মুক্তি নেই, প্রতিবাদ থাকুক

জেরুজালেমে আমেরিকান দূতাবাসের প্রস্তরফলক উন্মোচন করেন ট্রাম্পকন্যা ইভানকা
জেরুজালেমে আমেরিকান দূতাবাসের প্রস্তরফলক উন্মোচন করেন ট্রাম্পকন্যা ইভানকা

নিউইয়র্ক টাইমস-এ ১৫ মে প্রকাশিত ছবি দুটির দিকে তাকিয়ে থাকি। জেরুজালেমে আমেরিকান দূতাবাসের উদ্বোধন হচ্ছে। প্রস্তরফলক উন্মোচিত হচ্ছে। ফলকে বড় করে লেখা ডোনাল্ড ট্রাম্প। মাত্র ৪০ মাইল দূরে ফিলিস্তিনি প্রতিবাদকারীদের ওপর ইসরায়েলি সৈন্যদের গুলিতে মারা গেছে ৫২ জন। 

ফেসবুকে একটা খবর ছড়িয়েছে: ফাদি হাসান আবু সালাহ নামের একজন ফিলিস্তিনি তরুণ, যিনি এর আগে ২০১৪ সালের গাজা যুদ্ধে ঊরুর নিচ থেকে দুই পা হারিয়েছেন, দড়ির মাথায় থলেতে পাথর ভরে ছুড়ে মারছেন সৈন্যদের দিকে, তিনি জেরুজালেমে আমেরিকান দূতাবাস উদ্বোধনের প্রতিবাদ করতে গিয়ে ইসরায়েলি সৈন্যদের গুলিতে নিহত হয়েছেন। আরেক মাধ্যমে বলা হয়েছে, এই ভাইরাল হয়ে যাওয়া খবরটা সত্য নয়। তবে বিলেতের ইনডিপেনডেন্ট পত্রিকায় আরেকটা খবর পাওয়া গেল। এটা ২০১৭ সালের খবর। ইব্রাহিম আবু তারায়া নামের দুই পা-হারা একজন প্রতিবাদকারী ইসরায়েলি সৈন্যদের গুলিতে মারা গেছেন। 
সারা পৃথিবীতে কত যে অন্যায়, কত যে আগ্রাসন, কত যে মানুষ হত্যা, শিশুহত্যা। কিছুদিন আগে একটা কবিতা লিখেছিলাম: 
আম্মু, আমাকে মেরে ফেলো, দোহাই
(সিরিয়ার শিশুদের জন্য এক অক্ষমের এক ফোঁটা অশ্রু)

আম্মু, আমাকে বোমার নিচে রাখো, 
আব্বু, ওই বোমার স্প্লিন্টারটা আমার করোটিতে ঢুকতে দাও, 
আমি ওপারে যাব
ওপারে বেহেশত
সেখানে রুটি আছে মা...
এই ক্ষুধা আমি আর সইতে পারছি না
আম্মু, আমার কপাল থেকে রক্ত ঝরতে দাও
রক্ত ঝরতে ঝরতে আমি ফ্যাকাশে হব, 
আমার চোখ বন্ধ হবে
আমার আর ব্যথা থাকবে না
আমি ওই পারে যাব
ওই পারে বোমারু বিমানের শব্দ নেই
আম্মু, আমাকে ঘুমাতে দাও
এখানে আমরা ঘুমাতে পারি না

ফিলিস্তিনি প্রতিবাদকারীদের ওপর ইসরায়েলি সৈন্যদের হামলা
ফিলিস্তিনি প্রতিবাদকারীদের ওপর ইসরায়েলি সৈন্যদের হামলা

এই কবিতার উৎসও ছিল বিলেতের কাগজে প্রকাশিত খবর। সিরিয়ার শিশুরা বলছে, ক্ষুধার জ্বালা সইতে পারছি না, আম্মা, আমাদের মেরে ফেলো, বেহেশতে পাঠিয়ে দাও। 
আমাদের বাড়ির কাছেই যে অমানবিকতা, হিংস্রতা, মানবতার দলন চলছে, কত কত রোহিঙ্গা কী অমানবিক অত্যাচার নিপীড়নের শিকার হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হলো, সভ্য পৃথিবীর নিরাপদ তন্দ্রা তাতে মোটেও ব্যাহত হলো কি? খবরের কাগজে পড়লাম, যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারের 
ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে চায়, রাশিয়া আর চীন চায় না। 
আরেকটা খবরে পড়লাম, স্পেনে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে বিবৃতি দিয়েছেন ১৯টি দেশের পৃথিবীখ্যাত বুদ্ধিজীবীরা, তাঁরা বলছেন স্পেন তার গণতন্ত্রের সবচেয়ে অন্ধকার সময় পার করছে। তাঁরা কাতালীয় বন্দীদের মুক্তি চান। এই বিবৃতিদাতাদের মধ্যে আছেন নোয়াম চমস্কিও। 
নোয়াম চমস্কি আমেরিকান বুদ্ধিজীবী, ভাষাবিজ্ঞানী। নিজে ইহুদি হলেও ইসরায়েলি নিপীড়নের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি প্রতিবাদী তিনি। 
সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়েছে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের শাসনের ১৪ মাস হলো, ট্রাম্পের শাসন খারাপ হবে, অনুমান করা হয়েছিল, কতটা খারাপ হলো? চমস্কি বলেছেন, খুব খারাপ। তিনি বলছেন, এটা একটা মহাদুর্যোগ। এক হলো, পারমাণবিক যুদ্ধের শঙ্কা বেড়েছে, মহাপ্রলয়ের মুহূর্তটা মধ্যরাতের দুই মিনিট আগে চলে এসেছে। দুই. জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই পৃথিবী বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়ে গেছে। 
আমরা জানি, চমস্কি আশা দেখতেন সাধারণ মানুষের উত্থানে, প্রতিবাদী মিছিলে। যুদ্ধের বিরুদ্ধে যখন আমেরিকায় বিলেতে লাখো মানুষ পথে নেমেছিল, তিনি আশাবাদী হয়েছিলেন। কিন্তু সেসব তো ফল দেয়নি। এবার দেখা গেল, অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট, হ্যাশ ট্যাগ মি টু এ ধরনের আন্দোলন হয়েছে। তা থেকেও কোনো ফল আসছে না। তাহলে আশা কোথায়? চমস্কি সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীকে বলেছেন, ‘আশা হলো আপনার মতো মানুষ। আপনি যে এই বিষয়টা নিয়ে ভাবছেন, সেখানেই আশা।’ 
আসলেই কি আর আশা আছে? ন্যায়বিচার ও মানবাধিকারের যেসব ঘোষণা পৃথিবীতে দিয়ে আসা হয়েছে বড় বড় মুখ করে, তা নিয়ে আর কোনো বড় দেশ কি ভাবিত? সব দেশই দেখা যাচ্ছে কেবল নিজের স্বার্থ বোঝে। মিয়ানমারে তাদের স্বার্থ আছে বলে রাশিয়া-চীনের মতো দেশগুলো সে দেশের সামরিক বাহিনীর নৃশংস নিপীড়নকেও সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। সিরিয়া প্রশ্নে বৃহৎ শক্তিগুলো নিজেদের স্বার্থের খেলা খেলছে। 
সেখানে একজন ব্যক্তি মানুষ-আপনি আমি-আমরা কী করব? রবীন্দ্রনাথের কথাটা স্মরণে আসে, অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে, তব ঘৃণা যেন তারে তৃণসম দহে। আমরা অন্যায়কে ঘৃণা করতে পারি। কিন্তু তা দিয়ে তো পৃথিবীর কোনো বড় বিপর্যয় আমরা রোধ করতে পারছি না। 
মাহাথির মোহাম্মদ একবার ওআইসির একটা সম্মেলনে একটা কথা বলে আমেরিকানদের বিরাগভাজন হয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ইসরায়েলের অতি অল্প সংখ্যক নাগরিকের চেয়ে অনেক অনেক বেশি জনসংখ্যা নিয়ে মুসলিম দেশগুলো পেরে ওঠে না, কারণ ইসরায়েলিরা জ্ঞানে-বিজ্ঞানে এগিয়ে, তারা বিজ্ঞানের নোবেল পুরস্কার পেয়েছে বহুগুণ বেশি। আর মুসলিমদের প্রতিক্রিয়া হলো ক্রোধ। ক্রোধের বশে তারা যা করে, তাতে আরও ক্ষতি হয়, তখন তারা আরও ক্রোধান্বিত হয়, আরও নিজেদের ক্ষতি করে ফেলে। মাহাথির মুসলিম বিশ্বকে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা করতে পরামর্শ দিয়েছিলেন। 
পৃথিবীতে এত অন্যায় দেখি, এত মৃত্যু দেখি, কিন্তু কোনো প্রতিকার দেখি না। খোদ আমেরিকানরা বলছে, তাদের গণতন্ত্র ত্রুটিপূর্ণ, তাদের ভোট জনমতের প্রকৃত প্রতিফলন নয়। রাশিয়ায় পুতিন কত বছর ধরে ক্ষমতায়। এসব দিকে দেখব, নাকি দেখব নিজের ঘরের দিকে? দুই দিন আগে একজন ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা, তিনি একটা বেসরকারি সিকিউরিটি এজেন্সির সঙ্গে যুক্ত। তিনি বললেন, তারা সিকিউরিটি গার্ডদের মাসিক বেতন দেন পাঁচ হাজার টাকা। কত বৈষম্য! কতটা বৈষম্য থাকলে ২০১৮ সালে বিনে পয়সার ইফতার-পণ্য নিতে হাজার হাজার নারী উপস্থিত হন, আর পদপিষ্ট হয়ে মারা যান ৯ জন? 
তাহলে আমাদের কি মুক্তি সত্যি সত্যি নেই? পৃথিবী কোনো দিনও সুন্দর হবে না, ন্যায়বিচারভিত্তিক হবে না! আমাদের দেশটায় সুশাসন আসবে না, বৈষম্যমুক্তি ঘটবে না? কত পুরোনো কথা, মানুষ জন্ম নেয় স্বাধীনভাবে, কিন্তু সবখানেই সে শিকলবন্দী। আর মিশেল ফুকোর কথাটাকে সরল করে বলা যায়, আমরা প্রত্যেকে ক্ষমতাকাঠামোর দ্বারা বন্দী, একটা ভেঙে বেরিয়ে আমরা আরেকটা বন্দিত্বে গিয়ে পৌঁছাই, আমাদের মুক্তি নেই, কিন্তু তবুও প্রগতিশীলের কর্তব্য হলো ক্রমাগত ক্ষমতাকাঠামোর বিরুদ্ধে লড়াই করে যাওয়া। 
এ অবস্থায় যখন কেউ বলে, শিক্ষার্থীদের ‘বৃত্তিমূলক’ শিক্ষা দিন, তখন মনে হয়, এই বিশ্বশোষণতন্ত্রের টাইমমেশিনের একটা স্ক্রু হওয়ার শিক্ষাই কি শিক্ষা? 
তবু শিক্ষাই হয়তো একমাত্র দাওয়াই। মানুষের ওপর বিশ্বাস হারানো পাপ। সম্মিলিত মানুষ এবং ব্যক্তি মানুষ। কোনো একজন মানুষের বড় ভাবনা আমাদের নাড়া দেবে, কোনো একটা মানুষের ডাকে পৃথিবীর কোনো প্রান্তের মানুষ জেগে উঠে ধাক্কা দেবে, অচলায়তন কিছুটা ভাঙবে। হয়তো নতুন কোনো অচলায়তন গড়ার জন্য।

আনিসুল হক: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক