পেনশন ব্যবস্থার সংস্কার জরুরি

বিশ্বের প্রায় সব দেশেই অবসরপ্রাপ্ত প্রবীণদের আর্থিক নিরাপত্তার লক্ষ্যে পেনশন কর্মসূচি পরিচালনা করা হয়। বাংলাদেশের পেনশন ব্যবস্থার লক্ষ্যও তা-ই। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে জনসংখ্যা, অর্থনীতি, শ্রমবাজার ও মানুষের জীবনপদ্ধতিতে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু বাংলাদেশের পেনশন ব্যবস্থার তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি। ফলে এই পদ্ধতি বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতের সঙ্গে বেশ অসংগতিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। অবসরপ্রাপ্ত প্রবীণ যাঁরা তাঁদের কর্মজীবনে দেশের অর্থনীতিতে সক্রিয় ছিলেন, তাঁদের শেষ জীবনের আর্থিক নিরাপত্তা বিধান বা সহায়তা প্রদান যদি পেনশন ব্যবস্থার লক্ষ্য হয়, তবে সেই লক্ষ্য পূরণে বাংলাদেশের পেনশন ব্যবস্থা সামান্যই সক্ষম।

বাংলাদেশের পেনশন ব্যবস্থা একটি সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি হলেও তা অত্যন্ত সংকীর্ণ, বৈষম্যপূর্ণ ও ত্রুটিপূর্ণ। এটা সংকীর্ণ এই কারণে যে এই ব্যবস্থায় কেবল সরকারি কর্মচারী ও স্বায়ত্তশাসিত সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীরাই অন্তর্ভুক্ত। সরকারি হিসাবে বর্তমানে পেনশনভোগীর সংখ্যা কম-বেশি ছয় লাখের মতো; যাঁরা বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে কর্মজীবনের সমাপ্তির পর অবসরে আছেন।

কিন্তু দেশের কর্মজীবী মানুষের একটি ক্ষুদ্র অংশই সরকারি খাতে নিয়োজিত, বরং অধিকাংশই বেসরকারি আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। দেশের অর্থনৈতিক বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে বেসরকারি খাতে নিয়োজিত লোকজনের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। অথচ তাঁরা দেশের পেনশন ব্যবস্থার আওতায় পড়েন না। তাই বিদ্যমান এ পেনশন ব্যবস্থা কোনোভাবেই যৌক্তিক হতে পারে না। যেসব মানুষের চাকরিকালীন অবদানের কারণে দেশের অর্থনীতি সচল থাকে বা ক্রমেই বিকশিত হয়, বার্ধক্যকালে তাঁদের আর্থিকভাবে অনিরাপদ রাখা রীতিমতো অন্যায়ও বটে।

বর্তমানে বৃদ্ধদের আর্থিক নিরাপত্তা প্রদানের জন্য তিনটি কর্মসূচি চলমান আছে। এগুলো হলো অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারীদের জন্য পেনশন ব্যবস্থা, মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা এবং বয়স্ক ভাতা। এখানেও বৈষম্য হচ্ছে । যেমন ২০১৫-১৬ অর্থবছরে সরকারি কর্মচারী ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের জন্য পেনশন বাবদ খরচ হয় ১১ হাজার ১৮৩ দশমিক ৯৫ কোটি টাকা। মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানী হিসেবে বণ্টন করা হয় ১ হাজার ৯২০ কোটি টাকা । ২০১৫-১৬ সালে এই কর্মসূচির আওতায় সুবিধাভোগীর সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৮০ হাজার। সর্বোপরি বয়স্ক ভাতার আওতায় একই অর্থবছরে খরচ হয় ১ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা এবং সুবিধাপ্রাপ্ত লোকের সংখ্যা ছিল ৩০ লাখ।

ওপরের তথ্য অনুসারে, এই তিনটি কর্মসূচির মধ্যে প্রত্যেক পেনশনভোগী বছরে গড়ে ১ লাখ ৯০ হাজার টাকা বা মাসে গড়ে প্রায় ১৬ হাজার টাকা পেয়ে থাকেন। প্রত্যেক সুবিধাপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা গড়ে মাসে পান প্রায় ৯ হাজার টাকা এবং একজন দরিদ্র বয়স্ক ভাতার সুবিধাভোগী মাসে পান ৪০০ টাকা; অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় আর্থিক নিরাপত্তার অংশ হিসেবে একজন বয়স্ক ভাতার সুবিধাভোগীর চেয়ে একজন মুক্তিযোদ্ধা গড়ে ২২ গুণের চেয়ে বেশি অর্থ এবং একজন পেনশনভোগী ৪০ গুণ বেশি অর্থ পেয়ে থাকেন। যদি বৃদ্ধ বয়সে মানুষের আর্থিক নিরাপত্তা বিধানই এসব কর্মসূচির উদ্দেশ্য হয়, তবে এই বৈষম্যমূলক বণ্টননীতির কোনো যৌক্তিকতা থাকে না। এখানে উল্লেখ্য, উল্লিখিত তিনটি কর্মসূচিই রাজস্বভিত্তিক। এগুলো কন্ট্রিবিউশননির্ভর নয়। এগুলোকে আরও সাম্যভিত্তিক করলে কারও কোনো আপত্তি থাকার কথা নয়।

আগেই বলেছি, এই পেনশন ব্যবস্থা রাজস্বভিত্তিক। তাই পেনশন ব্যবস্থার সম্প্রসারণের কথা বললে অনেকে মনে করেন যে তা জাতীয় বাজেটের ওপর বাড়তি চাপ ফেলবে। কিন্তু পেনশনের আওতা সম্প্রসারণ করলে বাজেটের ওপর বাড়তি চাপ আবশ্যিক নয়। মৌলিকভাবে পেনশন একটি ইনস্যুরেন্স-ব্যবস্থা, যা বেতনভোগী কর্মজীবীদের কন্ট্রিবিউশনের ভিত্তিতে পরিচালিত হয়। কোনো কোনো দেশে কর্মচারীদের পাশাপাশি মালিক ও রাষ্ট্রও আংশিকভাবে ট্রিবিউন করে, যা মূল তহবিলের সঙ্গে সংযুক্ত হয়।

উন্নত বিশ্বে সাধারণত ‘পে এজ ইয়্যু গো’ পদ্ধতিতে পেনশন ব্যবস্থা পরিচালিত হয়। সেখানে একজন কর্মজীবী চাকরিকালীন তাঁর পেনশন প্ল্যানে কন্ট্রিবিউট করেন এবং কর্মজীবন শেষে তাঁর কন্ট্রিবিউশনের আলোকে পেনশন-সুবিধা ভোগ করেন। কর্মজীবনে যাঁরা জাতীয় পেনশন প্ল্যানের অন্তর্ভুক্ত হতে চান না এবং এতে কন্ট্রিবিউট করেন না, তাঁরা পেনশন-সুবিধা পান না। তাই সেখানে জাতীয় পেনশন স্কিম রাজস্বব্যবস্থা থেকে আলাদা। কেবল দরিদ্র প্রবীণদের সহায়তা প্রদানের জন্য সেখানে রাজস্ব থেকে বয়স্ক ভাতা দেওয়া হয়।

পেনশন ব্যবস্থাকে তার বিদ্যমান সংকীর্ণতা থেকে মুক্ত করতে হলে রাজস্বভিত্তিক কর্মসূচি বদলে কন্ট্রিবিউশনভিত্তিক পেনশন স্কিম চালু করা যেতে পারে। জাতীয় পেনশন স্কিমের বাইরে কেউ চাইলে ইনস্যুরেন্স কোম্পানি থেকে ব্যক্তিগত পেনশন প্ল্যান কিনতে পারেন। দরিদ্র বয়স্কদের জন্য রাজস্বভিত্তিক বৃদ্ধ ভাতা চালু রাখা যেতে পারে। এভাবে বাজেটের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি না করেই দেশের পেনশন ব্যবস্থাকে আনুষ্ঠানিক অর্থনৈতিক খাতে সর্বজনীন করা সম্ভব এবং সার্বিকভাবে এর ব্যাপক সম্প্রসারণ সম্ভব।

ড. মো. মাহমুদুর রহমান ভূঞা নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও সমাজতত্ত্ব বিভাগের সহকারী অধ্যাপক