পরিকল্পনার 'পরি' উড়িয়া গিয়াছে

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যানজট। ­১৭ মে দাউদকান্দির বিশ্বরোড এলাকায়।  প্রথম আলো
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যানজট। ­১৭ মে দাউদকান্দির বিশ্বরোড এলাকায়। প্রথম আলো

১৯৭৫-৭৬ সালের কথা। তখন প্রায়ই ঢাকা-কুমিল্লা-চট্টগ্রাম সড়কপথে যাতায়াত করতাম। রাস্তা ছিল সরু ও খারাপ। যানজট ছিল না। সময় বেশি লাগত না। তখন মেঘনা ও দাউদকান্দিতে সেতু ছিল না। কাঁচপুর থেকে বাস ডেমরা হয়ে ঢাকা শহরে ঢুকত।

এর পরই ওই পথে উন্নয়নের ছোঁয়া লাগল। ঢাকা-চট্টগ্রাম সড়ক রীতিসিদ্ধভাবে দুই লেনে উন্নীত হলো। অনেক জায়গায় পথ খুবই আঁকাবাঁকা ছিল। সোজা করা হলো। শহরগুলোকে এড়িয়ে যাওয়ার জন্য তৈরি হলো বাইপাস। প্রথম বাইপাস হলো ফেনীতে। বাইপাসের অংশটি এত সুন্দর, মসৃণ হলো, যা আগে আমরা কখনো এ দেশে দেখিনি। তখন জিয়াউর রহমানের সামরিক সরকার। আশির দশকে এ দেশে সড়ক অবকাঠামোয় রীতিমতো বিপ্লব শুরু হলো। এখন তো যেকোনো জেলা এবং দু-একটি দ্বীপ-উপজেলা ছাড়া সব উপজেলায় পাকা রাস্তা দিয়ে যাওয়া যায়। একসময় এটা মনে হতো কল্পনা। তারপর এল ‘পরিকল্পনা’। সড়কপথে জাদুর ছোঁয়া লাগল।

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কটি আমাদের অর্থনীতির ‘লাইফলাইন’। চট্টগ্রাম বন্দরের সঙ্গে দেশের অন্যান্য জায়গার সংযোগের এটাই প্রধান মাধ্যম। দেশের শতকরা প্রায় ৯০ ভাগ আমদানি-রপ্তানি হয় এই বন্দর দিয়েই। গুরুত্ব বিবেচনা করেই সড়কটি চার লেনে উন্নীত করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল।

যখন সড়কটি ফোর লেন হয়নি, তখন যেতে-আসতে যে সময় লাগত, এখন তার চেয়ে বেশি লাগে। কারণ কী? তখন যানবাহন ছিল কম। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের পরিধি ছিল ছোট। এখন যানবাহনের সংখ্যা বেড়েছে কয়েক গুণ। দেশের আমদানি চাহিদা ও রপ্তানি ক্ষমতা বেড়েছে অনেক। সড়কের ওপর চাপ বেড়েছে। কিন্তু ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেন কার্যকর হয়নি। কারণ, পথের মধ্যে বড় সেতুগুলো দুই লেনের। এ ছাড়া রেললাইনের ওপর তৈরি হচ্ছে ওভারপাস। ফলে কয়েকটি জায়গায় গাড়ির গতি যাচ্ছে থেমে।

প্রশ্ন হলো, যখন চার লেনের পরিকল্পনা নেওয়া হলো, একই সঙ্গে নতুন সেতু ও ওভারপাস তৈরির ব্যবস্থা কেন নেওয়া হলো না? বোঝাই যাচ্ছে, একসঙ্গে বসে সমন্বিত পরিকল্পনা নেওয়া হয়নি। কেন নেওয়া হয়নি, তার জবাব কি আমরা জানি?

চার লেনের কাজ অনেক আগেই শেষ হওয়ার কথা। দফায় দফায় এর সময়সীমা বাড়ানো হয়েছে। শুনেছি প্রধান ঠিকাদার নাকি বেশ কয়েকজন স্থানীয় খুচরো ঠিকাদার নিয়োগ করেছিলেন। তাঁরা কেউ কেউ কাজ শেষ না করে ভেগে গেছেন। এ দেশে কাজ অসমাপ্ত রেখে বা কাজ শুরু না করেই বরাদ্দের টাকা মেরে বা না মেরে ভেগে যাওয়ার উদাহরণ আছে অনেক। কমিশন লেনদেন নিয়ে সুরাহা না হলেও অনেক সময় বিপত্তি হয়। ঠিকাদার ভেগে যান বা বরাদ্দ বাড়ানোর জন্য চাপ দেন। যাহোক, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক নিয়ে এখন ব্যবসায়ী এবং যাত্রী-সবাই জেরবার হচ্ছেন। গত কয়েক সপ্তাহে অবস্থা চরমে উঠেছে।

অনেক বছর আগে ইত্তেফাক-এ একটি সংবাদ শিরোনাম চোখে পড়েছিল-‘পরিকল্পনার পরি উড়িয়া গিয়াছে, রহিয়াছে শুধু কল্পনা’। আমাদের মহাসড়কগুলোর অবস্থা দেখলে শিরোনামটি মনে পড়ে। পরি তো উড়বেই। শিশু বয়সে রূপকথায় পরি উড়ত, তারপর ফুলের পাপড়িতে বসত। রাজপুত্তুর এসে পরিকে নিয়ে যেত। আমাদের পরিকল্পনার ‘পরি’ এখন কোথায় বসে আছে, কে তাকে গায়েব করে দিয়েছে, তার জবাব কে দেবে?

আমাদের দেশে পরিকল্পনা কমিশন বলে একটি বস্তু আছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাঘা বাঘা অর্থনীতিবিদ নিয়ে বঙ্গবন্ধু স্বয়ং এটি তৈরি করেছিলেন। তাঁরা আমাদের চমৎকার একটি ডকুমেন্ট উপহার দিয়েছিলেন এক বছরের মাথায়-প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ১৯৭৩-৭৮।

পরিকল্পনা কমিশনের সঙ্গে প্রথাগত আমলাতন্ত্রের সমন্বয় কখনো ছিল না, সুসম্পর্কও তৈরি হয়নি। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার আগেই পরিকল্পনা কমিশনের সব সদস্য একে একে বিদায় নিয়েছিলেন। এরপর কমিশনে একাডেমিকদের জায়গা আর হয়নি। চলে গেছে আমলাদের নিয়ন্ত্রণে। কমিশনের মর্যাদাও কমে গেছে অনেক। আগে সদস্যরা মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদা পেতেন। এখন ওই ব্যবস্থা আর নেই। এখন মন্ত্রণালয়গুলোই পরিকল্পনা তৈরি করে। কমিশনের মধ্য দিয়ে ওগুলো পাস করিয়ে নিতে হয়। এখানেও নানা হিসাব।

কয়েকটি উন্নয়ন প্রকল্পে পরামর্শক হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, প্রকল্প পাস করাতে হলে নীতিনির্ধারক বা সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদের খুশি রাখতে হয়। এ জন্য প্রকল্পে ‘প্রশিক্ষণের’ একটি ব্যবস্থা রাখতে হয়। প্রশিক্ষণ মানে দু-এক সপ্তাহের জন্য বিদেশে গিয়ে ঘোরাঘুরি করা। প্রশিক্ষণে পরিকল্পনা কমিশনের বা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাকেও রাখতে হয়। নইলে প্রকল্প পাস হবে না। গত কয়েক বছরে এ ধরনের প্রশিক্ষণে সরকারি কর্মকর্তারা কে কোথায় গিয়েছেন এবং কী শিখেছেন, তার হিসাব বের করতে পারলে আমরা আরও আলোকপ্রাপ্ত হব।

বিদেশে প্রশিক্ষণ নেওয়ার ক্ষেত্রে শুধু উঁচু পদের আমলারাই নন, অন্যান্য পর্যায়ের কর্মকর্তারাও সংযুক্ত হচ্ছেন। এমনকি নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিরাও এই যাত্রায় শামিল হয়েছেন। স্থানীয় সরকারের কাজকর্ম দেখতে আমাদের স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা, স্থানীয় সরকার প্রতিনিধি, এমনকি সংসদীয় কমিটির প্রতিনিধিরাও হরহামেশা বিদেশে যাচ্ছেন। জনগণের ট্যাক্সের টাকায় ঘুরছেন, ফিরছেন, বাজার করছেন, আত্মীয়স্বজনের দাওয়াত খাচ্ছেন। কিন্তু শিখছেনটা কী? কিছু শিখে এলে তো আমাদের দেশটা এ রকম ভাগাড়ে পরিণত হতো না?

ঢাকা শহরের কথাই ধরুন। ঢাকা এখন কংক্রিটের জঙ্গল। পয়োনিষ্কাশনের ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। প্রতিবছর বর্ষা আসার আগে আমরা আশার বাণী শুনি-আগামী বছর এ সমস্যা থাকবে না, ইনশা আল্লাহ। তো, আগামী বছরটা আর আসে না। দক্ষিণের মেয়র সাহেব দেখলাম, তিন বছর পার করে মহাসমারোহে পত্রিকায় ক্রোড়পত্র দিয়েছেন। পত্রিকার লাভ, তারা বিজ্ঞাপনের টাকা পাবে। মেয়রের লাভ, করপোরেশনের টাকায় নিজের ঢোল পেটানো হলো। দুই পাতাজুড়ে শুধু মেয়র সাহেবের ছবি। আর কিছু তো নেই। আমজনতা তিন বছরে কী পেল? মেয়র সাহেবরা একটা কথাই জপ করেন সকাল-সন্ধ্যা-এত এজেন্সির ওপর আমার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, আমি কী করব? এটা তো জানা কথাই। তাহলে নির্বাচনের আগে কেন বলেন, হেন করেঙ্গা, তেন করেঙ্গা? মুরোদ যে নেই, তা তো আমরা বুঝতেই পারছি।

ঝড়-বৃষ্টির কথা আগাম বলা কঠিন। বর্ষা আসছে। গত বছরও দেখেছি, কয়েক ঘণ্টা একনাগাড়ে বৃষ্টি হলে রাস্তাগুলো সব নদী হয়ে যায়। এবার কী হবে? বর্ষায় মানুষ বাজারে-অফিসে যেতে পারে না, শিশুরা স্কুলে যেতে পারে না, হাঁটু বা কোমরপানিতে গর্তে পড়ে রিকশা উল্টে যায়, গাড়ি যায় বন্ধ হয়ে। অলিগলিতে যাঁরা থাকেন, তাঁদের দুর্গতির সীমা থাকে না। ফাটা রেকর্ডের মতো একই রকম স্তোকবাক্য শুনতে হয়-আগামী বছর এই সমস্যা থাকবে না। এবারও কি একই দৃশ্য দেখতে হবে আমাদের?

যাদের অঢেল আছে, তারা এক দিন পথে বেরোতে না পারলে কিছুই যায়-আসে না। যাদের পলিথিনের শিটের নিচে বসত, দিন এনে দিন খাওয়া, তারা এক দিন না বেরোলে উপোস থাকতে হয়। এসব হতদরিদ্র মানুষের জন্য এবারের বর্ষা কী বার্তা নিয়ে আসবে?

মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক
mohi 2005 @gmail. com