বিনা যুদ্ধে জেতা নির্বাচনের বৈধতা

কর্ণাটকের মুখ্যমন্ত্রীর শপথ নিয়ে ভারতের সুপ্রিম কোর্টের মধ্যরাতের আদেশের পরিণামে ক্ষমতাসীন বিজেপিদলীয় ৭২ ঘণ্টার এক মুখ্যমন্ত্রীর লজ্জাজনক বিদায়, তার আগে পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত নির্বাচনে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেসের ৩৪ শতাংশ আসনে ‘বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়’ নির্বাচিত ব্যক্তিদের প্রজ্ঞাপন জারি স্থগিত করা এবং পঞ্চায়েত নির্বাচনে অনলাইন মনোনয়নপত্র দাখিলে কলকাতা হাইকোর্টের বিরল আদেশগুলো সত্যি চমকপ্রদ। নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় প্রতিবেশী উচ্চ আদালতের হস্তক্ষেপগুলো আমাদের নির্বাচনী বছরে বেশ উৎসাহের সঙ্গেই পর্যবেক্ষণের দাবি রাখে।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ১৯ মে বলেছেন, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার ট্র্যাপে ফেলার ঘটনা বাংলাদেশে আর ঘটবে না। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেই ট্র্যাপে আটকা পড়েছেন! এর বৈধতার প্রশ্নে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টে আগামী ৩ জুলাই শুনানির দিনক্ষণ স্থির আছে। একটি গণতান্ত্রিক নির্বাচনে যেখানে প্রার্থী হওয়ার যোগ্যতাসম্পন্ন আমজনতা ও বিরোধীদলীয় প্রার্থীরা গায়েব হয়ে যাননি, সেখানে ব্যাপকভিত্তিক আসনে কী করে ‘বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়’ নির্বাচন সাংবিধানিকভাবে বৈধ হতে পারে?

প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্রের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ ৩০ শতাংশ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার ঘটনায় ইতিমধ্যে ‘উদ্বেগ’ প্রকাশ করেছেন। প্রধান বিচারপতি নির্বাচন কমিশনকে নির্দেশ দিয়েছেন, আদালতের অনুমতি ছাড়া ওই ৩০ শতাংশ আসনে যাতে ভোটের ফলাফলের গেজেট না করা হয়। ভারতের প্রধান বিচারপতি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ‘নির্বাচিতদের’ ফলাফল আটকে বলেছেন, ‘গণতন্ত্রে ভোটের পবিত্রতা বজায় রাখতে পুরোপুরি স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করাতে হবে।’

বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ৩০ শতাংশের বেশি আসনে ক্ষমতাসীনদের নির্বাচিত হওয়ার বৈধতার একটি আইনি ফয়সালা ৩ জুলাই সুপ্রিম কোর্টে আমরা প্রত্যক্ষ করব। হোক পঞ্চায়েত নির্বাচন, তবু উপমহাদেশের সব থেকে মর্যাদাসম্পন্ন সুপ্রিম কোর্ট এ বিষয়ে কী বলেন, সেটা অত্যন্ত আগ্রহভরে দেখার বিষয়। বাংলাদেশের ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ১৫৩ আসনে অর্থাৎ শতকরা ৫০ ভাগের বেশি আসনে জয়লাভের বৈধতা চ্যালেঞ্জ হয়েছিল, কিন্তু তা সমর্থিত হয়েছিল।

বিজেপি, কংগ্রেস ও বামেরা বলেছে, তৃণমূলের সশস্ত্র ক্যাডারদের শ্বেত সন্ত্রাসের শিকার হয়ে তাদের প্রার্থীরা মনোনয়নপত্রই জমা দিতে পারেননি। ওই সব আসনে ক্ষমতাসীনেরা সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। আর তৃণমূলের মুখ্যমন্ত্রী মমতা এই অভিযোগ, বলা বাহুল্য ঢের কম বিশ্বাসযোগ্যতার সঙ্গে নাকচ করে বলেছেন, ‘ওসব আসনে বিরোধীদের পা রাখার জায়গা নেই, তাই তারা মনোনয়নপত্র দাখিলই করেনি!’ তিনি দিব্যি জনগণকে ধারণা দিয়েছেন যে ২০ হাজারের বেশি তৃণমূল প্রার্থীর বিপরীতে তাঁর চিহ্নিত প্রতিপক্ষ বিরোধী দল ছাড়া একজন আমজনতার পক্ষেও প্রার্থী হওয়া সম্ভব ছিল না। পঞ্চায়েতব্যবস্থা গ্রামের, বাড়ি বাড়ির গণতন্ত্র। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ধ্বংস করছেন বলে মনে হয়। কারণ, তিনি মনে করেন তাঁর রাজ্যে যেকোনো মূল্যে উন্নয়ন শুধু তাঁর নেতৃত্বেই হতে হবে।

বীরভূমের একটি সমগ্র জেলার ৪২টি জেলা পরিষদীয় আসনের মধ্যে মাত্র একটিতে বিজেপির এক নারী প্রার্থী দাঁড়িয়েছিলেন। কীভাবে যেন তাঁর মনোনয়নপত্র টিকে যায়। মমতার নিরঙ্কুশ গণতন্ত্রে এটা ছিল এক পোঁচ কালি লেপনের মতো। তাই ভদ্রমহিলাকে আচমকা দেখা গেল তিনি প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে বলেছেন, বিজেপি নয়, তিনি তৃণমূলের কর্মী! গত ৪০ বছরে আটটি নির্বাচনে এ রকম ফাঁকা মাঠে জয়ীদের মোট সংখ্যা ছিল ২৩ হাজার ১৮৫। এবারের একটিতেই বিনা যুদ্ধে জেতা তৃণমূলীর সংখ্যা ২০ হাজার ৭৬।

কলকাতা হাইকোর্ট বামেদের আরজি আমলে নিয়ে ই-মেইলে মনোনয়নপত্র দাখিল বৈধ বলেছেন। সুপ্রিম কোর্ট তা আটকে দিয়েছেন, তারও সুরাহা ৩ জুলাই। অভিযোগ হলো সরকারি দলের গুন্ডামিতে ভীতসন্ত্রস্ত বিরোধীদলীয় প্রার্থীরা উপায়ান্তর না দেখে ই-মেইলে প্রায় ২ হাজার মনোনয়নপত্র জমা দেন। তবে কলকাতা হাইকোর্ট তার কিছু আগে হোয়াটসঅ্যাপে মনোনয়নপত্র দাখিলের বিষয়টি অনুমোদন দেন। সুপ্রিম কোর্টে তা স্থগিত হয়নি। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার ভাঙ্গরে বিরোধী দলের এ রকম আট হোয়াটসঅ্যাপ প্রার্থীর মধ্যে পাঁচজন জয়ীও হয়েছেন।

বাংলাদেশে আমাদের গোটা নির্বাচনব্যবস্থায় ভবিষ্যতে অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে ভোট হওয়ার মতোই অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে মনোনয়নপত্র দাখিল একটি বিরাট সমস্যা হিসেবে দেখা দেবে। ইতিমধ্যে একই দলের বিদ্রোহী প্রার্থী দমনে ২০১৪ সালের সাধারণ নির্বাচন এবং তার আগে ও পরের স্থানীয় সরকারের নির্বাচনগুলোর যে চিত্র আমাদের সামনে রয়েছে, তাতে কলকাতা হাইকোর্টের ডিজিটাল নির্দেশনাটি বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন অনুসরণ করতে পারে। এখন যদি ই-মেইল, হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবার কি টেলিগ্রামের মতো মাধ্যমে শান্তিতে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার আইন আমরা গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে অন্তর্ভুক্ত করতে পারি, তাহলে ক্ষতি কি। পশ্চিমবঙ্গের ইসি সুপ্রিম কোর্টে নালিশ দিয়েছে, এটা তো বিদ্যমান বিধিতে নেই।

কলকাতা হাইকোর্টের রায়টি এমন একটি সময়ে এসেছে, যখন বাংলাদেশের সঙ্গে কলকাতার সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন আরও বাড়ছে। ২৫ মে শান্তিনিকেতন চত্বরে বাংলাদেশের অর্থায়নে গড়ে ওঠা বাংলাদেশ ভবন দ্য হিন্দুর খবর অনুযায়ী, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপস্থিতিতে উদ্বোধন করবেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কলকাতা হাইকোর্টের উল্লিখিত ই-মেইল ও হোয়াটসঅ্যাপ সিদ্ধান্ত ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা বিজয় কৃষ্ণ গোখলের সেই উক্তিটিও স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে, ‘বাঙালি আজ যা ভাবে ভারত ভাবে আগামীকাল’। ডিজিটাল উপায়ে মনোনয়নপত্র গ্রহণের এই ব্যবস্থা ভারতের ভেতরে ও বাইরে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়তে খুব সময় লাগবে বলে মনে হয় না।

অবশ্য ডিজিটাল বাংলাদেশ নামকরণ করায় এ নিয়ে সম্ভাবনা ও ভয় দুটোই আছে। অনেকের কাছে প্রশ্ন শুনি, আচ্ছা বলুন তো, ভারতে কি সংসদ রেখে নির্বাচন হয়, নাকি ভেঙে দিয়ে। যখন বলি: সংসদ ভেঙে দিয়ে। তখন এক পক্ষের লোকের চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। আরেক দলের চোখমুখে কিছুটা অন্ধকার নামে। তবে একটু বাদে যখন ব্যাখ্যা দিয়ে বলি, আসলে হয়েছে কি, ভারতের এক ডজন লোকসভা নির্বাচনের মধ্যে মাত্র তিনটি কি চারটি নির্বাচন লোকসভা রেখে হয়েছে। কিন্তু ব্রিটেনে কোনো ব্যতিক্রম নেই। সব সময় সংসদ ভেঙে নির্বাচন হয়। সুতরাং বিদেশি উদাহরণ আমাদের শাসক দলগুলো তার মর্জি অনুযায়ী গ্রহণ বা বর্জন করে থাকে। মাত্র ১৫-১৬ বছরের ব্যবধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রচলনের দাবি নাকচ এবং তা বিলোপে যথাক্রমে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ মূলত বিদেশি উদাহরণ ব্যবহার করেছে। বলেছে, কোনো উন্নত দেশে এটা নেই।

সামনের দিনগুলোতে যদি আমরা ধরে নিই যে নির্বাচনগুলো আর কারচুপিমুক্ত থাকবে বলে মনে হবে না, কিংবা একটি বিশেষ প্রতীক মানেই বিজয়ের নিশ্চয়তা, তখন ভোটারদের কদর আরও কমবে, নির্বাচনী প্রচারণা প্রকৃত জৌলুশ হারাবে। ক্ষমতাসীন দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রচর্চা আরও কমবে। সংবিধানের চেতনার ক্ষয় হতে থাকলে দলীয় সংবিধানের চেতনা টিকতে পারে না। তার লক্ষণ ইতিমধ্যে ফুটে উঠেছে। গাজীপুরে যেভাবে ক্ষমতাসীন দল সিটি মেয়র প্রার্থী চাপিয়েছে, এই ধারা আরও বিস্তৃত হবে। তখন বিদ্রোহী প্রার্থী দমন করাই হবে নির্বাচন কমিশনের মুখ্য মাথাব্যথা।

ছাত্রলীগের কমিটি গোপন ব্যালটে হতে না পারা এবং পরিস্থিতি এড়াতে বয়সসীমা হঠাৎ এক বছর বাড়িয়ে দেওয়ার মতো উপসর্গগুলো উদ্বেগজনক। তাই পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত নির্বাচনে ইলেকট্রনিক মনোনয়নপত্র দাখিলের যে প্রথা কলকাতা হাইকোর্ট চালু করলেন, সেটা আমরা সব স্তরের নির্বাচনে নিতে পারি। শুধু পারি বললে ভুল হবে, হয়তো রবিঠাকুরের ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে’ গাইতে গাইতে আমাদের প্রার্থীরা অন্তত অবাধে মনোনয়নপত্র দাখিল করার পথ বেছে নিতে পারেন।

মিজানুর রহমান খান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক
[email protected]