কার স্বার্থে 'বিশ্বাসযোগ্য' নির্বাচন?

রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আনতে পারবে, এমন একটি বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন এখন পাকিস্তানের জন্য খুব জরুরি। অন্য যেকোনো সরকারের তুলনায় জনগণের প্রচ্ছন্ন সমর্থনে নির্বাচিত সরকারের পক্ষে গুরুতর জাতীয় সমস্যা সামাল দেওয়া সহজ। কিন্তু পাকিস্তানে কারসাজি করে জনমত ছিনতাইয়ের ধারা দীর্ঘদিন থেকে চলে এসেছে। সময়ের বিবর্তনে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক চাপের মুখে এই কারসাজিযন্ত্রের নির্লজ্জতা আগের চেয়ে কমে এসেছে ঠিকই; কিন্তু তার প্রভাব এখনো ভালোভাবেই আছে।

পাকিস্তানে নির্বাচনে কারসাজি করতে যতগুলো কৌশল বেছে নেওয়া হয়, তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রচলিত কৌশলটি হলো ভোটের তারিখ পিছিয়ে দেওয়া। ১৯৪৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৩০ বছরের বেশি সময় এই ছলচাতুরীর কারণে নষ্ট হয়েছে। কিছু সুবিধাবাদী রাজনীতিকের সহায়তায় রাষ্ট্রের প্রভাবশালী মহল এই ভোট বিলম্বের কায়দা বেছে নেয়। পাকিস্তানের ইতিহাসের প্রথম বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন হয়েছিল ১৯৭০ সালে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, সেই প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে এই ভোটের ফলকে অস্বীকার করা হয় এবং বিজয়ীদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয় না।

১৯৭৭ সালে ভোটের আয়োজন করেছিলেন রাজনীতিকেরা। জাল ভোট দেওয়া, ভুল গণনা করা, ভোটারদের কেন্দ্রে আসতে না দেওয়া, ব্যালট বাক্স
ছিনতাই করা—ইত্যাদি কায়দায় এই বছরের ভোটের ফলাফল ছিনতাই হয়ে যায়। সামরিক শক্তির ছায়ায় অনুষ্ঠিত অন্যবারের ভোটেও (১৯৮৫, ১৯৯০, ১৯৯৩, ১৯৯৭ ও ২০০২ সাল) বিস্তর কারসাজি হয়েছে।

১৯৭০, ১৯৮৮, ২০০৮ এবং ২০১৩ সালের নির্বাচন তুলনামূলকভাবে বেশি বিশ্বাসযোগ্য ছিল। এগুলোর মধ্যে প্রথম তিনবারের নির্বাচন সেনা সরকারের অধীনে হয়েছিল। আগের ভোট কারসাজির আংশিক প্রায়শ্চিত্ত হিসেবে কি তারা এই আস্থাযোগ্য ভোট করেছিল? ভোট কারসাজির সোজাসাপ্টা একটা মুখস্থ ধরন আছে। যখন বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন করার ব্যাপারে অভ্যন্তরীণ ও বাইরের চাপ খুব কম থাকে, তখন ক্ষমতার একেবারে শীর্ষ পর্যায় থেকে ভোট জালিয়াতি করা হয়।

পাকিস্তানে দীর্ঘকাল সামরিক শাসন জারি থাকার কারণে যখনই দেশ একেবারে ধ্বংসোন্মুখ হয়ে পড়েছে; এরপর স্বচ্ছ নির্বাচনের জন্য সরকারের ওপর যখন দেশের ভেতর ও বাইরে থেকে চাপ বেড়েছে, শুধু তখনই ক্ষমতাধর প্রতিষ্ঠানগুলো বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন করতে বাধ্য হয়েছে। স্বৈরশাসকেরা নির্বাচন পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী করে দেওয়ার কারণে স্বচ্ছ নির্বাচন হয়ে থাকে—এমনটি ভাবার কারণ নেই। চাপের মুখে ক্ষমতা ছাড়তে হয় বলে তারা নিজেদের নিরপেক্ষ প্রমাণের চেষ্টা হিসেবে স্বচ্ছ নির্বাচন দিয়ে থাকে।

 রাজনীতিকেরা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে কিছু প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারে উদ্যোগ নেওয়ায়, বিশেষ করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারব্যবস্থায় সংশ্লিষ্ট কিছু আইনি ধারা যুক্ত করার কারণে অন্যবারের তুলনায় ২০১৩ সালের নির্বাচন অনেকটা স্বচ্ছ হয়েছিল। এটি একেবারেই স্পষ্ট যে পাকিস্তানে যে জালিয়াতির নির্বাচন হয়, তার জন্য রাজনীতিকেরা নন, বরং সামরিক বাহিনীর একাংশই দায়ী। সংবিধানে নিরপেক্ষ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার-বিষয়ক অনুচ্ছেদ যুক্ত করে রাজনীতিকেরা কেন্দ্রীয়ভাবে নির্বাচন জালিয়াতি করার ক্ষমতা স্বেচ্ছায় ছেড়ে দিয়েছেন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় থাকার ফলে তাঁদের হাতে নির্বাচন প্রভাবিত করার একমাত্র হাতিয়ার থাকে নিজ নিজ আসনে ভোট কেনা।

কিন্তু ভোট প্রভাবিত করার এই পন্থাটি অন্য সেই সব পন্থার চেয়ে আলাদা, যেগুলোর কারণে ভোটার বাস্তবিক অর্থে তাঁর সব ধরনের মত প্রকাশ করার অধিকার থেকে বঞ্চিত হন। ভোট কেনার মধ্যেও ভোটার কিছুটা স্বাধীনতা পান। যাঁর কাছ থেকে তিনি টাকা নিয়েছেন, তাঁকেই ভোট দেবেন কি না, ভোট বুথে গিয়ে সেই সিদ্ধান্ত তিনি নিতে পারেন।

 এটিও সত্য যে, সুযোগসন্ধানী রাজনীতিকেরা তাঁদের প্রতিপক্ষের রাজনীতিকদের নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার জন্য ক্ষমতাধর প্রতিষ্ঠানকে রাজনৈতিক সহায়তা দিয়ে থাকেন। যেমনটি ১৯৭১ সালে আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করতে পিপিপি সামরিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছিল। ১৯৮০ এবং ’৯০-এর দশকে পিপিপিকে নিশ্চিহ্ন করার মতলবে পাকিস্তান মুসলিম লিগও সামরিক শক্তির সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল। ঠিক একই কায়দায় পিএলএম (নওয়াজ)-কে কোণঠাসা করার জন্য পিটিআই একইভাবে সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে।

যেহেতু সময়ের বিবর্তনে এবং ভেতরে-বাইরের চাপে ক্ষমতাধর প্রতিষ্ঠানের নির্বাচন জালিয়াতির নির্লজ্জতা কমে এসেছে, সেহেতু ভোট না দিয়ে দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষমতায় বসে থাকার রেওয়াজও কমে এসেছে। নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করায় জাল ভোট দেওয়া এবং ইচ্ছাকৃতভাবে ভোটের ভুল গণনার মাত্রাও এখন কমে গেছে।

উদাহরণ দিতে গেলে বলা যায়, ১৯৯০-এর দশকে নির্বাচন নিজের পক্ষে নেওয়ার কৌশল হিসেবে ভোট কেনা, জাল ভোট দেওয়া এবং ভোটারদের ভয় দেখিয়ে ভোটকেন্দ্রে আসতে না দেওয়ার কায়দা অনুসরণ করা হতো। তখন প্রকাশ্য ভোট জালিয়াতি যত কম করা যায়, তার ওপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া হতো। তখন শক্তিশালী প্রার্থীদের আগেভাগেই বসিয়ে দেওয়ার কৌশল নেওয়া হতো। প্রার্থী না বসলে ভোটারদের মধ্যে এই ধারণা ঢুকিয়ে দেওয়া হতো যে ওই প্রার্থীকে জিততে দেওয়া হবে না। ফলে তাঁকে ভোট দিয়ে লাভ নেই।

২০০৮ ও ২০১৩ সালের নির্বাচনে যে প্রভাবশালী মহলটি তেমন একটা সুবিধা করতে পারেনি, অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয় হলো সেই মহলটি ২০১৮ সালের নির্বাচনে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে উঠেপড়ে লেগেছে। একজন প্রধানমন্ত্রীকে আজীবনের জন্য বরখাস্ত করা ও রাজনীতি থেকে তাঁকে দূরে রাখার ঘোষণা এবং নির্দিষ্ট সুবিধাবাদী রাজনীতিকদের সেই প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠানের তল্পিবাহকের ভূমিকায় আত্মপ্রকাশ সে রকম লক্ষণ প্রকাশ করছে।

সর্বশেষ ফলাফলে হয়তো একটি ঝুলন্ত পার্লামেন্ট পাওয়া যাবে। এতে হয়তো সেই ক্ষমতাধর মহল তাদের লক্ষ্য সহজেই পূরণ করতে পারবে। তাদের চাওয়া অনুযায়ী পাকিস্তানে এমন একটি দুর্বল সরকার থাকবে, যারা তাদের অঙ্গুলি হেলনে চলবে।

ডন থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনূদিত

নিয়াজ মুর্তাজা ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার সিনিয়র ফেলো