পাহাড়ে বিভক্তির সুবিধা কারা পাচ্ছে?

‘আমাদের আবার ভালো থাকা!’ পাহাড়ি ভদ্রলোককে কুশল জিজ্ঞেস করতেই বললেন কথাটি। রাঙামাটির এই মানুষটি সজ্জন হিসেবে পরিচিত। ব্যবসায়ী—একসময় রাজনীতি করতেন। সমাজসেবামূলক কাজ করেন। কথায় হতাশার সুর স্পষ্ট। পাহাড়ে ৩ ও ৪ মে ছয়জন নিহত হওয়ার ঘটনায় উদ্বিগ্ন তিনি। ঢাকায় থাকা ছেলে রাঙামাটি যেতে চেয়েছিল। এ ঘটনার পর তিনি নিষেধ করেছেন। একটি বেসরকারি সংগঠনের সঙ্গে তিনি যুক্ত। নানিয়ারচর, বাঘাইছড়ি এলাকা থেকে ওই সংগঠনের সব কর্মীকে রাঙামাটিতে নিয়ে আসতে হয়েছে।

পাহাড়ের বিবাদমান আঞ্চলিক দলগুলোর মধ্যে হানাহানি পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষর হওয়ার পর নিয়মিত ঘটনা ছিল। মাঝে কিছুদিন এটি বন্ধ ছিল। এরপর গত নভেম্বর থেকে আবার শুরু হয়েছে। তবে সম্প্রতি দুই দফায় পাহাড়ে যা হলো, তার ভিন্ন কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। এক, গত ২০ বছরে আঞ্চলিক দলগুলোর হানাহানিতে এক দিনে বা এক ঘটনায় এত বেশিসংখ্যক মানুষ নিহত হননি। দুই, এত দিন হানাহানির শিকার হয়েছেন মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীরা। গত দুই দিনে শক্তিমান চাকমার মতো একজন উপজেলা চেয়ারম্যান এবং জেএসসের একসময়ের কেন্দ্রীয় নেতা খুন হলেন। তিনি জেএসএস থেকে ভেঙে হওয়া জেএসএসের (এমএন লারমা) কেন্দ্রীয় সহসভাপতিও ছিলেন। মারা গেছেন তপন জ্যোতি চাকমা ওরফে বর্মা। তিনি গত নভেম্বরে গঠিত ইউপিডিএফের (গণতান্ত্রিক) প্রধান ছিলেন। দুটি ঘটনা সন্ত্রাসের ব্যাপকতাই নির্দেশ করে। পাহাড়ে খুনের ধারা এখন ঊর্ধ্বমুখী। এ অবস্থা অবশ্য একদিনে হয়নি।

দুই দশকের বেশি সময় ধরে চলা সশস্ত্র আন্দোলন শেষে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। শান্তিবাহিনী যেদিন আনুষ্ঠানিকভাবে খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামে অস্ত্র সমর্পণ করে, ঠিক সেদিনই ‘দাসত্বের চুক্তি মানি না, পার্বত্য চট্টগ্রামে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন চাই’ লিখে ব্যানার তুলে ধরেছিলেন পাহাড়ি কিছু তরুণ-তরুণী। চুক্তির বিরোধিতা ধীরে ধীরে পল্লবিত হয়েছে। মূলত এ চুক্তির বিরোধিতা করে এবং ‘পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের’ দাবিতে সৃষ্টি হয় ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)। বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদনকারী পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (পিসিজেএসএস) ছাত্রসংগঠনের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরাই এ সংগঠন গড়ে তোলেন। জেএসএস প্রধান এবং পার্বত্য চুক্তির ফলে সৃষ্ট আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় সন্তু লারমা শুরু থেকেই দাবি করছেন, ইউপিডিএফ চুক্তি ও পাহাড়িদের স্বার্থবিরোধী। বিশেষ কোনো মহলের প্রণোদনায় এর সৃষ্টি।

তবে মূলত বাম ঘরানার পাহাড়ি তরুণদের সংগঠন ইউপিডিএফ সন্তু লারমার এসব অভিযোগ অস্বীকার করে। তারা বরং লারমাকেই ‘জুম্ম স্বার্থবিরোধী’ হিসেবে আখ্যায়িত করে। মুখোমুখি হয়ে পড়ে দুটি দল। এর বহিঃপ্রকাশ ঘটে সংঘাতে, খুনোখুনিতে। দুই দলের বিরোধে ২০১৬ পর্যন্ত সশস্ত্র সংঘাতে মারা যায় আট শতাধিক নেতা-কর্মী। দেশের এক-দশমাংশ এলাকায় প্রায় ১৮ লাখ মানুষের বসতি। সেখানকার অর্ধেক জনসংখ্যার কিছু বেশি মানুষের মধ্যে খুনোখুনির এ চিত্র একটি ভয়াবহ বাস্তবতারই ইঙ্গিত দেয়।

এক-এগারোর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক সংগঠন জেএসএস ভাঙনের মুখে পড়ে। সন্তু লারমার একদা ঘনিষ্ঠ এবং আঞ্চলিক পরিষদের দুই নেতা সুধাসিন্ধু খীসা ও রূপায়ণ দেওয়ানের নেতৃত্বে জেএসএস (লারমা) নামে আরেকটি দলের আত্মপ্রকাশ ঘটে। এ দলটির সঙ্গে ইউপিডিএফের শুরু থেকেই সখ্য ছিল। সৃষ্টির পর জেএসএসের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে এ দলটিও।

ইউপিডিএফের সঙ্গে জেএসসের এই ‘ভ্রাতৃঘাতী’ সংঘাত নিরসনে পাহাড়ের একাধিক সার্কেল প্রধানসহ বিভিন্ন নাগরিক সংগঠনের প্রতিনিধিদের চেষ্টা শুরু থেকেই ছিল। এ নিয়ে তারা পাহাড়ে বা ঢাকায় এসে সমঝোতার চেষ্টা করেছেন। তবে সেই চেষ্টা সুফল পায়নি।

২০১৬ সালের মাঝামাঝি সময়ে বাঘাইছড়িতে পাঁচজন পাহাড়ি নিহত হন। এরপরই প্রধানত মাঠপর্যায়ে দুই দলের মধ্যে অলিখিত সমঝোতা হয় নাগরিক সংগঠনগুলোর চাপেই। পাহাড়ে শান্তি আনতে বছর দু-এক আগে রাঙামাটিতে নাগরিকদের এক বিশাল মানববন্ধন হয়। নারী-পুরুষনির্বিশেষে স্বতঃস্ফূর্ত ছিল সেই সমাবেশ। দুই বা বলতে হবে তিন দলের মধ্যে সংঘাত বন্ধ হলে স্বস্তি নামে পাহাড়িদের মধ্যে। তিন দলের প্রধানদের সম্মতিতেই তিন দল এই ‘অনাক্রমণ’ চুক্তি মোটামুটি মেনে চলেছে।

আপাত শান্তির অবস্থার মধ্যে গত বছরের নভেম্বরে ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) নামে আরেকটি দলের আত্মপ্রকাশ ঘটে। ইউপিডিএফ অবশ্য এরপরই বলে, এই দল যারা করেছে, তারা বহিষ্কৃত। আর নতুন গঠিত ইউপিডিএফের (গণতান্ত্রিক) নেতারা দাবি করেন, মূল দলটির ভেতরে গণতন্ত্রের চর্চা নেই বলেই তাঁরা নতুন দল করলেন।

দল গঠনের পরপরই গত ৫ ডিসেম্বর রাঙামাটির নানিয়ারচরে অনাধিরঞ্জন চাকমা নামে এক ইউপিডিএফ কর্মী নিহত হন। দলটি এ ঘটনায় ইউপিডিএফকে (গণতান্ত্রিক) দায়ী করে। পাহাড়ের অভিযুক্ত সংগঠনগুলো এমন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সাধারণত যা বলে, নতুন গঠিত দলটিও সেই ভাষা প্রয়োগ করে। তারা এর দায় অস্বীকার করে এবং অনাধিরঞ্জন হত্যার ঘটনাকে ইউপিডিএফের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের ফল বলে অভিহিত করে।

৩ জানুয়ারি খাগড়াছড়ি শহরে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হয় ইউপিডিএফের শীর্ষ নেতা মিঠুন চাকমাকে। ইউপিডিএফ এই হত্যার জন্য আবারও ইউপিডিএফ-গণতান্ত্রিককে দায়ী করে। দলটি তা অস্বীকার করে। ২২ এপ্রিল পর্যন্ত ইউপিডিএফের নয় কর্মী নিহত হন। প্রতিটি ঘটনায় দলটি ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিককে দায়ী করে। এর পাশাপাশি জেএসএসের (লারমা) দুই কর্মী নিহত হন।

গত ১৮ মার্চ ইউপিডিএফ-সমর্থিত হিল উইমেন্স ফেডারেশনের দুই নেত্রী অপহৃত হন। ১৮ এপ্রিল তাঁরা ছাড়া পান। ওই অপহরণের জন্য গণতান্ত্রিককে দায়ী করে ইউপিডিএফ। দুই নারী অপহরণের মামলার প্রধান আসামি ছিলেন নানিয়ারচরের নিহত উপজেলা চেয়ারম্যান শক্তিমান চাকমা। পরদিন তাঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যাওয়ার পথে নিহত হন ইউপিডিএফ নেতা তপনজ্যোতি চাকমা বর্মা।

খুনের মতো একটি অপরাধ হলে এর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের ধরতে হবে, তাদের বিচার হবে—এটাই স্বাভাবিক নিয়ম। পার্বত্য চট্টগ্রামে অন্তর্দ্বন্দ্বে যতজন খুন হয়েছে, প্রতিটিতেই এই স্বাভাবিক নিয়মের ব্যত্যয় লক্ষ করা গেছে। গত চার মাসে যে ২১ হত্যার ঘটনা ঘটেছে, এর একটির সঙ্গে জড়িত কাউকে ধরতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। খাগড়াছড়ির জেলা পুলিশ সূত্র গত সপ্তাহে স্বীকার করেছে, কাউকে ধরা যায়নি। অতীত অভিজ্ঞতা বলে, যাবেও না। সর্বশেষ ছয় খুনের পর রাঙামাটির এসপি বলেছিলেন, চিরুনি অভিযান শুরু হয়েছে। চিরুনির দাঁতের ফাঁকগুলো বোধকরি পাহাড়ে অনেক বড়। তাই এর দাঁতে কেউ আটকায় না।

পাহাড়ে বিবাদমান দলগুলো বারবারই একে অন্যের বিরুদ্ধে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগ করে। বিভাজনের জন্যই সরকারি কোনো চক্র বিশেষ সময়ে বিশেষ এলাকায় কোনো গোষ্ঠীকে সমর্থন করে বা উৎসাহ জোগায় অনিয়মতান্ত্রিক কর্মকাণ্ডে—এমন অভিযোগ বরাবর রয়েছে। তবে কী কোনো গোষ্ঠী সত্যিই চায়, পাহাড় অশান্ত থাকুক?

নিরন্তর খুনোখুনি, বিচারহীনতা পাহাড়ি সমাজে নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি করেছে। সামন্ত শাসিত হলেও পাহাড়ি সমাজের ভেতরে সমতার লক্ষণ সব সময় ছিল। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে, পার্বত্য চুক্তির আগে স্বায়ত্তশাসন ও অধিকারের দাবিতে দুই পাহাড়ি বন্ধুর মধ্যে সখ্য দেখেছি। একসঙ্গে মিছিল করতে দেখেছি। পরে পাহাড়ে গিয়ে একজনের বিরুদ্ধে আরেকজনকে হত্যার অভিযোগ শুনেছি। এমন ঘটনা একটি-দুটি নয়। প্রাণ গেছে কয়েক শ মানুষের। সঠিকভাবে বললে, গত দুই দশকে নিজেদের অন্তর্দ্বন্দ্বে নিহত ব্যক্তিরা সবাই তরতাজা তরুণ।

সংঘাত, হত্যার মতো বিষয় নিরসনে শৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসনের দায় নিশ্চয়ই আছে। তবে যে সংগঠনগুলো এর সঙ্গে জড়িত, তাদের দায়ও অস্বীকার করার উপায় নেই। পাহাড়িদের প্রতিটি দলই অন্যের বিরুদ্ধে আপসকামিতার অভিযোগ এনেছে। দলগুলোর নেতৃত্বের একগুঁয়েমি মনোভাব নিয়ে পাহাড়ের অনেকেই অসন্তুষ্ট। সাধারণ মানুষদের অনেকেই একাধিক শক্তির আবদার মেটাতে নাকাল। খাগড়াছড়ির দীঘিনালার এক স্কুলশিক্ষক বছর খানেক আগে বলছিলেন, ‘শান্তি বাহিনী যখন লড়াইয়ে ছিল, তখন এক পার্টিকে চাঁদা দিতে হতো। এখন দিতে হয় তিন গ্রুপকে।’ এ বাস্তবতা হয়তো পাহাড়ের সর্বত্র।

পাহাড়ি নেতৃত্ব যে বিভেদকামী শক্তির কথা বলেন, নিজেদের হট্টগোলে সেই শক্তি তার পূর্ণ সুযোগ নিয়েছে তা স্পষ্ট। প্রশ্ন হলো, সুযোগ কী দেওয়া হয়নি?

যে স্বায়ত্তশাসিত আঞ্চলিক পরিষদটি হয়েছে ২০ বছর আগে, তাতে আজ পর্যন্ত কোনো নির্বাচন হয়নি। স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞদের কাছে উদাহরণ সৃষ্টিকারী তিন পার্বত্য জেলা পরিষদও চলছে যখন যে সরকার তাদের পছন্দের লোক দিয়ে। এ প্রতিষ্ঠানগুলো সচল হলে, গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচন হলে দৃশ্যপট কি অন্য রকম হতো না?

কয়েক দিন আগে পাহাড়ি সরকারি কর্মকর্তা গল্প করলেন। পাহাড়ে এক কলাচাষি খেতের কলা নিয়ে এসেছেন বাজারে। তিনি ১০০ টাকার নিচে কলা বেচবেনই না। মহাজন দাম করলেন ৬০ টাকা। দরিদ্র চাষি তাতে রাজি নন। কিছুক্ষণ পর মহাজন সেই কলা ৭০ টাকা দাম করলেন। চাষি তবুও রাজি নন বিক্রি করতে। বেলা প্রায় শেষ, বাজার ভেঙে যাচ্ছে। মহাজন আর আসছে না দেখে কলাচাষি নিজেই গেলেন তার কাছে। এখন ওই ব্যবসায়ী সুযোগ পেয়ে বসলেন। বললেন, যতটা প্রয়োজন ছিল তা কিনে ফেলেছি। এখন ৪০ টাকার বেশি দিতে পারব না। উপায়ন্তর না দেখে চাষি কষ্টে উৎপাদিত ফসল অল্পেই বিক্রি করলেন।

গল্পের সারবস্তু এমন, পার্বত্য চুক্তির পর পাহাড়ি মানুষের দর-কষাকষির জায়গা দিন দিন কমেছে। দুর্বল হয়েছে পাহাড়ের রাজনৈতিক সংগঠন বা শক্তি। এর পেছনে ইন্ধন তো ছিলই, ছিল কূটচাল। তবে এর বিপরীতে নিজেদের যূথবদ্ধ, গণতান্ত্রিক প্রচেষ্টার ঘাটতি ছিল। এখন যেকোনো ছোট স্বার্থের কাছে জলাঞ্জলি দিতে হচ্ছে অনেক শ্রমের ফসলকে।

পার্থ শঙ্কর সাহা: সাংবাদিক