২২ লাখ তরুণকে উপেক্ষা করবেন না

‘রক্তের বন্যায় ভেসে যাবে অন্যায়।’
অনেক দিন পর এই স্লোগান শুনলাম। গতকাল সোমবার বেলা ১১টায় যখন টিএসসিতে পৌঁছাই, তখন দেখি কলাভবনের দিক থেকে সাধারণ শিক্ষার্থীদের একটি মিছিল আসছে। আর মিছিল থেকে মুহুর্মুহু স্লোগান ধ্বনিত হচ্ছে: ‘ছাত্রসমাজ জেগেছে, রক্তে আগুন লেগেছে’। ‘আর নয় প্রহসন, দিতে হবে প্রজ্ঞাপন’। ‘প্রজ্ঞাপন নিয়ে টালবাহানা চলবে না’। ‘রক্তের বন্যায় ভেসে যাবে অন্যায়’। মিছিলকারীদের হাতে ধরা পোস্টারেও স্লোগানের কথাগুলো ছিল।

মিছিলটি দক্ষিণ দিকে গিয়ে শহীদ মিনার ও দোয়েল চত্বর হয়ে ফের শাহবাগে এসে শেষ হয়। এরপর সেখানেই আন্দোলনকারীরা সমাবেশ করেন। দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরা ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েন। তবে তাঁরা ছাত্রদের সমাবেশে বাধা দেননি। মোড়ের তিন দিকে গাড়ি ও মানুষের ভিড় জমে যায়। তখনো সমাবেশ থেকে স্লোগান উচ্চারিত হচ্ছিল ‘জয় বাংলা’, ‘জয় বঙ্গবন্ধু’।

মিছিলের উত্তাপ
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ আন্দোলন করে আসছিল অনেক দিন ধরেই। একপর্যায়ে ১১ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে ‘কোটা থাকবে না’ বলে ঘোষণা দিলে শিক্ষার্থীরা তাঁদের কর্মসূচি স্থগিত করেন। এর আগে আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বেশ কিছু ‘অঘটন’ ঘটে। তবে এই অঘটনের জন্য কারা দায়ী, তা এখনো নিরূপিত হয়নি। সরকারের দাবি, আন্দোলনকারীরা উপাচার্যের বাড়িতে ভাঙচুর করেছেন। আর আন্দোলনকারীরা বলছেন, তাঁদের কেউ এই অপকর্ম করেননি। উপাচার্যের বাড়িতে হামলার অভিযোগে যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তারাও আন্দোলনকারীদের কেউ নয়।

গতকাল আলাপকালে ক্যাম্পাসে সাংবাদিকতা করেন এমন একজন শিক্ষার্থী উপাচার্যের বাসভবনে হামলার প্রসঙ্গে বললেন, সেদিন তিনি সেখানে উপস্থিত ছিলেন। সাংবাদিক ও আন্দোলনকারীরাই উপাচার্যকে রক্ষা করেছেন। আর আক্রমণকারীরা ভিড়ের মধ্যে ঢুকে পড়ে এবং উপাচার্যের বাসভবনের সিসি ক্যামেরা না ভাঙা পর্যন্ত আক্রমণকারীরা সেখানে ছিল। এক মাসের বেশি সময় হলেও সরকার এখনো পর্যন্ত রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারেনি। অথচ সরকারের নীতিনির্ধারক মহল আন্দোলনকারীদের ওপরই দোষ চাপাচ্ছে। আবার কেউ কেউ ঘটনার পেছনে ছাত্রলীগের সম্মেলন ও শিক্ষকদের মধ্যকার বিরোধের প্রতিও ইঙ্গিত করেছেন। অপরাধী যে-ই হোক না কেন, সরকারের দায়িত্ব প্রকৃত অপরাধীকে আইনের আওতায় আনা।

এ ব্যাপারে সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের নেতারাও উপাচার্যের বাসভবনে হামলার বিচার দাবি করেছেন। তবে তাঁরা সংঘর্ষের পরিপ্রেক্ষিতে করা পুলিশি মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন। তাঁদের বক্তব্য হলো পুলিশ সেদিন বিনা উসকানিতে আন্দোলনকারীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। আবার ছাত্রদের বিরুদ্ধেই মামলা করেছে।

কোটা আন্দোলনের নেতারা আরও বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা কর্মসূচি স্থগিত করেছেন। কিন্তু গত এক মাসেও সরকার প্রজ্ঞাপন জারি করেনি। এমনকি রোববার কর্মসূচি ঘোষণা করার পর সরকারের পক্ষ থেকে তাঁদের সঙ্গে কেউ যোগযোগ করেনি। বরং সেদিন সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের শিক্ষার্থীদের ধর্মঘটে যাওয়া সমীচীন নয় বলে মৃদু হুমকি দিয়েছেন।

এখানেও ছাত্রলীগ
ওবায়দুল কাদের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বৈঠকে যে এক মাসের মধ্যে সমস্যার সমাধান করবেন বলেছিলেন, সেই সময়সীমা অনেক আগেই শেষ হয়েছে। এমনকি প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণারও এক মাস পার হয়েছে ১১ মে। ফলে শিক্ষার্থীদের মনে ক্ষোভ জমা অস্বাভাবিক নয়। আর এই ক্ষোভের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে কয়েকটি স্থানে ছাত্রলীগের হামলার ঘটনা।

প্রথম আলোর খবর থেকে জানা যায়, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বহনকারী বাসে অতর্কিত হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনায় নগরের পুলিশ লাইনস এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে উভয় পক্ষের অন্তত ১০ জন আহত হয়েছেন। কুমিল্লা সরকারি কলেজের সামনের সড়কে রোববার বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে এ ঘটনা ঘটে। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কুমিল্লা সরকারি কলেজ শাখা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের দফায় দফায় পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে।

সংঘর্ষে মহানগর ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরাও যোগ দেন। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা বাস ভাঙচুরের প্রতিবাদে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত সড়ক অবরোধ করে রাখেন। তখন প্রায় সোয়া এক ঘণ্টা যান চলাচল বন্ধ থাকে। পরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ লাঠিপেটা ও কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সরিয়ে দেয়।

সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ কুমিল্লা জেলা শাখার আহ্বায়ক মজহারুল ইসলাম হানিফ বলেন, ‘রোববার দুপুরে কুমিল্লা নগরের কান্দিরপাড় পূবালী চত্বরে কোটা সংস্কার আন্দোলনের দাবিতে কর্মসূচি পালন করতে গেলে মহানগর ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা বাধা দেন। এ সময় আমাদের তিনজন আন্দোলনকারীকে চড়-থাপ্পড় দেওয়া হয়। পরে কর্মসূচি না করেই আমরা চলে আসি। পুলিশ লাইনসের ঘটনায় ছাত্রলীগের সরকারি কলেজ ও মহানগরের কয়েকজন নেতা এ হামলার সঙ্গে জড়িত। এ ঘটনার বিচার চাই। কোটা সংস্কার আন্দোলন করার কারণেই বাস ভাঙচুর ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর অতর্কিত হামলা করে ছাত্রলীগ। পুলিশ ছাত্রলীগের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে।’ তবে মহানগর ছাত্রলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক নাঈমুল হক এ অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, সকালে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানেরা কোটার পক্ষে কান্দিরপাড়ে মানববন্ধন করেন। ছাত্রলীগ সেখানে কারও ওপর হামলা করেনি।

এদিকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে এক শিক্ষার্থীকে ছাত্রলীগের কর্মীরা মারধর করেছেন। ওই শিক্ষার্থী হল কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। এ ছাড়া আরও কয়েকটি স্থানে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের নানাভাবে হয়রানির ঘটনা ঘটেছে। ক্যাম্পাস থেকে শিক্ষার্থীদের বের হতে বাধা দেওয়া হয়েছে। আবার এই বাধার প্রতিবাদে আন্দোলনকারীরা বিভিন্ন স্থানে সড়ক অবরোধ করেছেন।

এই প্রেক্ষাপটে গতকাল ক্যাম্পাসজুড়ে আন্দোলনকারীরা বেশ চাঙা ছিলেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা দুদিন ধরে বিক্ষোভ করেছেন। গতকাল ষোলশহরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শাটল ট্রেন বন্ধ করে দিয়েছেন। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, সরকার কালক্ষেপণের কৌশল নিয়ে কোটা আন্দোলন বন্ধ করতে চায়। দুদিন পরই রোজা শুরু হলে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যাবে। তখন ক্যাম্পাসে আন্দোলন করার কেউ থাকবেন না।

এক দিনের ক্ষতি
আমরা সকালে যখন ক্যাম্পাসে যাই, শাহবাগে যানবাহন চলাচল ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু দুপুরে ফেরার সময় দেখা গেল সব ধরনের যানবাহন বন্ধ। শিক্ষার্থীরা আগেই ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। কলাভবন, কার্জন হল ও অন্যান্য ভবনে ক্লাস-পরীক্ষা হয়নি বললেই চলে। কোথাও শিক্ষক এলেও শিক্ষার্থীরা আসেননি। আবার কোথাও শিক্ষার্থীরা এসেছেন, কিন্তু শিক্ষক ক্লাস নিতে সাহস পাননি। দেশের অধিকাংশ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্রই এ রকম। সে ক্ষেত্রে ক্ষতির পরিমাণটি ভাবুন। শাহবাগে লক্ষ করি, শত শত যানবাহন দাঁড়িয়ে আছে। পুলিশও ঠিক করতে পারছে না কী করবে। যানজটে আক্রান্ত এই শহরে শাহবাগ মোড়ের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সড়ক বন্ধ থাকলে জনজীবনে কী দুঃসহ অবস্থা তৈরি হতে পারে, তা সহজেই অনুমান করা যায়। পুরো শহর প্রায় অচল হয়ে পড়ে। সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন হাসপাতালে আসা চিকিৎসাপ্রার্থীরা। কিন্তু এসবের জন্য আন্দোলনকারীদের বেশি দায়ী করা যাবে না। তাঁরা আগেই কর্মসূচির কথা জানিয়ে দিয়েছিলেন। সরকার ছিল নির্বিকার।

কোটার সমস্যাটি বেশ জটিল। শিক্ষার্থীরাও কোটা বাতিল চাননি। সংস্কার চেয়েছেন। তাঁরা নির্দিষ্ট কোনো কোটার কথাও উল্লেখ করেননি। তাঁরা যা বলেছেন, তা হলো কোটা যৌক্তিক পর্যায়ে নিয়ে আসতে হবে। মেধাবীদের সুযোগ দিতে হবে। এর আগে সরকারের গঠিত কমিটিগুলোও কোটা সংস্কারের সুপারিশ করেছে। তাহলে শিক্ষার্থীদের দোষ কী। সরকারের সময়মতো সিদ্ধান্ত নিলে নগরবাসীকে বিপদে পড়তে হতো না। ক্লাস-পরীক্ষাও বন্ধ থাকত না।

২২ লাখ তরুণকে উপেক্ষা করবেন না
বর্তমানে দেশে সরকারি চাকুরের সংখ্যা ১৪ লাখের মতো। তাঁদের জন্য সরকার অনেক কিছুই করেছে। অন্যদিকে বর্তমানে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা যে ফেসবুক নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে, তার সদস্যসংখ্যা ২২ লাখ। তাঁদের বড় অংশই হয়তো সরকারি চাকরি পাবেন না। তারপরও আন্দোলনে আছেন দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা একটি অন্যায়ের প্রতিকারের জন্য। কিন্তু সরকারের নীতিনির্ধারকেরা এর মধ্যেও জামায়াত-শিবির খুঁজতে থাকলেন।

সাধারণ শিক্ষার্থীদের ন্যায়সংগত আন্দোলনকে বাঁকা চোখে দেখার সুযোগ নেই। সরকার যত কালক্ষেপণ করবে, তত ক্ষতি বাড়বে। আর একমুহূর্তও দেরি না করে প্রজ্ঞাপন জারি করুন। ২২ লাখ তরুণের ন্যায় দাবি ও আবেগকে উপেক্ষা করবেন না।

সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্মসম্পাদক ও কবি

[email protected]