কোচ নিয়ে ক্রিকেট-ফুটবল একই সমতলে

বিসিবি ও বাফুফেকে বড় সমস্যায় ফেলে গেছেন দুই কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে ও অ্যান্ড্রু ওর্ড
বিসিবি ও বাফুফেকে বড় সমস্যায় ফেলে গেছেন দুই কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে ও অ্যান্ড্রু ওর্ড

লোকে বলে, বাংলাদেশের প্রধানতম দুটি খেলার যাত্রা উল্টোমুখী। ক্রিকেট যখন জনপ্রিয়তায় আর প্রভাবে ধেই ধেই করে মগডালে চড়ে বসেছে, ফুটবল পেছাতে পেছাতে যেন মাটির কাছাকাছি।

কিন্তু ক্রিকেট আর ফুটবল এখন একই সমতলে এসে দাঁড়িয়েছে। দুটি খেলাকে একই বিন্দুতে মিলিয়ে দিয়েছে প্রধান কোচের বিষয়টি। বাংলাদেশ ক্রিকেট দলে প্রধান কোচ নেই আট মাস ধরে। দুমাস হলো জাতীয় ফুটবল দলে কোচ নেই। কোচ নিয়ে বড় সমস্যায় পড়েছে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) ও বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে)। সমস্যা, কারণ ক্রিকেট-ফুটবল দুটি খেলাতেই বাংলাদেশের আগামী আন্তর্জাতিক সূচিটা খুব ব্যস্ত। এ অবস্থায় প্রধান কোচ না থাকা মানে বাংলাদেশ দলের দশা হয়ে পড়বে হাল ভাঙা নৌকার মতো।

আগামী মাসের শুরুর দিকে ভারতের দেরাদুনে আফগানিস্তানের সঙ্গে টি-টোয়েন্টি সিরিজ। শেষ দিকে পূর্ণাঙ্গ ক্রিকেট সিরিজ খেলতে যেতে হবে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। কিন্তু চণ্ডিকা হাথুরুসিংহের ছেড়ে যাওয়া প্রধান কোচের পদটা এখনো শূন্য! গত অক্টোবরে হাথুরুসিংহের আকস্মিক বিদায়ের পর এ পর্যন্ত দুটি সিরিজ প্রধান কোচ ছাড়াই খেলেছে বাংলাদেশ। জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে ত্রিদেশীয় ওয়ানডে সিরিজ ও শ্রীলঙ্কার সঙ্গে ক্রিকেট সিরিজে ঠেকা কাজ চালিয়েছেন বিসিবি পরিচালক খালেদ মাহমুদ। এমনিতে ঘরোয়া ক্রিকেটে বিভিন্ন ক্লাব দলের কোচ হিসেবে কাজ করলেও মাহমুদ মূলত বাংলাদেশ দলে এর আগে যুক্ত ছিলেন ম্যানেজার হিসেবে। সেই তিনিই নতুন পরিচয়ে কাজ করেন বাংলাদেশ দল নিয়ে। পদটির পোশাকি নাম ছিল টিম ডিরেক্টর। ঠিক যে ভূমিকায় ভারতীয় দলে রবি শাস্ত্রীকে কাজ করতে দেখেছে ক্রিকেট বিশ্ব।

ঘরের মাঠে মাহমুদ নতুন ভূমিকায় শুরু করেছিলেন আশা জাগিয়ে। ত্রিদেশীয় সিরিজের প্রথম তিন ম্যাচে বিশাল জয়ের পর শেষ পর্যন্ত তাঁর হাত ধরে বাংলাদেশ দল রীতিমতো হাবুডুবু খেল শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে। এরপর আর তাঁর হাতে দল তুলে দেওয়ার দুঃসাহস দেখাতে পারেনি বিসিবি অবশ্যম্ভাবী পরিবর্তনটা হলো পরের টুর্নামেন্টেই। মার্চে শ্রীলঙ্কায় অনুষ্ঠিত ত্রিদেশীয় নিদাহাস ট্রফি টি-টোয়েন্টিতে অন্তর্বর্তীকালীন প্রধান কোচের দায়িত্ব দেওয়া হয় কোর্টনি ওয়ালশকে। সাবেক ক্যারিবীয় ফাস্ট বোলার অন্তর্মুখী স্বভাবের নিপাট ভদ্রলোক। কোচের কাজ তো শুধুই খেলোয়াড়দের দক্ষতা বাড়ানো কিংবা ভালো খেলতে উদ্বুদ্ধ করা নয়। তাঁকে পরিস্থিতি অনুযায়ী ক্ষুরধার কৌশল সাজাতে হয়। খেলোয়াড়দের শৃঙ্খলার দিকটিও দেখতে হয় কঠোর অভিভাবকত্বে। ওয়ালশ কতটা কী করতে পারেন, তা নিয়ে ছিল সংশয়। তবে ভালো নম্বর নিয়েই উতরে গেলেন তিনি। স্বাগতিক শ্রীলঙ্কাকে দুই ম্যাচে হারিয়ে ফাইনালে উঠল দল। শিরোপা জয়ের স্বপ্নটা ভাঙল ফাইনালের শেষ বলের ছক্কায়। ভেঙে দিল আসলে ভারতীয় ব্যাটসম্যান দিনেশ কার্তিকের ‘অতিপ্রাকৃত ব্যাটিং’। না হলে দায়িত্বের প্রথম প্রহরে ছক্কাটা তো হয় ওয়ালশেরই!

অভিযান সফল হলেও ওয়ালশকে নিয়ে আর বেশি দূর ভাবেনি বিসিবি। তবে বাস্তবতা হলো তাঁকেই হয়তো আবার দায়িত্ব নিতে হবে। প্রধান কোচই যে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। দিকে দিকে এত কোচের নাম ছড়িয়ে পড়ল, এখন দেখা যাচ্ছে সব ফক্কিকার। গ্যারি কারস্টেন, মাইকেল বেভান, অনিল কুম্বলে, রিচার্ড পাইবাস—কত বড় বড় সব নাম। বিসিবির সভাপতি বারবার বলেছেন, এই তো নতুন কোচ এল বলে! কিন্তু বারবার বলতে বলতে সম্ভবত তিনি ক্লান্ত। এখন আর মুখে কথা নেই।

শোনা যায়, বিসিবির সভাপতি আর প্রধান নির্বাহী ছাড়া আর কেউ জানে না বাংলাদেশের পরবর্তী প্রধান কোচ কে হচ্ছেন। রসিকতা করে অনেকে এমনও বলছেন, কোচ নিজেও হয়তো জানেন না তিনিই বাংলাদেশ দলের দায়িত্ব নিতে যাচ্ছেন কি না। আসল ব্যাপারটা হলো বিশ্বব্যাপী টি-টোয়েন্টি লিগের এই রমরমা সময়ে দীর্ঘমেয়াদি পেশাদার কোচ পাওয়াটা খুব কঠিন। আইপিএল-বিগ ব্যাশ-বিপিএলে অল্প সময়ে সামান্য কাজ করে থলেভর্তি টাকা যখন পাওয়া যায়, তখন আর সারাটা বছর কেন নিয়মের নিগড়ে বাঁধা পড়তে চাইবেন কোন ক্রিকেট কোচ?

আরেকটা ব্যাপার হলো শুধু টাকাই তো সব নয়, পশ্চিমা কোচদের অবসর বিনোদনেরও সুযোগ থাকতে হবে। বাংলাদেশে তা কোথায়? শুধু কাজ কাজ আর কাজ। তারপর মুখ বুজে নিজের ঘরের মধ্যে সেঁধিয়ে থাকা।

ফুটবল ফেডারেশনের এক কর্মকর্তা এটিকে বিদেশি কোচ না টেকার বড় কারণ দেখিয়ে বললেন, জাতীয় দল ব্যবস্থাপনা কমিটি দুজন ইউরোপীয় কোচের বায়োডাটা মেমোরি কার্ডে নিয়ে ঘুরছেন। আগামী সপ্তাহেই কিছু একটা হয়ে যাবে।

গত তিন বছরে পাঁচজন কোচ পেয়েছে বাফুফে। এঁদের সবার শরীরেই ইউরোপীয় রক্ত। লোডভিক ডি ক্রুইফ, ফাবিও লোপেজ, গঞ্জালো মরেনো, টম সেন্টফিট ও অ্যান্ড্রু ওর্ড। সবশেষ জন ইংলিশ বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক। মধ্য-তিরিশের এই তরুণ কোচের কাজ করার আগ্রহ দেখে মনে হয়েছিল, এবার ভালো কিছু হতেই পারে। বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে গিয়ে হা-হুতাশ করতেন—দল পাচ্ছেন না, কাজ করতে পারছেন না। কাজ পেলেন একসময়। দেড় বছর পর বাংলাদেশ দল তাঁর অভিভাবকত্বে খেলল আন্তর্জাতিক ফুটবল। লাওসে গিয়ে আন্তর্জাতিক প্রীতি ম্যাচে লাওসের সঙ্গে ড্র করে এল। বেশ ধন্য ধন্য পড়ে গেল তাঁকে নিয়ে। ও মা, লাওস থেকে ফিরেই থাকলেন না তিনি! থাইল্যান্ডের কোনো এক ক্লাবের লোভনীয় প্রস্তাব পেয়ে চলে গেলেন। তাহলে সিভিটা একটু জ্বলজ্বলে করাই ছিল বাংলাদেশ নিয়ে কাজ করার এত আগ্রহের মূলে?

ফুটবল কোচিংয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবশ্য বিশ্ব পরিভ্রমণ হয়ে গেছে। ফুটবলের উন্নত পৃথিবীর কত দেশেরই না কোচ দেখেছে বাংলাদেশ। এ দেশে এসেছেন জার্মান কোচ, ব্রাজিলিয়ান কোচ, আর্জেন্টাইন কোচ, অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান কোচ, ইরানি কোচ, ইরাকি কোচ, সুইস কোচ, বেলজিয়ান কোচ, কোরিয়ান কোচ, ডাচ্‌ কোচ, স্প্যানিশ কোচ, ইতালিয়ান কোচ, এমনকি ভারতীয় কোচও। কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে কেউ বাংলাদেশের ফুটবলকে একটি উন্নত ভিত্তি দিয়ে যেতে পারেননি। পারবেন কী করে, একটানা দুই বছরের জায়গায় তিন বছর কেউ থাকেননি বা থাকতে পারেননি।

শুধু বিনোদনের অভাবে যে সবাই থাকেননি, তা নয়। টাকা নিয়ে ঝামেলা হয়েছে, চুক্তি অনুযায়ী দেওয়া স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে হরণ করা হয়েছে, কাজের সর্বোত্তম পরিবেশ ছিল না—এসবই কারণ। বাফুফে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে প্রশ্ন করলেই সঠিক উত্তরটা পেয়ে যাবে।

‘ঘরকা মুরগি ডাল বরাবর’ বলে যে কথাটা প্রচলিত আছে, বাফুফের কাছে সেটি খুব প্রিয়। সে জন্য দেশজ কোচদের কদর খুব একটা নেই। তারপরও অনেক স্থানীয় কোচই আপৎকালীন দায়িত্ব নিয়েছেন। নাম করা যায় আবদুর রহিম, গোলাম সারোয়ার, কাজী সালাউদ্দিন, আবু ইউসুফ, হাসানুজ্জামান বাবলু, শফিকুল ইসলাম, সাইফুল বারী, মারুফুল হকদের। কিন্তু স্থানীয় কোচদের নিয়ে বাফুফে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার কথা যেমন ভাবে না, তেমনি এ দেশের ফুটবলাররাও দেশজ কোচদের মেনে নিতে মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকেন না। শুধু ফুটবল কেন, ক্রিকেটে তো দেশজ কোচদের অবস্থান আরও পেছনের সারিতে।

তবে এসব যা-ই হোক, ক্রিকেট ও ফুটবলে দ্রুতই কোচ নিয়োগ করতে না পারলে একটা বড় বিপর্যয়ের মুখেই পড়তে হতে পারে বাংলাদেশকে। আগামী সেপ্টেম্বরে ঘরের মাঠে সাফ ফুটবল, তার পর কোনো এক সময় বঙ্গবন্ধু গোল্ড কাপ। দক্ষিণ এশিয়ার সর্বোচ্চ ফুটবল প্রতিযোগিতা সাফে বাংলাদেশ সর্বশেষ তিনবারই প্রাথমিক পর্ব পেরোতে পারেনি। ফিফা র‍্যাঙ্কিংয়ে দেশ যে প্রায় দ্বিশতকের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে, এর পেছনে সাফের এমন নিদারুণ ব্যর্থতারও ‘অবদান’ আছে। বাফুফের স্মৃতি নিশ্চয়ই গোল্ডফিশের নয়!