দুই সিটির তিন বছর

পঞ্জিকার হিসাবে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মেয়াদ তিন বছর পার হলেও প্রতিশ্রুতির সিংহভাগই অপূর্ণ রয়ে গেছে। নির্বাচনের আগে তাঁরা নগরবাসীর সব সমস্যার সমাধানের কথা বলেছিলেন, ঢাকাকে তিলোত্তমা নগর হিসেবে গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। তিন বছর পর এসে দেখা যাচ্ছে নগরবাসীর সমস্যা আরও বেড়েছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিবেদনে ঢাকাকে বসবাস অযোগ্য নগরীগুলোর মধ্যে প্রথম দিকে স্থান দেওয়া হয়েছে। আমাদের জিজ্ঞাস্য, সরকার বা সিটি করপোরেশনের কর্তাব্যক্তিরা তাহলে করছেনটা কী।

দায়িত্ব গ্রহণের তিন বছর উপলক্ষে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন সংবাদ সম্মেলন করে উন্নয়নের যে দীর্ঘ ফিরিস্তি দিলেন, তাতে নগরবাসী আশ্বস্ত হওয়ার মতো কিছু পায়নি। তাঁর দাবি অনুযায়ী তিন বছর আগে নাকি দক্ষিণের সব রাস্তাঘাট ভেঙেচুরে একাকার হয়ে গিয়েছিল, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ভেঙে পড়েছিল, মশা মারার ওষুধ মজুত ছিল না, সড়কবাতি জ্বলত না। এটা যদি সত্য হয়ে থাকে তাহলে তাঁর পূর্বসূরি এবং তাঁদের নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হয়। ব্যর্থতার সব দোষ পূর্বসূরিদের কাঁধে চাপানোর রাজনৈতিক সংস্কৃতি এখন জাতীয় পর্যায় থেকে স্থানীয় সংস্থায় সংক্রমিত হয়েছে।

যে শহরে দেড় কোটি মানুষের বাস, সেই শহরের ব্যবস্থাপনা নিয়ে যথেচ্ছাচার করার অধিকার কারও নেই। দক্ষিণের মেয়র নগরের ভাঙাচোরা বেহাল রাস্তা, ফুটপাত, নর্দমা সংস্কার ও মেরামত, এলইডি বাতি সংযোজন, পাবলিক টয়লেট, পার্ক, খেলার মাঠ, কবরস্থান, আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ভবন (এসটিএস) নির্মাণ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উন্নয়নের কৃতিত্ব দাবি করেছেন। কিন্তু নগরবাসী দেখছে সামান্য বৃষ্টি হলেই শহরে জলাবদ্ধতা হয়, যানজটে নাকাল সড়কে অবিরাম খোঁড়াখুঁড়ি চলে। এ থেকে উত্তরণের পথ বাতলাতে পারেননি তিনি। তাঁর আন্তরিক প্রয়াস সত্ত্বেও ফুটপাত দখলমুক্ত হয়নি।

উল্লেখ্য, ঢাকা উত্তরের মেয়র আনিসুল হক প্রভাবশালীদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে যে কিছু অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করেছিলেন, তার সুফল মানুষ পেয়েছে। বিশেষ করে তেজগাঁও, গাবতলী ও আমিনবাজার থেকে অবৈধ ট্রাক-বাসস্ট্যান্ড তুলে দিয়েছেন, যা অতীতে কেউ করার সাহস পাননি। পরিবহনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনাসহ আরও কিছু পদক্ষেপ নিয়েছিলেন উত্তরের মেয়র। কিন্তু অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের বিষয়, সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের আগেই তিনি গত বছর ৩০ নভেম্বর মারা যান।

নগরের জনজীবনের ভোগান্তি কমাতে হলে প্রথমেই দুই সিটি করপোরেশনকে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে হবে। এরপর সংশ্লিষ্ট সেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে বসে একটি সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা নিতে হবে। যেখানে ৪৭টি সেবা প্রতিষ্ঠান নগরবাসীর সেবায় নিয়োজিত, সেখানে এককভাবে সিটি করপোরেশন সমস্যার সমাধান করতে পারবে না। বহু বছর আগে বড় বড় শহরের ব্যবস্থাপনার জন্য নগর সরকার গঠনের দাবি উঠেছিল। কিন্তু এ বিষয়েও আগের ও পরের সব সরকারই নিশ্চুপ। ক্ষমতার মুঠো কেউ আলগা করতে চান না। অবিভক্ত ঢাকার সাবেক মেয়র মোহাম্মদ হানিফের সময়ে নগরের সেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজে সমন্বয়ের জন্য স্থানীয় সরকারমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি কমিটি করা হলেও তার ধারাবাহিকতা লক্ষ করা যায়নি।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) উপনির্বাচনের বিষয়টিও উপেক্ষণীয় নয়। আনিসুল হকের মৃত্যুর পর নির্বাচন কমিশন (ইসি) সেখানে মেয়র পদে উপনির্বাচন ও নতুন ওয়ার্ডগুলোতে নির্বাচনের উদ্যোগ নিয়েছিল। কিন্তু আইনি জটিলতার কারণে সেটি স্থগিত রয়েছে। ইসির উচিত হবে অবিলম্বে এই আইনি জটিলতা কাটিয়ে উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচন নিশ্চিত করা। সংবিধান অনুযায়ী স্থানীয় সরকার সংস্থা পরিচালিত হতে হবে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি দ্বারা। তাহলে ঢাকা উত্তরের মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি সিটি করপোরেশনের মেয়র পদ কেন মাসের পর মান শূন্য থাকবে?