বেহেশতের প্রথম তিনটির নামের শুরুতে রয়েছে ‘জান্নাত’ বা বাগানবাড়ি, অবশিষ্ট পাঁচটির শুরুতে রয়েছে ‘দার’ অর্থাৎ বাড়ি। কিন্তু সাতটি দোজখের নামের শুরুতে এর কোনোটিই নেই। আল্লাহ আমাদের দোজখের আজাব থেকে রক্ষা করুন।

মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী: বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতির যুগ্ম মহাসচিব ও আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজমের সহকারী অধ্যাপক
[email protected]