বাজেটেই চাই বৈষম্য দূর করার প্রতিফলন

আমরা যখন ছোট, তখন শুনতাম কুড়িগ্রাম বাংলাদেশের সবচেয়ে গরিব জেলা। বড় হওয়ার পরও একই কথা শুনছি। আগে রাজশাহী ছিল বাংলাদেশের সবচেয়ে গরিব বিভাগ। তখন রংপুর, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, নীলফামারী, লালমনিরহাট—এসব জেলা ছিল রাজশাহী বিভাগের অন্তর্গত।আটটি জেলা নিয়ে যখন রাজশাহী থেকে আলাদা হয়ে রংপুর বিভাগ গঠিত হলো, তখন রংপুর সবচেয়ে গরিব বিভাগ।

গত বছর পঞ্চগড়ে বেড়াতে গিয়েছিলাম। সেখানে নজরুল গ্রন্থাগারে গিয়েছিলাম বইয়ের সংগ্রহ কী রকম, তা দেখার জন্য। গিয়ে দেখি সেখানে একটি অনুষ্ঠান হচ্ছে। একজন বক্তা উত্তরের অর্থনীতি নিয়ে বলতে গিয়ে কয়েকবার বলেছেন, কুড়িগ্রাম বাংলাদেশের সবচেয়ে গরিব জেলা। বারবার ওই বক্তার কাছে এ কথা শুনে আমার ছোট্ট ছেলে ঐক্য ভীষণ মন খারাপ করেছিল। নিজের জেলার প্রতি এই অপবাদ সে মেনে নিতে পারছিল না।

আর্দ্র চোখে বলেছিল, ‘বাবা, ওরা আমাদের জেলাকে সবচেয়ে গরিব বলছে কেন? চলো, এখানে থাকব না।’ শুধু আমার ছেলেই নয়, রংপুর বিভাগের একজনেরও এ কথা শুনতে ভালো লাগে না। কিন্তু রংপুর বিভাগের মানুষের এই কষ্ট দূরীকরণে সরকারের কোনো বিশেষ উদ্যোগ চোখে পড়ে না।

যে আটটি জেলা বাংলাদেশে সবচেয়ে গরিব জেলা হিসেবে পরিচিত, তার পাঁচটিই রংপুর বিভাগে। এগুলো হচ্ছে কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, গাইবান্ধা, রংপুর ও দিনাজপুর। এ ছাড়া এই বিভাগের বাকি তিনটি জেলার অবস্থাও তেমন উন্নত নয়। দেশ এগিয়েছে, এগিয়েছে এই বিভাগের অর্থনীতিও। কিন্তু সেই উন্নয়ন দেশের অন্যান্য বিভাগ কিংবা জেলার মতো নয়। এই বৈষম্য অনেক বেশি।

ন্যাশনাল সার্ভিস কিংবা ১০ টাকা কেজি চালের উদ্বোধন কুড়িগ্রাম থেকে হয়েছে। এটা বৈষম্য দূরীকরণের কোনো পদক্ষেপ নয়। রংপুর বিভাগ থেকে মঙ্গা দূর হয়েছে। এই মঙ্গা দূরীকরণে সরকারিভাবে কখনো কার্যকর কিছু করা হয়নি। রংপুরের মানুষ নিজেরাই তাদের নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনে সচেষ্ট হয়েছে। অনেক রাজনীতিককে বলতে শুনেছি, রংপুর বিভাগে আর সেই অভাব নেই।

যাঁরা এ কথা বলেন, তাঁরা মূলত বৈষম্য আর মঙ্গা যে এক নয়, সেটি বুঝতে পারেন না। রাষ্ট্রীয়ভাবে  কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে এই বৈষম্য দূর করা সম্ভব নয়। প্রথম আলো ২০০৪, ২০০৫ ও ২০০৬ সালে যথাক্রমে ‘মঙ্গা মোকাবিলায় আমাদের করণীয়’, ‘মঙ্গা দূরীকরণের পথ কী’ এবং ‘মঙ্গা মোকাবিলা কত দূর’ শীর্ষক তিনটি গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করেছিল। এখন প্রয়োজন উন্নয়নবৈষম্য দূরীকরণ বিষয়ক গোলটেবিল বৈঠক।

এ বছরের বাজেট বর্তমান সরকারের টানা দ্বিতীয় মেয়াদের শেষ বাজেট। নির্বাচনকে মাথায় রেখে যে এ বছরের বাজেট হবে, তা অনুমান করা যায়। আমাদের রংপুর বিভাগের লোকজনের চাওয়া—বাজেটে উন্নয়নবৈষম্য দূর করার বিষয়টি গুরুত্ব পাক।

বাজেট প্রণয়নে যাঁরা মুখ্য ভূমিকা পালন করেন, তাঁদের প্রতি অনুরোধ, বাংলাদেশে এ পর্যন্ত যতবার উন্নয়ন নিয়ে দেশি-বিদেশি পরিসংখ্যান প্রকাশ করা হয়েছে, সেগুলো পর্যালোচনা করুন। আর রংপুর বিভাগসহ দেশের যে কয়টা জেলার অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই খারাপ, সেগুলোতে গিয়ে খবর নিন। তারপর বাজেটের খাত চিহ্নিত করুন।

দেশ স্বাধীন হওয়ার প্রায় অর্ধশত বছর হলো। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি তিন প্রধান দলই দেশ পরিচালনা করেছে। বাম সংগঠনেরও অনেকেই জোট সরকারে থাকার সুযোগ নিয়েছেন।

এসব দলের সবাই উন্নয়নবৈষম্য দূরীকরণ নিয়ে দৃষ্টান্তমূলক কোনো ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়েছেন। এটা বিস্ময়কর যে একটি জেলা, একটি বিভাগ দিনের পর দিন, যুগের পর যুগ অবহেলিত হয়ে আছে কিন্তু কারও যেন কোনো দায় নেই।

বাংলাদেশ যতই উন্নয়নের পথে হাঁটছে, ততই উন্নয়নবৈষম্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর প্রধান কারণই হচ্ছে আমাদের দেশে অঞ্চলনিরপেক্ষ রাজনীতিকের
অভাব। যাঁরা রাজনীতির চালিকাশক্তি, তাঁরা নিজ নিজ অঞ্চল উন্নয়নের কাজে ব্যস্ত থাকেন; সারা দেশের উন্নয়নের কথা তাঁরা ভাবেন না। ফলে বৈষম্য দিনের পর দিন বাড়ছেই।

সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় রংপুরকে আলাদাভাবে বিভাগ হিসেবেই দেখানো হয়নি। এর কী জবাব আছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের কাছে।

১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম লক্ষ্য ছিল বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ার। অথচ উন্নয়নবৈষম্য দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে। রংপুরের আঞ্চলিক ভাষায় বলা হয়, ‘ছাওয়া না কান্দলে মাও দুধ দেয় না।’ দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের সাংসদেরা জনগণের কান্না সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তাব্যক্তিদের কাছে পৌঁছে দিতে পারছেন না।

সে কারণে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছেই রংপুর বিভাগের উন্নয়নবৈষম্য দূরীকরণের উদ্যোগ নেওয়ার এবং বাজেটে যাতে এর প্রতিফলন থাকে, তা নিশ্চিত করার অনুরোধ জানাই। 

তুহিন ওয়াদুদ রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক এবং রিভারাইন পিপল–এর পরিচালক