আইসিসির চিঠি

নেদারল্যান্ডসভিত্তিক আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতের তদন্ত উদ্যোগকে আইনের শাসন ও মানবাধিকারে বিশ্বাসী বিশ্বের সব রাষ্ট্র ও জনগণ অকুণ্ঠ সমর্থন যে ব্যক্ত করবে, সেটাই স্বাভাবিক প্রত্যাশা। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রতিনিধিদলের সরেজমিনে উদ্বাস্তু পরিস্থিতি পরিদর্শনের প্রেক্ষাপটে আইসিসি থেকে বাংলাদেশের কাছে চিঠি আসা একটি অসাধারণ গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি। অপরাধীদের কাঠগড়ায় তোলা সম্ভব হলে রোহিঙ্গা সংকটের একটি স্থায়ী সমাধানে তা অত্যন্ত সহায়ক বলেই গণ্য হতে পারে।

মিয়ানমার আইসিসির আওতাভুক্ত না হলেও বাংলাদেশ এর আওতাভুক্ত। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা ইতিমধ্যে পরিষ্কার করেছেন যে এ ধরনের এখতিয়ারসংক্রান্ত কূটতর্ক তুলে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের নৈতিক দায়িত্ব-কর্তব্যকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার সুযোগ নেই। কারণ, নিরাপত্তা পরিষদ এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিলে সব জটিলতার অবসান হবে। আইসিসির প্রসিকিউটর ফাটু বিনসুদা ইতিমধ্যে আদালতে নিবেদন করেছেন যে আইসিসির পক্ষে এর বিচার করা সম্ভব। নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যরা তাদেরই পাঠানো প্রতিনিধিদলের কাছ থেকে এখন প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ পাবে এবং তারা অনতিবিলম্বে সিদ্ধান্ত পাসে ঐকমত্যে পৌঁছাবে—এটা বিশ্বমানবতার দাবি। বিশ্বের শান্তিকামীরা আশা করবে যে নিরাপত্তা পরিষদ এর আগে মিয়ানমারের ওপর অবরোধ আরোপে ভিন্নমত দেখালেও প্রকৃত অপরাধীদের বিচারের কাঠগড়ায় তুলতে তারা বিভক্ত হবে না। আমরা বিশ্বাস করি, ভারত, চীন ও রাশিয়ার মতো সভ্য রাষ্ট্রগুলো অপরাধের বিচারের পথকে রোধ করার মতো অবস্থান নেবে না।

আমরা এর আগে স্পষ্ট করেছিলাম যে দ্বিপক্ষীয় ভিত্তিতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াকে বেগবান করার বিষয় থেকে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিচারের প্রশ্নকে আলাদা করার কূটনীতিতে তাকে অবশ্যই সক্রিয় হতে হবে। আইসিসির চিঠি তার সেই নৈতিক দায়কে আরও বহু গুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। কারণ, মিয়ানমারের সরকারের অভ্যন্তরের যারাই আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে বর্বরোচিত অপরাধ করেছে, তাদের অবশ্যই বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে বাংলাদেশকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে।

অপরাধের বিচারের বিষয়ে কোনো দর-কষাকষি বা চুক্তি করা বা না করার বিষয় নেই। কোনো রাষ্ট্র দ্বিপক্ষীয় বা বহুপক্ষীয় চুক্তি বা সমঝোতা দ্বারা কোনোকালেই অপরাধের বিচারকে স্তব্ধ করতে বা দায়মুক্তি দিতে পারে না। বাংলাদেশ সরকার মানবতার ডাকে সাড়া দিয়ে দুর্গত রোহিঙ্গাদের ঠাঁই দিয়ে সারা বিশ্বের প্রশংসা কুড়িয়েছে। কিন্তু এমন কোনো বিচার-বিবেচনা বা কূটনীতির মানদণ্ড গ্রহণযোগ্য হতে পারে না, যাতে মিয়ানমারের গণহত্যা সংঘটনকারীদের বিচারে সোপর্দ করার কোনো প্রয়াসকে অন্যায়ভাবে বাধাগ্রস্ত করা হয়।

বাংলাদেশ হয়তো গোপনে প্রয়োজনীয় তথ্য প্রদান করার বিকল্প বেছে নিতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশকে তথ্য প্রদানে অবশ্যই সর্বোচ্চ পেশাদারি দক্ষতা ও সত্যনিষ্ঠা প্রদর্শনের এক অনুকরণীয় নজির স্থাপন করতে হবে। কারণ, আইসিসির এই তথ্য অনুসন্ধানে বাংলাদেশের পক্ষেই সব থেকে ভালো উপায়ে রোহিঙ্গাদের ওপর নৃশংসতা সংঘটনের সপক্ষে অকাট্য সাক্ষ্য-প্রমাণ সরবরাহ করা সম্ভব।

যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে বিচারের অভিজ্ঞতা নিয়ে বাংলাদেশে ইতিমধ্যেই একটি আন্তর্জাতিক মানের প্রসিকিউশন টিম গড়ে উঠেছে। তার সেই বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকেই আইসিসিকে যথাযথ উপায়ে তথ্য সরবরাহের চ্যালেঞ্জ এখন বাংলাদেশের সামনে। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর গণহত্যা ও পোড়ামাটি নীতির শিকার হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া প্রায় ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গার ন্যায়বিচার লাভ করার প্রতি একাত্তরে গণহত্যার বিভীষিকা স্মৃতিকাতর বাংলাদেশের জনগণের যে সব ধরনের সহানুভূতি ও নৈতিক সমর্থন থাকবে, তাতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।