'বন্দুকযুদ্ধ' চমৎকার! মানুষও মরবে, নেশার লাটিমও ঘুরবে

ধরা যাক, দেরিতে হলেও বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষের টনক নড়েছে। তারা সত্যিই মাদক নির্মূলে আন্তরিক, এটাও আমরা বিশ্বাস করছি। কিন্তু মাথায় একটা খটকা লেগেছে। সরকার বন্দুকযুদ্ধকে জনপ্রিয় করতে চায়, নাকি মাদক ব্যবসার দফারফা করত চায়? ‘বন্দুকযুদ্ধ’ জনপ্রিয় করার বিনিয়োগ তো আগেভাগেই করা সারা। সুবিচার ও সুশাসন না থাকলে তো বিচারবহির্ভূত পথে জাতির উৎসাহ বাড়বেই। দশকের পর দশক প্রজন্মের পর প্রজন্মকে মাদকের ফাঁদে পড়তে দেখেও কিছু করা হয়নি। কোটি পরিবারকে মাদকের অভিশাপে চূড়ান্ত রকম জর্জরিত হতে দেওয়া হয়েছে। দেশজোড়া মাদক ছড়ানোর জাল পাততে দেওয়া হয়েছে। কত কত পরিবার সন্তান-ভাই-স্বামী-কন্যাকে ঠেকাতে না পেরে মাদক-মহাজনদের অভিশাপ দিয়েছে, তাদের মৃত্যু চেয়েছে। আজ যখন ১৩ দিনে ৯১টি লাশ পড়েছে, তখন ভুক্তভোগী অনেক অভিভাবকই হয়তো খুশিই হবে। কিন্তু এতে কি মাদকের বিস্তার কমবে?

বিএনপি আমলের ক্লিনহার্ট-ক্রসফায়ার উন্নয়নের ছোঁয়ায় এখন ‘বন্দুকযুদ্ধ’ হয়েছে। এসবের প্রায় দেড় যুগ হয়ে গেল, না মাদক কমল না অপরাধ কমল। ভুল রাস্তায় জোর কদমে হাঁটাহাঁটি করলে শক্তি খরচ ছাড়া আর কিছু হয় না। মৌমাছির চাক অটুট রেখে এদিক-ওদিক কয়েক শ মৌমাছি মারায় রানি মৌমাছি ভয় পায় না। বিস্তর মৌমাছি তখনো রয়ে যায়, আর রানি মৌমাছির রয়েছে অঢেল প্রজনন ক্ষমতা। আমাদের দেশের কথা থাক। মাদকবিরোধী যুদ্ধের প্রধান সেনাপতি হলো যুক্তরাষ্ট্র। ১৯৭১ সালে প্রেসিডেন্ট নিক্সন মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। আমেরিকার শরীরে মাদকের বিষ কমল কই? খোদ সিআইএ এই ব্যবসার সঙ্গে জড়িত বলে গলা ফাটিয়ে যাচ্ছেন সে দেশের সৎসাহসী বুদ্ধিজীবী নো’ম চমস্কি। তাঁর কথাও বাদ। মাদকযুদ্ধে পোড়খাওয়া কলাম্বিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট সিজার গাভিরিয়ার কথা তো আর ফেলা যায় না। ১৯৯০-৯৪ সাল পর্যন্ত তাঁর আমলে কলাম্বিয়ায় বিরাট মাদকবিরোধী অভিযান চলে। এই যুদ্ধে অস্ত্র, টাকা, গোয়েন্দা দিয়ে পাশে ছিল যুক্তরাষ্ট্র। বিশ্বের এক নম্বর মাদকসম্রাট পাবলো এসকোবারকে তিনি আটক করেন, মাদকচক্রকে আটকে রাখার জন্য বিরাট জেল বানান, এসকোবার জেল থেকে পালালে তাঁকে হত্যাও করান।

কিন্তু গাভিরিয়া কী লিখেছেন দেখুন: ‘বেআইনি মাদক জাতীয় নিরাপত্তার জন্য উদ্বেগের বিষয়, কিন্তু এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ কেবল সামরিক ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দিয়ে জেতা যায় না। আরও বেশি সেনা ও পুলিশকে মাদকের বিরুদ্ধে লাগালে টাকার অপচয় তো হয়ই, সমস্যাটা আরও গুরুতর হয়ে দাঁড়ায়। অহিংস প্রতিবাদী ও মাদকসেবীদের জেলে ভরার ফল হলো উল্টা, সংগঠিত অপরাধটক্র আরো শক্তিশালী হলো...মাদকচক্র ও মাদক দূর করার লাগাতার অভিযানে আমরা বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ঢাললাম। ...আমাদের মাদকবিরোধী ক্রুসেডে হাজার হাজার মানুষের প্রাণ গেল, অনেক উজ্জ্বল রাজনীতিবিদ, বিচারক, পুলিশ কর্মকর্তা ও সাংবাদিকেরা (মাদকচক্রের হাতে) প্রাণও দিলেন। কিন্তু হলো কী? মাদকচক্র বিপুল অর্থ ঢেলে প্রশাসন, বিচার বিভাগ এবং আইনপ্রণেতাদের কিনে ফেলল।’

২০১৭ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক টাইমসে গাভিরিয়া এ লেখা লেখেন ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট দুতার্তসহ সব মাদকযুদ্ধে মজে যাওয়া শাসকদের হুঁশিয়ার করার জন্য। গত জানুয়ারি পর্যন্ত দুতার্তের মাদকবিরোধী যুদ্ধে ১২ হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হয়, বন্দী হয় হাজারো মানুষ। এর মধ্যে শুধু অপরাধীরা ছিল না, ছিল বিরোধী দলের কর্মী, মানবাধিকারকর্মীসহ অনেক নিরীহ মানুষও। গাভিরিয়া জানাচ্ছেন, মাদকের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা কলাম্বিয়ায় মাদকের চাহিদা ও জোগান সামান্যই কমাতে পেরেছে। তারপরও এহেন যুদ্ধ ফিলিপিন থেকে বাংলাদেশ; কম উন্নত, কম গণতান্ত্রিক এবং বেশি দুর্নীতির দেশগুলোতে কেন ছড়াচ্ছে? গাভিরিয়ার স্বীকারোক্তি, আসল কাজ না হলেও এতে সরকারের জনপ্রিয়তা সাময়িকভাবে বাড়ে।

ওদেকে মাদকচক্রের প্রাণভোমরা দুর্নীতির দুর্গে বসে হাসছে। দুর্নীতি থাকলেই মাদক অবাধে ছড়াতে পারে। কিশোর-তরুণের মন-মগজ খেয়ে ফেলার এ ব্যবসার বখরা দিয়ে পুলিশ-প্রশাসন-মন্ত্রী-এমপি-সীমান্তরক্ষী, সবখানেই গর্ত করে বের হয়ে যাওয়া যায়। লাভের টাকা পাচার করা যায় বিদেশে। প্রবাসে কিংবা কারাগার কিংবা জঙ্গলে বসেও চোরাচালানের জাল সুন্দর করে টানা-ছাড়া করা যায়। আর যেখানে ক্ষমতাসীন সংগঠন আর মাদকের সংগঠন অনেক জায়গায়ই একাকার, দলের অনেকের গাড়ি-বাড়ির উৎস যেখানে মাদক ব্যবসা, সেখানে বিষবৃক্ষের ডালপালা ছেঁটে লাভ নেই।

দুর্নীতি ও দুবৃত্ততন্ত্রের গোড়ায় হাত দিতে লাগবে। সেটা ছাড়া কিছু গুলি ফোটালে আর কিছু মানুষ মারলে মাদকব্যবস্থা ধসে পড়ার বদলে আরও গভীরই হবে।

কীভাবে?

১. ডাল কেটে দিলে কিছু গাছ আরও বাড়ে। হিসাবের বাইরে বেড়ে ওঠা কিছু টিউমার-টাইপ মাদক বিক্রেতা মারলে পুরো নেটওয়ার্কের স্বাস্থ্য আরও ভালোই হবে। নতুন রিক্রুটদের জায়গা খালি হবে। ব্যবসার নবায়নও হবে।

২. প্রাণের ভয়ে বাকিরা বখরার হার বাড়িয়ে দেবে। মারবেন তিন জনকে, কিন্তু তিরিশজন জানের কাফ্ফারা বাবদ ঈদখরচ পাঠিয়ে দেবে।

৩. মাদকাসক্ত জাতি খুনে আসক্ত হবে। খুন করাই সব সমস্যার সমাধান হিসেবে সামাজিক বৈধতা পাবে। নেশায় ঝিমানোরা কোনো প্রশ্ন করবে না।

৪. সময়মতো রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধেও এ অভিযান চালানো যেতে পারে।

গাভিরিয়ার মূল কথা এই, মাদকক সামরিক নয় সামাজিক সমস্যা। সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি নিয়ে সামাজিক প্রতিষেধক তৈরির কথা ভাবলে উপকার পাওয়া যাবে। তাঁর সুপারিশ, দুর্নীতি ও অর্থ পাচারবিরোধী পদক্ষেপ জোরদার করা, জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নতি, মানবাধিকার রক্ষা এবং বেকারত্ব দূর ও টেকসই উন্নতি মাদকের চাহিদা ও জোগান কমিয়ে আনতে পারে। মোদ্দা কথা, সুশাসন, অর্থনৈতিক উন্নতি এবং গণতান্ত্রিক পরিবেশ মাদক কমিয়ে আনতে পারে। পশ্চিম ইউরোপে দুর্নীতি কম, তাই মাদকও কম। তাদের আরেকটা পদক্ষেপ হলো কম ক্ষতিকারক মাদককে সরকারি নিয়ন্ত্রণে পাওয়ার ব্যবস্থা করা। আসল জাদুটা এখানেই। মাদক থেকে আগে মুনাফা দূর করুন, তাহলেই ব্যবসাটা পড়ে যাবে। সরকারি নিয়ন্ত্রণে কিছু কিছু মাদক চিকিৎসা ও বিনোদনের জন্য খোলা রাখলে মস্তিষ্ক ও প্রাণধ্বংসী মাদকের চাহিদা কমে যায়।

মাদক কখনোই একেবারে দূর করা যায় না, তবে কমিয়ে আনা যায়। মাদক নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলে সে উপায় আছে। কিন্তু বন্দুকযুদ্ধকে জনপ্রিয় করলে ভয় ও মাদক হাত ধরাধরি করে চলবে, সরকারের ‘আন্তরিক উদ্দেশ্যটি’ আর সফল হবে না। মানু্ষও মরবে, নেশার লাটিমও ঘুরতে থাকবে। দেশের সম্ভাবনাময় প্রজন্মের সর্বনাশ হবে, দেশটা ধুঁকতে থাকবে এবং ‘বন্দুকযুদ্ধের হাত’ আরও শক্তিশালী হবে। মাদকবিরোধী অভিযানে হত্যার মাদকতা বন্ধের কোনো উপায় কি আমাদের হাতে আছে? মনে পড়ছে বাংলাদেশে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড নিয়ে কাজ করা প্রখ্যাত মার্কিন সাংবাদিক লরেন্স লিফশুলজের একটা হুঁশিয়ারি। ২০০৬ সালে ঢাকায় দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘ভবিষ্যতে যদি এমন অবস্থা আসে, যেখানে হাজার হাজার লোক বিনা বিচারে আটক হচ্ছে, হাজার হাজার লোক কাস্টডিতে থাকা অবস্থায় মারা পড়ছে, সে অবস্থা ঠেকানোর কোনো প্রস্তুতি কি আপনাদের আছে?’ (২৪ জুলাই ২০০৬, সমকাল)

আসলেই কি আছে?

ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সাংবাদিক।
[email protected]