রোহিঙ্গা বিষয়ে বিশ্ব চোখ বুজে আছে

তাওয়াক্কল কারমান ইয়েমেনি নারী অধিকার নেত্রী, সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদ। ২০১১ সালে ইয়েমেনের গণতান্ত্রিক আন্দোলন শুরু হলে তিনি তাতে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েন। সে বছরই প্রথম ইয়েমেনি ও আরব নারী হিসেবে নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত হন। সম্প্রতি এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন আয়োজিত একটি সিম্পোজিয়ামে যোগ দিতে তিনি চট্টগ্রামে এলে প্রথম আলোর সঙ্গে তাঁর কথা হয়। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আহমেদ মুনির।

প্রথম আলো: আপনি বাংলাদেশে এ নিয়ে দ্বিতীয়বার এলেন, কেমন লাগছে? 
তাওয়াক্কল কারমান: দুই মাস আগে প্রথম এসেই এ দেশের প্রেমে পড়ে গেছি। নোবেল বিজয়ী নারীদের উদ্যোগের অংশ হিসেবে সেবার এ দেশে আসি। সে সময় আমরা সরকার ও বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার আমন্ত্রণে কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেছিলাম, হৃদয়বিদারক অভিজ্ঞতা হয়েছে। এবার এসেছি এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব উইমেনের সিম্পোজিয়ামে অংশ নিতে। এখানে বিভিন্ন দেশ থেকে আসা অনেক নারীর সঙ্গে আলাপ হয়েছে। কথা বলেছি এই প্রতিষ্ঠানের ছাত্রীদের সঙ্গেও। উচ্ছল-উজ্জ্বল সব মেয়ে। সবার সামনেই দারুণ ভবিষ্যৎ। সব মিলিয়ে খুব ভালো লাগছে।

প্রথম আলো: রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শনের পর আপনিসহ নোবেল বিজয়ী তিন নারী বলেছিলেন, মিয়ানমার গণহত্যার মতো অপরাধ করেছে। এ জন্য মিয়ানমারের দায়ী ব্যক্তিদের আন্তর্জাতিক আদালতে বিচারের সম্ভাবনা আছে কি? 
তাওয়াক্কল কারমান: রোহিঙ্গা শিবিরে আমি যা দেখেছি ও শুনেছি, তা এককথায় ভয়াবহ। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী যে গণহত্যার শিকার, তা দেখছে না আন্তর্জাতিক মহল। বিশ্ব যেন চোখ বন্ধ করে আছে। রোহিঙ্গারা হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ থেকে শুরু করে এমন কোনো অপরাধ নেই, যার শিকার হয়নি। আন্তর্জাতিক মহলের কাছে আমাদের অনুরোধ, যারা এসব অপরাধের সঙ্গে জড়িত, তাদের বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। পাশাপাশি অং সান সু চির প্রতি অনুরোধ, তিনি তাঁর যথার্থ ভূমিকা পালন করবেন। অপরাধীদের বিচারের ব্যবস্থা করবেন। রোহিঙ্গাদের নিরাপদে তাদের ঘরবাড়িতে ফিরে যেতে সহায়তা করবেন। যদি তা না করেন, অপরাধের দায় তিনিও এড়াতে পারবেন না, আমরা তাঁকেও বিচারের মুখোমুখি করার দাবি জানাব।

প্রথম আলো: ২০১১ সালে ইয়েমেনের গণ-আন্দোলনের সময় আপনাকে সে দেশের মানুষ ‘বিপ্লবের জননী’ বলে আখ্যা দিয়েছে। সেই বিপ্লবের এখন কী অবস্থা? 
তাওয়াক্কল কারমান: আজও চলছে। স্বৈরশাসক আলী আবদুল্লাহ সালেহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহের শুরু। তিনি সশস্ত্র হুতি বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছেন ঠিকই, কিন্তু তাঁর পক্ষের লোকজন এখনো পাল্টা অভ্যুত্থান চালিয়ে যাচ্ছে। আমরা বিপ্লবের সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছি। একদিকে হুতি মিলিশিয়া, অন্যদিকে সৌদি আরব ও আরব আমিরাতের জোট। এই দুই পক্ষের লড়াইয়ের মাঝখানে পড়ে গেছে ইয়েমেনি জনগণ।

প্রথম আলো: কোন পক্ষ ইয়েমেনের জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে? 
তাওয়াক্কল কারমান: ইয়েমেনের জনগণ কোনো শক্তি বা বাহিনীর অধীন নয়। তারা নিজেরাই নিজেদের প্রতিনিধি।

প্রথম আলো: ইয়েমেনে এখনো হুতি, আল-কায়েদাসহ নানা বাহিনী বিভিন্ন অংশ দখল করে রেখেছে। তাদের জনসমর্থন কতটুকু? 
তাওয়াক্কল কারমান: ইয়েমেনের খুব সামান্য অংশই ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত সালেহর সমর্থকেরা নিয়ন্ত্রণ করছেন। হুতিরাও কিছু অংশ নিয়ন্ত্রণ করছে। কিন্তু জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে আবদ-রাব্বু মনসুর হাদির সরকার। তাঁর সরকারই একমাত্র বৈধ সরকার।

প্রথম আলো: আমরা কয়েক বছর ধরে ইয়েমেনের যুদ্ধের ভয়ংকর সব ছবি দেখতে পাচ্ছি। সৌদি নেতৃত্বাধীন বিমান হামলাকে আপনি অগ্রহণযোগ্য বলেছেন। এটা বন্ধ হওয়ার কি কোনো সম্ভাবনা আছে? 
তাওয়াক্কল কারমান: ইয়েমেন এক বিশাল মানবিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি। এর কারণ দুই পক্ষের লড়াই। এর এক পক্ষে সৌদি আরব ও আরব আমিরাত এবং অন্য পক্ষে ইরান। কারণ, ইরান হুতি সশস্ত্র গোষ্ঠীকে (মিলিশিয়া) সমর্থন দিচ্ছে। তারা কেবল নিজেদের মধ্যে লড়াই করছে না, আসলে তারা লড়াই করছে ইয়েমেনের বিরুদ্ধে। তারা চায় না ইয়েমেনে শান্তি ও স্থিতিশীলতা আসুক, ইয়েমেন গণতান্ত্রিক ও সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়াক। তারা ইয়েমেনের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করছে। আমরা ইয়েমেনের জনগণ বিবদমান সব পক্ষেরই বিরুদ্ধে। আমরা এদের কাউকে সমর্থন করি না।

প্রথম আলো: শান্তির কোনো সম্ভাবনা কি দেখতে পান? 
তাওয়াক্কল কারমান: অবশ্যই। আমরা একটি শান্তিপূর্ণ গণ-অভ্যুত্থান করেছি। সেই সময় আমরা রাস্তায় অস্ত্র নিয়ে দাঁড়াইনি। ফুল নিয়ে প্রতিবাদে শামিল হয়েছি, জনগণ সহিংসতা এড়িয়ে চলেছে। শান্তির সমর্থক জনগণই কিন্তু সালেহকে ক্ষমতাচ্যুত করেছিল। এতে বোঝা যায়, ইয়েমেনের জনগণ শান্তিপ্রিয়। তারা শান্তির পক্ষে থেকেছে সব সময়। তবে শান্তি মানে আত্মসমর্পণ নয়, অবিচার ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোই শান্তি। আমরা এভাবেই বিষয়টাকে দেখি। আমাদের একটা শান্তির মানচিত্র (পিস ম্যাপ) আছে। সে অনুযায়ী সৌদি আরব ও ইরান-সমর্থিত মিলিশিয়াদের অবিলম্বে যুদ্ধ বন্ধ করতে হবে। সব বিদেশি শক্তিকে ইয়েমেনের ভূখণ্ড ছেড়ে চলে যেতে হবে। সরকারের কাছে সব পক্ষকে অস্ত্র সমর্পণ করতে হবে। তারপর রাজনৈতিক প্রক্রিয়া শুরু করা যাবে, সংবিধানের জন্য গণভোটের আয়োজন করতে হবে। তারপর আসবে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়।

প্রথম আলো: আরব বসন্তের পর ইয়েমেনের মতোই মধ্যপ্রাচ্যের সব দেশের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থার অবনতি হয়েছে। আরব বসন্তের কি কোনো শুভ প্রভাব পড়েছে? 
তাওয়াক্কল কারমান: আরব বসন্ত এখনো শেষ হয়নি। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বহু বছর ধরে একনায়ক শাসকেরা জনগণের ওপর নিপীড়ন চালিয়েছে। এ কারণে স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের জন্য জনগণ পথে নামতে বাধ্য হয়েছে। এর ফলে তিউনিসিয়ায় বেন আলি, ইয়েমেনে আলি সালেহ, লিবিয়ায় মুয়াম্মার গাদ্দাফি ও মিসরে হোসনি মোবারককে ক্ষমতা থেকে বিদায় নিতে হয়েছে।

প্রথম আলো: কিন্তু তারপর? 
তাওয়াক্কল কারমান: তারপর গণতন্ত্র ও সুশাসন যে আসেনি তার কারণ, প্রতিটি দেশেই প্রতিবিপ্লব হয়েছে। কোথাও সামরিক বাহিনী, কোথাও মিলিশিয়ারা প্রতিবিপ্লবের নেতৃত্ব দিয়েছে। স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক শক্তির ষড়যন্ত্রের ফলে এমনটা ঘটছে। তারা মনে করে, মধ্যপ্রাচ্যের লোকজন গণতন্ত্রের জন্য উপযুক্ত নয়। কিন্তু এটা সত্য নয়।

প্রথম আলো: আপনি একাধারে রাজনীতিবিদ, মানবাধিকারকর্মী ও সাংবাদিক। তা ছাড়া বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বকনিষ্ঠ নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী। আপনার ভাই তারিক কারমান ইয়েমেনের অন্যতম প্রধান কবি। আপনাদের প্রেরণার উৎস কী? 
তাওয়াক্কল কারমান: আমার জন্ম একটা শিক্ষিত সংস্কৃতিমনা পরিবারে। আমার বাবা আবদেল সালাম কারমান ছিলেন রাজনীতিবিদ ও আইনজীবী, ইয়েমেনের সংবিধান রচয়িতাদের একজন। মন্ত্রীও ছিলেন। তিনিই আমাদের শিখিয়েছেন অন্যায়কে মেনে না নিতে। বড় মানুষ হওয়ার প্রেরণা তাঁর কাছ থেকেই এসেছে। এ ছাড়া আমার মা-ও সব সময় আমাদের অসাধ্য সাধন করতে উদ্বুদ্ধ করে গেছেন।

প্রথম আলো: আপনি একজন সাংবাদিক, পাশাপাশি উইমেন জার্নালিস্টস উইদাউট চেইনের প্রতিষ্ঠাতা। ইয়েমেনের সংবাদপত্র সম্পর্কে বলুন। নারী সাংবাদিকদেরই-বা কী অবস্থা? 
তাওয়াক্কল কারমান: একটা সময় ইয়েমেনের সংবাদমাধ্যমের স্বর্ণযুগ ছিল। তখন সবে ইয়েমেনের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের বিজয় অর্জিত হয়েছে। তখন একসঙ্গে অনেক পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছে। সংবাদমাধ্যম পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করেছে। অনেক সাংবাদিক উঠে এসেছেন তখন।

প্রথম আলো: এখন কোথায় তাঁরা? 
তাওয়াক্কল কারমান: ইয়েমেনের আর সব মানুষের মতোই তাঁরাও এখন যুদ্ধের শিকার। সাংবাদিকদের জন্য ইয়েমেন এখন সবচেয়ে বিপজ্জনক দেশ। বহু মানুষকে শুধু সাংবাদিক হওয়ার জন্যই হত্যা করা হয়েছে। নারী সাংবাদিকেরাও এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করছেন। তবে এখন ইয়েমেনের বাইরে ইয়েমেনি সাংবাদিকদের পরিচালিত অনেক টিভি চ্যানেল গড়ে উঠেছে। সেখানেও অনেক সাংবাদিক কাজ করছেন।

প্রথম আলো: আপনি শিয়া সশস্ত্র গোষ্ঠীর বিরোধিতা করেন? 
তাওয়াক্কল কারমান: মানে?

প্রথম আলো: মানে, ইয়েমেনে হুতিদের মতো শিয়া… 
তাওয়াক্কল কারমান: দেখুন, আপনি নিশ্চয় উইকিপিডিয়া থেকে এই তথ্য পেয়েছেন। এটা ঠিক নয়। আমরা সব ধরনের সাম্প্রদায়িক বিভাজন ও হানাহানির বিরুদ্ধে। আমি শিয়াদের বিরোধীও কখনো ছিলাম না। আমি হুতি সশস্ত্র গোষ্ঠীর বিরোধিতা করেছি। হুতিরা শিয়া, এটা পুরোপুরি ঠিক নয়। সেখানে সুন্নি সম্প্রদায়ের মানুষও আছে। তা ছাড়া ইয়েমেনি সরকারেও শিয়া প্রতিনিধি আছেন। শিয়া-সুন্নি মিলেই আমরা কাজ করছি।

প্রথম আলো: আপনি বাংলাদেশের নারীর ক্ষমতায়ন কী চোখে দেখেন? 
তাওয়াক্কল কারমান: বাংলাদেশকে আমার খুব ভালো লেগেছে। এ দেশে বারবার আসতে হবে আমাকে। এখানকার মানুষ অত্যন্ত সংগ্রামী। নারীরা সমানতালে কাজ করে যাচ্ছেন। এটা খুব আশার কথা। বাংলাদেশ যে অগ্রগতি অর্জন করেছে, তা ধরে রাখতে হলে সত্যিকারের গণতন্ত্রের চর্চা অব্যাহত রাখতে হবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই জারি রাখতে হবে। এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনের মতো প্রতিষ্ঠান এ দেশে গড়ে উঠেছে, যেখানে নানা দেশের মেধাবীরা জড়ো হয়েছেন। এঁরাই তো একদিন বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশের নাম ছড়িয়ে দেবেন।

প্রথম আলো: বাংলাদেশের নারীদের উদ্দেশে কিছু বলবেন? 
তাওয়াক্কল কারমান: দারিদ্র্য ও অশিক্ষার বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যান, জনজীবনে সম্পৃক্ত করুন নিজেকে। মনে রাখবেন, নিজেকে জনজীবনে সম্পৃক্ত করা খুব গুরুত্বপূর্ণ। সামাজিক, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করুন। অন্যায়-অবিচারকে মাথা পেতে মেনে নেবেন না, মানবিক বোধ ঊর্ধ্বে তুলে ধরুন। আপনাদেরই অনুসরণ করবে গোটা সমাজ।

প্রথম আলো: আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। 
তাওয়াক্কল কারমান: ধন্যবাদ।