অবসরভোগীদের নিরাপত্তা কোথায়?

জাতীয় বাজেট ঘোষণার আগে সংগঠনের সঙ্গে প্রথামাফিক আলোচনা হয়। প্রথম আলোয় সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন এসেছে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সঙ্গে অর্থমন্ত্রীর বৈঠক প্রসঙ্গে। সেখানে অর্থমন্ত্রী বলেন, সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার পর্যালোচনা করা হবে। তিনি আরও উল্লেখ করেন, ব্যাংকগুলোর মতে, সঞ্চয়পত্রের মুনাফা বেশি হওয়ায় তাদের আমানতও বেশি মুনাফায় নিতে হচ্ছে। এ কারণে তারা ঋণের সুদহার কমাতে পারছে না। তাই বিষয়টি পর্যালোচনা করা প্রয়োজন।

অর্থাৎ আবারও সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার কমানোর আশঙ্কা দেখা দিল। যাঁদের এ মুনাফায় বার্ধক্যে ওষুধ, খাদ্যসহ সবকিছু সংগ্রহ করতে হয়, তাঁদের খবরটিতে শঙ্কিত হওয়ারই কথা। প্রায়ই বলা হয়, ব্যাংকঋণের সুদহার বেশি হওয়ায় শিল্প ও ব্যবসার ব্যয় বাড়ছে, তারা প্রতিযোগিতায় পেরে উঠছে না। তাদের বক্তব্যের সঙ্গে সরকার অনেকাংশে সহমত পোষণ করছে। সুদহার এক অঙ্কে নামিয়ে আনতে ব্যাংকগুলোকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। ব্যাংকগুলো যাতে তা করতে পারে, এর জন্য তাদের তারল্য পরিস্থিতির উন্নতি প্রয়োজন। সে বিবেচনায় বাংলাদেশ ব্যাংক বিধিবদ্ধ রিজার্ভ ১ শতাংশ কমিয়ে দিয়েছে। এমনটা ব্যাংক ব্যবস্থার ওপর ঝুঁকি বাড়াবে কি না, তা নিয়ে বিতর্ক চলছে। তা ছাড়া বেসরকারি ব্যাংকগুলোর তারল্য বৃদ্ধি করতে সরকারি টাকার ৫০ শতাংশ পর্যন্ত রাখার ব্যবস্থা হয়েছে। এসব ব্যবস্থায় এমনিতেই ব্যাংকঋণের সুদহার কমে আসার কথা।

এ দেশে সরকারি ব্যাংকগুলোর পরিস্থিতি শোচনীয়। তাদের কোনো কোনোটির নিরাপত্তা সঞ্চিতিও ঠিকমতো করা হয় না। কার্যত মূলধন ঘাটতির বারবার জোগান দিতে হয় সরকারকে। খেলাপি ঋণ কাগজে দেখানো হিসাবেই চোখ ছানাবড়া করার মতো। আর পুনর্গঠন, পুনঃ তফসিল ও রাইট অফের প্রকৃত তথ্য জানলে অনেকের গলা শুকিয়ে যাবে। বেসরকারি খাতে ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ কিছুটা কম। তবে কোনো কোনোটি অচলও হয়ে আছে। আমানতকারীদের টাকাও দিতে পারছে না। সেখানে সরকারি ব্যাংকগুলো থেকে অর্থায়ন করে সংকট উত্তরণের প্রচেষ্টা চলছে। এমনও নয় যে বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে সুশাসন আছে। রাতারাতি মালিকানা ও ব্যবস্থাপনার পরিবর্তন হয়। আমানতকারীরা আগের সুদহারে কিছুদিন আগেও ব্যাংকেই ছিলেন। এ বিষয়গুলো যে ব্যাংক ব্যবস্থার ওপর আস্থার সংকট সৃষ্টি করছে, এটা নিয়ে তেমন আলোচনা হয় না।

ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা সমাজের অতিগুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। তাঁরা ঝুঁকি ও উদ্যোগ নেন। দেন মেধা ও শ্রম। অনেক আটঘাট মাড়িয়ে লাভের মুখ দেখেন। এটা তাঁদের ন্যায্য প্রাপ্তি। কেননা, ক্ষতির দায়ও তাঁদের। অবশ্য আমাদের দেশে ঋণখেলাপি শ্রেণি, ক্ষতিতে তো নয়ই, লাভ করেও ব্যাংকের পাওনা মেটাতে চান না। তবে সবাই এমন নন। অনেক সৎ উদ্যোক্তা ও ঋণগ্রহীতা আছেন। আর খেলাপিদের সৃষ্ট অব্যবস্থার দায়ভারের অংশবিশেষ পরোক্ষভাবে সৎ উদ্যোক্তাদেরও নিতে হয়। এই উদ্যোক্তা শ্রেণি দেশের অর্থনীতিতে যে ভূমিকা রাখছে, তারই ফলে প্রবৃদ্ধি বাড়ছে, কর্মসংস্থান, দারিদ্র্য দূরীকরণসহ অনেক সুফল মিলছে। এর জন্য অনেক কিছুর পাশাপাশি তাঁদের মূলধন দরকার হয়। এর প্রধান উৎস ব্যাংক ব্যবস্থা। উদ্যোক্তারা যত কম ব্যয়ে মূলধন পাবেন, তাঁদের পণ্যের দাম তত কমবে। এ জন্য ব্যাংকঋণের সুদহার এক অঙ্কে সীমিত রাখার জন্য তাঁরা জোর দাবি করে যাচ্ছেন। তবে সুদহার খুব কম সময়ই এক অঙ্কে ছিল। যখন ছিল না, তখনো উদ্যোক্তারা পিছপা হননি। লাভও করেছেন। সরকার তাঁদের বিভিন্ন ধরনের প্রণোদনা দেয়। অনেক ক্ষেত্রেই আয়কর দিতে হয় না। দিলেও তা নামমাত্র। তাঁরা আন্তর্জাতিক মূল্যের চেয়ে কম দামে বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানি পাচ্ছেন। রপ্তানির জন্য রয়েছে নগদ সহায়তা। ইপিজেড, এসইজেড ও বিসিক শিল্পনগরীতে খুব কম মূল্যে জমিও পান। কোনো কোনো শিল্পনগরীতে বর্জ্য শোধনাগারও স্থাপন করা হয় সরকারি ব্যয়ে। সর্বোপরি আমাদের প্রতিযোগী দেশগুলো থেকে বাংলাদেশে শ্রমমূল্য অনেক কম। বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা ও ভারতে মাসিক ন্যূনতম মজুরি যথাক্রমে ৬৮,৭১ ও ৯৮ মার্কিন ডলার। চীন ও ভিয়েতনামে অঞ্চলভেদে তা যথাক্রমে ১৪৬-৩২১ ও ১২১-১৭৫ মার্কিন ডলার। এসব দিক বিবেচনা করলে বাংলাদেশে ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের তাঁদের প্রতিযোগীদের চেয়ে খারাপ অবস্থায় থাকার কথা নয়। অবশ্য তাঁদের যত কম সুদে ব্যাংকঋণ দেওয়া যায়, তা দেওয়া নিয়ে ভিন্নমত নেই।

তবে এটা করতে গিয়ে বারবার সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হারের দিকে তাকানো হয় কেন? এখানে মূল বিনিয়োগকারীরা তো বৃদ্ধ পেনশনার, দুস্থ বিধবা শ্রেণির লোকজন। তাঁরা অবসর-সুবিধা বা সঞ্চয়ের টাকাগুলো নিয়ে কোথায় যাবেন? একসময়ে গিয়েছিলেন পুঁজিবাজারে। ২০১০-এ নিঃস্ব হয়েছেন কেউ কেউ। বড় লোকসান দিয়ে কেউ ফিরে এসেছেন। সে বাজারের হাল আজও স্থিতিশীল হয়নি। সহসা হবে, এমনটাও কেউ মনে করে না। লুণ্ঠনকারীরা যেখানে কোনো সাজা পেল না, সেখানে সেই বাজারের ওপর আস্থা আসবে কীভাবে? একপর্যায়ে ব্যাংকগুলো আমানতের সুদহার ৪-৫ শতাংশে নামিয়ে দেয়। অথচ মুদ্রাস্ফীতি থাকে ৬ শতাংশের বেশি। আর সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার দুই দফায় কমানো হয়েছে। তাও একটি শ্রেণির মানুষের কাছে এটিই একমাত্র নিরাপদ লাভজনক একটি স্থান।

ব্যাংকের সুদহার যখন ৪-৫ শতাংশ ছিল, তখন বলা হতো, তারা টাকার ওপর বসে আছে। বিনিয়োগ হচ্ছে না। হঠাৎ জানা গেল তারল্যের শোচনীয় ঘাটতি। ঘাটতি মেটাতে তো সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক বেশ কিছু ব্যবস্থা নিয়েছে। এতে ঘাটতি অনেকাংশে লাঘব হওয়ার কথা। নতুন আমানতের জন্যও সচেষ্ট থাকলে ব্যবস্থা হবে। এর জন্য সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার আবার কমানোর দাবি অসংগত। বর্তমান ক্ষমতাসীন দল একসময় নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত স্বার্থকে বড় করে দেখত। ইদানীং দলটির কাঠামোগত পরিবর্তনে দৃষ্টিভঙ্গিতে পুরোভাগে থাকছে ধনিকশ্রেণি। অবশ্য এখনো কিছু রাজনৈতিক নেতা এ দলে আছেন, যাঁরা সঞ্চয়পত্রের আমানতকারীদের পক্ষে সোচ্চার।

বাংলাদেশে ধীরে ধীরে একটি সামাজিক নিরাপত্তাবলয় গড়ার প্রচেষ্টা চলছে। তবে সেটা অনেকটা হতদরিদ্র শ্রেণিকে কেন্দ্র করে। সেটা আরও প্রসারিত ও জোরদার হোক, এটা সবাই চান। তবে মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তরা এ ধরনের নিরাপত্তাবলয়ের সুরক্ষা পাচ্ছেন না। যদি কিছুটা পেতেন, সঞ্চয়পত্রের মুনাফা তাঁদের কাছে এতটা গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হতো না। ভারতে সঞ্চয়পত্রের মুনাফা আমাদের চেয়ে কিছুটা কম বটে। তবে তারা যে বিশাল নিরাপত্তাবলয় গড়ে তুলেছে, তাতে নিম্নবিত্তের সঙ্গে মধ্যবিত্তও স্থান পেয়েছে। ২০১৩ সালের জাতীয় খাদ্যনিরাপত্তা আইন অনুসারে ৮১ কোটি ভারতীয় প্রতি মাসে মাথাপিছু ৫ কেজি করে চাল বা আটা পান ১-৩ টাকা দরে। রাজ্যভেদে এর দরে ও পরিমাণে কিছু হেরফের আছে। সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবার জন্য আমাদের দেশে অনেক টাকা ব্যয় করা হয়। এ পরিষেবা খুবই সাশ্রয়ী, তবে তা সঠিকভাবে পাওয়ার সৌভাগ্য সবার হয় না। কিন্তু ভারতের সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবার হাল আমাদের মতো হতশ্রী নয়। আমাদের বেসরকারি হাসপাতালগুলো ব্যয়বহুল। অবসরভোগীদের জন্য সবকিছুরই ভরসা সঞ্চয়পত্রের মুনাফা। তাই দয়া করে এ ব্যবস্থাটিতে আর কাঁচি চালাতে যাবেন না। হতে পারে কিছু ধনী লোক এ ব্যবস্থার সুযোগ নিচ্ছে। গোটা ব্যবস্থাটি ডিজিটাল করে এর অপব্যবহার বন্ধ করা খুব ব্যয়বহুল বা সময়সাধ্য নয়। ব্যাংকঋণের সুদ কমানোর প্রয়োজনে গোটা ব্যবস্থাটির মুনাফা নিয়ে টান দিয়ে ভঙ্গুর মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রেণির লোকদের আরও বিপন্ন করবেন না। ধরে নিন তাঁরা এর মাধ্যমে একটি সামাজিক নিরাপত্তাবলয়েই আছেন।

আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব
[email protected]