কী জাদু করিলা...

টঙ্গী থানায় পুলিশের জব্দ করা সেই গাড়িটি
টঙ্গী থানায় পুলিশের জব্দ করা সেই গাড়িটি

মনে আছে। তবে আবছা। খুবই অস্পষ্ট স্মৃতিচিত্র।

মফস্বলের ইশকুলে পড়ি। থ্রি-ফোরে; বড়জোর ফাইভে। ইশকুলে একদিন জাদুকর এলেন। টিফিনের সময় মাঠে জাদু দেখানো হবে। নোংরা ত্যানার মতো শাড়ি দিয়ে একটা জায়গা ঘেরা হয়েছে। এক টাকা টিকিট। ‘মালাই’ (আইসক্রিম) না খেয়ে সেই টাকায় ঢুকলাম জাদুর ঘরে। জাদুকরের চেহারা-ছবি পছন্দ হলো না। হাড় জিরজিরে না-খাওয়া শরীর। কিন্তু তাঁর জাদু আমাকে মুগ্ধ করল। একটা আস্ত চেয়ার তিনি বড় মুগুরের মতো হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে বলা যায় কুটি কুটি করে ফেললেন। সেই কুচো কাঠ এক জায়গায় জড়ো করে একটা ছালা দিয়ে ঢেকে দিলেন। তারপর ছুমন্তর ছু...! ছালা সরানো হলো। আরিব্বাস! সামনে সেই আস্ত চেয়ার! অক্ষত!

আমাদের মধ্য থেকে কেউ একজন বলল, ‘কাকু, কেমনে করলেন? আপনি কি এসমে আজম জানেন? নাকি কুফুরি কালাম?’ জাদুকর কাকু বিজ্ঞের মতো বিরাট নিশ্বাস ফেললেন। দার্শনিকের মতো চোখ বন্ধ করলেন। তারপর দরবেশের মতো আকাশের দিকে শাহাদত আঙুল তুলে বললেন, ‘ওরে পাগলা, আমি কে? আমরা কে? কেউ না। সবই তাঁর খেলা! সব তিনিই জানেন!’ ভেবেছিলাম এমন জাদু জীবনে আর দেখা হবে না। কিন্তু অতৃপ্তির মৃত্যু থেকে আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে টঙ্গী থানার পুলিশ। তারা তার চেয়ে বড় জাদু দেখিয়েছে। আমার জাদুকর কাকু তো একটা ভাঙচুর করা চেয়ার আবার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে এনেছিলেন। কিন্তু টঙ্গীর পুলিশ ভাইয়েরা ভাঙচুর করার পর জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেওয়া একটা আস্ত লেগুনাকে আবার অক্ষত অবস্থায় ফিরিয়ে এনে থানার সামনে রেখে দিয়েছেন।

গ্রিক পুরাণের ফিনিক্স পাখি ভস্মীভূত হওয়ার পর ছাই থেকে আবার আনকোরা হয়ে ফিরে আসত। টঙ্গী থানায় সেই কায়দার ঘটনা ঘটেছে। ভাঙচুর ও আগুনের শিকার হওয়া লেগুনার গায়ে এখন আঘাতের চিহ্নমাত্র নেই। ৯ মে প্রথম আলোর প্রথম পাতায় সেই লেগুনার ছবি ছাপা হয়েছে।

ছবির সঙ্গে খবর ছিল। ৬ মে আদালত গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচন স্থগিত করার দেড় ঘণ্টার মধ্যে পুলিশ বিএনপির প্রার্থী হাসান সরকারের বাড়ির আশপাশে অভিযান চালায়। তারা বিএনপির নেতা আবদুল্লাহ আল নোমানসহ ১৩ জনকে টপাটপ ধরে ফেলে। ছয় ঘণ্টা পর নোমানকে ছেড়ে দেওয়া হয়। পরের দিন বাকি ১২ জনসহ ১০৩ জনের নাম উল্লেখ করে টঙ্গী থানায় মামলা করে পুলিশ। এজাহারে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয় আরও এক শ থেকে দেড় শ জনকে। এঁদের ৪৮ জনই বিএনপির মেয়র প্রার্থীর নির্বাচন পরিচালনা কমিটির লোক। পুলিশ এমনি কাউকে ধরে না। মামলাও করে না। এজাহার থেকেই আমরা জানলাম, ৬ মে বিকেল সাড়ে চারটার দিকে কিছু দুষ্টু লোক ময়মনসিংহ মহাসড়কের স্টার হেভেন রেস্তোরাঁর সামনে একটি লেগুনা (ঢাকা মেট্রো-গ-১১-৬০৮০) ভাঙচুর করে আগুন ধরিয়ে দেয়। ঘটনাস্থল থেকে ১২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। আরও এক শ থেকে দেড় শ জন পুলিশ দেখে পালিয়ে যান। আলামত হিসেবে গাড়িটির ধ্বংসাবশেষ, কিছু কাচের টুকরা ও ১০টি ইটের টুকরা জব্দ করা হয়।

কিন্তু এক দিন পরই সাংবাদিকেরা গিয়ে দেখেন, একি! গাড়ি পুরোপুরি অক্ষত। ভেতরে গাড়ির মালিক মো. আলামিন বসা। আলামিন ও গাড়ির চালক রকিব দুজনই বলেছেন, এই গাড়িতে কোনো ভাঙচুর হয়নি। পুলিশ ৬ মে লেগুনাটি রিক্যুইজিশন করে নিয়ে এসেছে। এত লোক থাকতে আপনাদের গাড়ি পুলিশ আনতে গেল কেন? তার জবাবে আলামিনের বক্তব্য, ‘তা তো জানি না।’

বিএনপি বলেছে, পুলিশ তাদের দৌড়ের ওপর রাখার জন্য নাকি খালি খালি এই চাল চেলেছে।

কিন্তু টঙ্গী থানার ওসি মো. কামাল হোসেন প্রথম আলোর কাছে বলেছেন, কাউকে হয়রানির জন্য নয়, ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেই মামলা করা হয়েছে। থানা থেকে লেগুনাটি ছাড়িয়ে নিতে তার মালিক মিথ্যা কথা বলছেন।

এখানে একটা প্যাঁচ বাধল। লেগুনার মালিক মুখে বলেছেন, গাড়ি ভাঙচুর বা পোড়ানোর ঘটনা ঘটেনি। আর পুলিশ খাতা-কলমে, রীতিমতো এজাহারে বলেছে, আলবত ঘটেছে। গাড়ির নম্বরও ঠিক আছে। কিন্তু বাস্তবে গাড়ির গায়ে আঁচড় নেই। অর্থাৎ পুলিশের কথা বিশ্বাস করলে (বিশ্বাস না করা কি ঠিক হবে?) এটাও বিশ্বাস করতে হবে, গাড়িটি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল ঠিকই; তবে তার তাৎক্ষণিক পুনর্জন্ম হয়েছে। ফিনিক্স পাখির মতো হৃতযৌবন ফেরত পেয়ে উড়ে এসেছে। পরে টুক করে থানার সামনে মালিকসহ জুড়ে বসেছে। লেগুনায় বসা মালিকের ছবি আর পুলিশের জাদু দেখে রবিঠাকুরের কথা মনে পড়ছিল: ‘কুমির যেমন খাঁজকাটা দাঁতের মধ্যে শিকারকে বিদ্ধ করিয়া জলের তলে অদৃশ্য হইয়া যায়, তেমনি করিয়া হতভাগ্যকে চাপিয়া ধরিয়া অতলস্পর্শ থানার মধ্যে অন্তর্হিত হওয়াই পুলিসকর্মচারীর স্বাভাবিক ধর্ম।’

এই জাদুর আগে আরও জাদু খেলা দেখা গেছে।

২০১১ সালে সংবিধানে একটি সংশোধনী আনা হয়েছিল। এতে তফসিল ঘোষণার পর কোনো নির্বাচন স্থগিত হওয়ার আগেই নির্বাচন কমিশনের জানা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কিন্তু গাজীপুর সিটি নির্বাচন স্থগিত করার পর আমরা একটি জাদু দেখলাম। সবাইকে হতবাক করে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদা তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বললেন, ‘ (আমি) জানি না, হাইকোর্ট কেন গাজীপুরের সিটি নির্বাচন স্থগিত করেছে’ (৯ মে, প্রথম আলো)। যে লোকের রিট আবেদনে নির্বাচন স্থগিত হলো, সেই এ বি এম আজহারুল ইসলাম প্রথম আলোর কাছে অকপটে স্বীকার করেছেন, গাজীপুরের সিটি করপোরেশন নির্বাচন স্থগিত হোক, সেটা তাঁর চাওয়া ছিল না। তিনি শুধু ছয়টি মৌজা গাজীপুরের বদলে সাভারে রাখার আবেদন করেছিলেন। তবে কাগজপত্রে নির্বাচন স্থগিতে তিনি রিট করেছেন বলে দেখা যাচ্ছে কেন, সে বিষয়ে তিনি জবাব দিতে পারেননি। অব্যক্ত ভাষায় তাঁর উত্তর ছিল, ‘তা তো আমি জানি না’।
নির্বাচন স্থগিত হওয়ায় এই যে কত লোকের কত ক্ষতি হলো, তার দায় কে নেবে?

এর জবাবে সবাই বলছে, ‘জানি না।’ চারপাশে অগণিত ‘জানি না’। আওয়ামী লীগ বলছে, ‘জানি না’। বিএনপি বলছে ‘জানি না’। পুলিশ বলছে, ‘জানি না’। ইসি বলেছে, ‘জানি না’। পাবলিক বলছে, ‘জানি না’। তাহলে কে জানে? কে সেই সবজান্তা? কে সেই স্বয়ম্ভূ; কে সেই সর্বজ্ঞ?

জবাব মেলে। আবছা স্মৃতিচিত্রে ভেসে ওঠে জাদুকর কাকুর দরবেশমার্কা মুখ। তাঁর মন্দ্রসপ্তক সংলাপ কানে বাজে, ‘ওরে পাগলা! আমি কে? আমরা কে? কেউ না। সবই তাঁর খেলা! সব তিনিই জানেন!’

সারফুদ্দিন আহমেদ: প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক
[email protected]