তাকওয়ার মাস রমাদান

হিদায়াত মানবজীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সুরা ফাতিহায় মানুষকে হিদায়াতের প্রার্থনা শিখিয়েছেন: ‘ইহদিনাছ ছিরাতল মুছতাকিম’ অর্থাৎ আমাদের সঠিক সরল পথ দেখান। (সুরা-১ ফাতিহা, আয়াত: ৪)।

এই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতেই ত্রিশ পারা কোরআন নাজিল করা হয়। এই জন্যই সুরা ফাতিহাকে ‘উম্মুল কোরআন’ বা কোরআন বলা হয়। আল্লাহ তাআলা বললেন: ‘হুদাল লিল মুত্তাকিন’ অর্থাৎ এই কোরআন মুত্তাকিদের জন্য হিদায়াত বা সঠিক সরল পথনির্দেশ। (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ২)। এতে প্রতীয়মান হয়, তাকওয়া হলো হিদায়াত পাওয়ার জন্য শর্ত।

রমজান মাস তাকওয়া অর্জনের মাস। রমজান মাসের রোজার প্রধান উদ্দেশ্য হলো তাকওয়া বা খোদাভীতি অর্জন করা। আল্লাহ তাআলা বলেন: ‘হে মুমিনগণ! তোমাদের জন্য রোজা ফরজ করা হলো, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্বে যারা ছিল তাদের প্রতিও; যাতে করে তোমরা মুত্তাকি হতে পারো।’ (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ১৮৩)।

তাকওয়া ইসলামের একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। একজন প্রকৃত মুমিন তাকওয়া দ্বারাই পরিচালিত হন। তাকওয়া মানুষকে পাপ থেকে দূরে রাখে এবং সৎকাজে অনুপ্রাণিত করে। কোরআন করিমে বলা হয়েছে: ‘তোমরা যারা ইমান এনেছ, তারা তাকওয়া অর্জন করো।’ (সুরা-৩৩ আহজাব, আয়াত: ৭০)।

আল্লাহ তাআলা আরও বলেন: ‘যারা ইমান আনল এবং তাকওয়া লাভ করল, তারা আল্লাহর বন্ধু; তাদের কোনো ভয় নেই, দুশ্চিন্তাও নেই।’ (সুরা-১০ ইউনুস, আয়াত: ৬২)। তাকওয়া মুমিনের জীবনে এক অপরিহার্য অংশ, যা মানুষকে আত্মিক উন্নয়নের পথে পরিচালিত করে এবং নৈতিক অধঃপতন থেকে রক্ষা করে।

তাকওয়া, তাজকিয়া ও ইহসান ইসলামি শরিয়তের সর্বোচ্চ তিনটি ধাপ। এগুলো শরিয়তের অভ্যন্তরীণ অংশ বা প্রকৃত উদ্দেশ্য। তাকওয়া অর্থ সাবধান হওয়া, সতর্কতা অবলম্বন করা, ভয় করা, বেছে চলা, পরিহার করা ও দূরে থাকা ইত্যাদি। পরিভাষায় তাকওয়া হলো, আল্লাহ ও রাসুল (সা.) কর্তৃক নিষিদ্ধ বিষয়াবলি থেকে দূর থাকা। তাকওয়ার মূল কথা হলো আল্লাহর প্রেম ও ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হওয়ার ভয়ে সদা ভীত ও সতর্ক থাকা এবং নবীজি (সা.)-এর সুন্নত পালনের মাধ্যমে আল্লাহর মহব্বত লাভের আশায় সদা সচেষ্ট, উদ্গ্রীব ও উৎকণ্ঠিত থাকা।

তাজকিয়া অর্থ সূচিতা, পবিত্রতা, মানোন্নয়ন, শ্রীবৃদ্ধি ইত্যাদি। পরিভাষায় তাজকিয়া হলো আত্মশুদ্ধি, অভ্যন্তরীণ পবিত্রতা, আত্মিক উন্নতি, চারিত্রিক উৎকর্ষ ইত্যাদি। মূলত তাজকিয়া হলো, ষড়্রিপু তথা-কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্যকে নিয়ন্ত্রিতভাবে ব্যবহার করা এবং মানবচরিত্রের নেতিবাচক গুণাবলি যথা-লালসা, অন্যায় বাসনা, পরনিন্দা, মিথ্যা, হিংসা, পরশ্রীকাতরতা, আত্মপ্রচার, আত্ম-অহংকার, কার্পণ্য ইত্যাদি হতে মুক্ত হওয়া।

তাজকিয়া মানবজীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। একজন মোমিনের প্রকৃত সাফল্য এই তাজকিয়ার ওপরই নির্ভর করে। আল্লাহ তাআলা বলেন: ‘প্রকৃত তারাই সফল হলো, যারা আত্মশুদ্ধি অর্জন করল।’ (সুরা-৯১ শামছ, আয়াত: ৯)। তাজকিয়া মুমিন জীবনে লক্ষ্য অর্জনের অনন্য
পাথেয়, যা মানুষকে উন্নয়নের চরম শিখরে পৌঁছাতে সাহায্য করে।

রমজান হলো তাজকিয়া বা আত্মশুদ্ধির জন্য অনুকূল ও সহায়ক। আর ওহি ও কিতাব নাজিলের উদ্দেশ্যও হলো তাই। হজরত ইব্রাহিম (আ.) দোয়া করেছিলেন এই বলে: ‘হে আমাদের পরওয়ারদেগার! তাদের মধ্যে থেকেই তাদের নিকট একজন পয়গম্বর প্রেরণ করুন, যিনি তাদের কাছে আপনার আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করবেন, তাদেরকে কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেবেন এবং তাদের পবিত্র করবেন। নিশ্চয় আপনিই পরাক্রমশালী হিকমাতওয়ালা।’ (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ১২৯)।
মহান প্রভু বলেন: ‘আল্লাহ ইমানদারদের ওপর অনুগ্রহ করেছেন যে তাদের মাঝে তাদের নিজেদের মধ্য থেকে নবী পাঠিয়েছেন। তিনি তাদের জন্য তাঁর আয়াতসমূহ পাঠ করেন; তাদেরকে পরিশোধন করেন এবং তাদেরকে কিতাব শিক্ষা দেন।’ (সুরা-৩ আলে ইমরান, আয়াত: ১৬৪)।

মহান আল্লাহ তাআলা আরও বলেন: ‘তিনিই উম্মিদের মধ্য থেকে একজন রাসুল প্রেরণ করেছেন, যিনি তাদের কাছে পাঠ করেন তাঁর আয়াতসমূহ, তাদেরকে পবিত্র করেন এবং শিক্ষা দেন কিতাব ও হিকমাত।’ (সুরা-৬২ জুমুআ, আয়াত: ২)।

আল্লাহ তাআলা আরও বলেন: ‘যেমন, আমি পাঠিয়েছি তোমাদেরই মধ্য থেকে তোমাদের জন্য একজন রাসুল, যিনি তোমাদের নিকট আমার বাণীসমূহ পাঠ করবেন এবং তোমাদের পবিত্র করবেন; আর তোমাদের শিক্ষা দেবেন কিতাব এবং শিক্ষা দেবেন এমন বিষয় যা কখনো তোমরা জানতে না।’ (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ১৫১)।

মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী : বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতির যুগ্ম মহাসচিব ও আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম-এর সহকারী অধ্যাপক
smusmangonee@gmail, com