'দেশে ফ্লাইট পরিচালনে ব্যয় বেশি, ভাড়া কম'

ইউএস-বাংলা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মামুনের জন্ম ১৯৭৭ সালের ৫ জানুয়ারি, চাঁদপুরের দক্ষিণ মতলবের পুটিয়া গ্রামে। বাবার সরকারি চাকরির কারণে চাঁদপুর, মুন্সিগঞ্জ ও নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন স্কুল ও কলেজে পড়েছেন। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর করেছেন। আইন বিষয়েও ডিগ্রি নিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রে আইন ও রিয়েল এস্টেট ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। দেশে গড়ে তুলেছেন ইউএস-বাংলা গ্রুপ। বাংলাদেশে ইউএস-বাংলার নানামুখী ব্যবসা, শিল্প এবং গ্রুপের লক্ষ্য নিয়ে কথা বলেছেন প্রথম আলো অনলাইনের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তানভীর সোহেল


প্রথম আলো:
বাংলাদেশে বিনিয়োগ করার ভাবনা কীভাবে এল?
আবদুল্লাহ আল মামুন: যুক্তরাষ্ট্রে রিয়েল এস্টেটসহ নানা ব্যবসায় জড়িত ছিলাম। ২০০৯ সালে বাংলাদেশে ইউএস-বাংলা প্রথমে রিয়েল এস্টেট ব্যবসা দিয়েই কার্যক্রম শুরু করি। শুরুর দিকে কোম্পানির নাম ছিল ইউএস-বাংলা এসএস লিমিটেড। রাজধানীর পূর্বাচলে ‘পূর্বাচল আমেরিকান সিটি’ নামে রিয়েল এস্টেট ব্যবসা শুরু করি। এরপর আমরা শিক্ষার দিকে অগ্রসর হলাম। আমাদের গ্রিন ইউনিভার্সিটিতে দেশি-বিদেশি প্রায় ছয় হাজার শিক্ষার্থী পড়াশোনা করেন। আমার ছোটবেলা থেকেই একটা স্বপ্ন ছিল। কখনো যদি সুযোগ পাই তাহলে মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলো, অর্থাৎ শিক্ষা, বাসস্থান, চিকিৎসা নিয়ে কাজ করব। সেই অনুযায়ী সবকিছু চলছিল।

প্রথম আলো: এরপর?
আবদুল্লাহ আল মামুন: এরপর ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনস নামে এভিয়েশন ব্যবসা শুরু করি। এটি এখন বাংলাদেশের অন্যতম বেসরকারি এয়ারলাইনস। ইউএস-বাংলা এয়ার এখন পর্যন্ত ৩৮ হাজার ফ্লাইট সফলতার সঙ্গে পরিচালনা করেছে। অল্প সময়ের মধ্যে এটা অনেক বড় পাওয়া। এ বছরের শেষের দিকে আমরা রেফ্রিজারেটর, এয়ারকন্ডিশনার, হোম অ্যাপ্লায়েন্স, টেলিভিশন বাজারজাত করতে যাচ্ছি। আগামী বছরে দেশে সংযোজিত গাড়ি বাজারজাত করার পরিকল্পনা আছে। সেই অনুযায়ী কাজ চলছে।

প্রথম আলো: শুরুর দিকে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান এভিয়েশন ব্যবসায় সফল হতে পারেনি। আপনার কেন মনে হলো এটি ব্যবসাসফল হবে?
আবদুল্লাহ আল মামুন: বাংলাদেশের মানুষ কিন্তু ভ্রমণপিপাসু। প্রতিবছর কোনো না কোনো কারণে মানুষ ইন্ডিয়া, সিঙ্গাপুর, কুয়ালালামপুর যাচ্ছে। ঢাকা থেকে কুয়ালালামপুর খরচ এবং ঢাকা থেকে কক্সবাজারের খরচ তিন দিন দুই রাত থাকলে প্রায় একই রকম। আমি যখন বিদেশ থেকে দেশে আসতাম, তখন কখনোই এক এয়ারলাইনসে আসতাম না। দেখার জন্যই এটা করতাম। অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, বাংলাদেশ থেকে ফ্লাইট পরিচালনাকারীদের এয়ারলাইনসের যাত্রীদের মধ্যে ৯০ থেকে ৯২ শতাংশই বাংলাদেশি। বাংলাদেশে ফ্লাইট পরিচালনা যাঁরা করছেন, তাঁদের এক দিনে তিনটি করে ফ্লাইট আছে। আমার মনে হয়েছে যে এখানে একটি সুযোগ আছে।
তা ছাড়া দেখেছি, ঢাকা থেকে যশোর যেতে একসময় ছয়-সাত ঘণ্টা লাগত। ২০১৪ সালে ইউএস-বাংলা প্রথম যশোর শুরু করে। এর আগে কারও পক্ষেই সকালে যশোর গিয়ে বিকেলে ফের আসা সম্ভব ছিল না। সৈয়দপুরে কারও তেমন ফ্লাইট ছিল না। রাজশাহী, বরিশালে কারও কোনো ফ্লাইট ছিল না। এখন বরিশালে শুধু ইউএস-বাংলা যাচ্ছে। আমার মনে হয়েছে, মানুষ এই যে রাস্তায় সময় ব্যয় করছেন, সেখানে যদি সকালে একটা বিকেলে একটা ফ্লাইট দেওয়া যায়, তাহলে দিনে দিনে তাঁর কাজটা শেষ করে ঢাকায় ফিরতে পারবেন।

ফ্লাইট পরিচালনার ক্ষেত্রে যান্ত্রিক সমস্যা হচ্ছে এটি স্বাভাবিক ঘটনা। এটা থাকবেই। এয়ারলাইনস মানেই টেকনিক্যাল একটা বিষয়। এটা শুধু আমাদের দেশে নয়, সারা পৃথিবীতে। এভিয়েশনগুলো নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা আন্তর্জাতিক সিভিল এভিয়েশনের গত বছরের নিরীক্ষায় বাংলাদেশ বিমান ও ইউএস-বাংলার নম্বর ৭০-এর ওপরে। যেখানে বিশ্বের গড় হচ্ছে ৬০।

প্রথম আলো: দেশে ও দেশের বাইরে কতটি রুটে ইউএস-বাংলা ফ্লাইট পরিচালনা করে?
আবদুল্লাহ আল মামুন: বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ সব রুটেই ইউএস-বাংলা ফ্লাইট পরিচালনা করে। ইউএস-বাংলাই প্রথম যশোর, সৈয়দপুর, চট্টগ্রামে নিয়মিত ফ্লাইট চালু করেছে। দেশের ভেতরে সাতটি রুটে ফ্লাইট পরিচালনা করা হয়। আন্তর্জাতিক রুটের মধ্যে ভারত, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ওমান, কাতার এবং চীনে আমরা ফ্লাইট পরিচালনা করছি। দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসায়ীদের দাবি ছিল চীনে ফ্লাইট পরিচালনা করার। একসময় চীনের গুয়াংজুতে ইকোনমিক ক্লাসে রিটার্ন টিকিটের দাম ছিল ১ লাখ ১০ হাজার টাকা। সেখানে ইউএস-বাংলা নিচ্ছে মাত্র ৩০ হাজার টাকা।


প্রথম আলো: অভ্যন্তরীণ রুটে যাত্রীদের ভাড়া আরও কমানোর সুযোগ আছে বলে মনে করেন কি?
আবদুল্লাহ আল মামুন: দেখুন, বাংলাদেশে আমরা যারা এয়ারলাইনস অপারেটর আছি, তাঁরা সবচেয়ে বেশি খরচে ফ্লাইট পরিচালনা করছি। অপারেশনসের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সবচেয়ে ব্যয়বহুল। কিন্তু সারা পৃথিবীতে বাংলাদেশেই ভাড়া সাশ্রয়ী। ধরুন কেউ যদি ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে যেতে চান, তিনি এই মুহূর্তে তিন হাজার টাকা দিয়ে টিকিট পাবেন আমাদের কাছ থেকে। আজকে যদি নিউইয়র্ক সিটির কোনো ব্যবসায়ী চিন্তা করেন ফ্লোরিডা যাবেন, তাহলে তাঁকে টিকিট কিনতে হবে ৬০০ ডলারে। আবার যদি ওয়াশিংটন যেতে চান, যা ঢাকা-চট্টগ্রাম দূরত্বের তাঁকে টিকিট কিনতে হবে ৩৫০ ডলারে। তার মানে প্রায় ১৮ হাজার টাকা। একই দূরত্বে পাশের দেশ ভারতেও ভাড়া বাংলাদেশের চেয়ে দ্বিগুণ। তার মানে সবচেয়ে ব্যয়বহুল অপারেশনস এখানে, কিন্তু ভাড়া সবচেয়ে সাশ্রয়ী।

বাংলাদেশে বিভিন্ন এয়ারলাইনস টিকিট বিক্রি করে বছরে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার কোটি টাকা নিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে অর্ধেক যদি আমরা দেশীয় এয়ারলাইনস রাখতে পারি, তাহলে হাজার হাজার শিক্ষিত গ্র্যাজুয়েটের কর্মসংস্থান করা যাবে। যেটা অন্য কোনো সেক্টরে এত দ্রুত সম্ভব নয়।

প্রথম আলো: বাংলাদেশ কেন ব্যয়বহুল?
আবদুল্লাহ আল মামুন: ব্যয়বহুল কারণ, ভারতের কথাই যদি বলি, অনেকটা কম মূল্যে তারা জেট ফুয়েল পাচ্ছে। ল্যান্ডিং-পার্কিং প্রায় ফ্রি। ছয় সিটার পর্যন্ত ফ্লাইটগুলোকে ল্যান্ডিং-পার্কিং ফি দিতে হয় না। নেভিগেশন চার্জ বলে কিছু দিতে হয় না। আমাদের শুধু দিতেই হয় না, এশিয়া-দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বেশি। 

এসব নিয়ে সরকারের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশে বেসরকারি খাতে এভিয়েশন ব্যবসা নতুন। বাংলাদেশে আসলে এই ইন্ডাস্ট্রিটা মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারেনি। কেউ দুই বছর, তিন বছর থেকে আবার বন্ধ হয়েছে।
এভিয়েশনের নানা সমস্যা নিয়ে কিছু করতে হলে তিনটা মন্ত্রণালয়কে একসঙ্গে বসতে হবে। এগুলো হলো-বেসরকারি বিমান চলাচল, আইন ও অর্থ মন্ত্রণালয়। আমি মনে করি এভিয়েশনের জন্য আরেকটি কমিশন গঠন করতে হবে। শিক্ষায় যেমন কমিশন গঠন হয়েছে কীভাবে শিক্ষায় উত্তরণ ঘটাতে পারবে, তেমনি এভিয়েশনেও কমিশন গঠন করে একে কীভাবে ওপরে তোলা যায়, তা ভাবতে হবে।

প্রথম আলো: বাংলাদেশে এভিয়েশন ব্যবসা কতটা লাভজনক হবে?
আবদুল্লাহ আল মামুন: বাংলাদেশে বিভিন্ন এয়ারলাইনস টিকিট বিক্রি করে বছরে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার কোটি টাকা নিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে অর্ধেক যদি আমরা দেশীয় এয়ারলাইনস রাখতে পারি, তাহলে হাজার হাজার শিক্ষিত গ্র্যাজুয়েটের কর্মসংস্থান করা যাবে। যেটা অন্য কোনো সেক্টরে এত দ্রুত সম্ভব নয়। বিদেশি এয়ারলাইনসগুলোর ৯৮ শতাংশই বাংলাদেশি যাত্রী। এর মধ্যে ৮৮ শতাংশই আমাদের শ্রমিক ভাইয়েরা। বাকিরা হচ্ছেন করপোরেট, ট্রাভেলার। আমরা তিন বেসরকারি অপারেটর আছি, যারা বিদেশে ফ্লাইট পরিচালনা করি। তাদের মার্কেট শেয়ার মাত্র ১৫ শতাংশ। বাকি ৮৫ শতাংশই বিদেশিদের। এটা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া দরকার।

প্রথম আলো: নেপালে ইউএস-বাংলার ফ্লাইট দুর্ঘটনায় পড়ল। এর প্রভাব আপনাদের ওপর কতটা পড়েছে?
আবদুল্লাহ আল মামুন: আমাদের যাত্রীরা যাঁরা আছেন, ইউএস-বাংলার ওপরে তাঁদের বিশ্বাস আছে। যার ফল হচ্ছে এই দুর্ঘটনার পরেও আমাদের যাত্রী কমেনি। ব্যবসায় প্রভাব পড়েনি। এটা আসলে বিচ্ছিন্ন দুর্ঘটনাই। এটা কারোরই কাম্য নয়। আমাদেরও খারাপ লেগেছে। যাত্রীরা আমাদের ওপর বিশ্বাস রেখে নেপালের উদ্দেশে রওনা হয়েছেন। তাই দুর্ঘটনার পরে আমরা তাঁদের প্রতি সম্মান দেখানোর সর্বাত্মক চেষ্টা করছি। দুর্ঘটনার পর সিঙ্গাপুরে ও ভারতে আহত যাত্রীদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আহত ও নিহত যাত্রীদের ক্ষতিপূরণ দিতে কাজ চলছে।

প্রথম আলো: কখনো কখনো ফ্লাইটে যান্ত্রিক ত্রুটি ও জরুরি অবতরণের কথা শোনা যায়?
আবদুল্লাহ আল মামুন: ফ্লাইট পরিচালনার ক্ষেত্রে যান্ত্রিক সমস্যা (টেকনিক্যাল টার্ম) হচ্ছে এটি স্বাভাবিক ঘটনা। এটা থাকবেই। এয়ারলাইনস মানেই টেকনিক্যাল একটা বিষয়। এটা শুধু আমাদের দেশে নয়, সারা পৃথিবীতে। আমি এ ব্যাপারে প্রথম আলোর পাঠকদের এবং যাঁরা দেশীয় এয়ারলাইনসে ভ্রমণ করেন, তাঁদের উদ্দেশে বলতে চাই, বাংলাদেশ যাত্রীদের সুবিধা দেওয়ার ক্ষেত্রে সব সময় সচেষ্ট। এভিয়েশনগুলো নিয়ন্ত্রণ করে আন্তর্জাতিক সিভিল এভিয়েশন। গত বছর তারা নিরীক্ষা করেছে, সেখানে তারা বাংলাদেশ বিমান ও ইউএস-বাংলাকে নির্বাচন করেছে। আমাদের নম্বর ৭০-এর ওপরে। যেখানে বিশ্বের গড় হচ্ছে ৬০। ইউএস-বাংলায় ১৫০ প্রকৌশলী ও ১৭ জন বিদেশি প্রকৌশলী আছেন। একটা এয়ার ক্রাফট প্রথমে একজন প্রকৌশলী পরীক্ষা করেন, তারপরে ক্যাপ্টেন করেন। তারপরে সেটি উড্ডয়ন করে। তিন স্তরে চেক হয়। কিছু দিন ধরে দেখতে পাচ্ছি, টেকনিক্যাল কোনো কিছু হলেই মানুষের মধ্যে ভীতির সঞ্চার হয়। আমি অনুরোধ করব, টেকনিক্যাল বিষয় হচ্ছে পার্ট অব এভিয়েশন, ভয়ের কিছু নেই। পাশের দেশ ভারতে প্রতিদিন ২৫ থেকে ৩০টি টেকনিক্যাল সমস্যা হয়।

প্রথম আলো: ইউএস-বাংলা গ্রুপকে কোথায় দেখতে চান?
আবদুল্লাহ আল মামুন: আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে তিন বছরের মধ্যে ৩০-৩৫ হাজার গ্র্যাজুয়েটের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করব। তা ছাড়া বাংলাদেশে বছরে ১০ হাজার কোটি টাকার মোবাইল ফোন আমদানি হচ্ছে। এতে কর্মসংস্থান হচ্ছে বিদেশিদের। প্রতিবছর ২০ হাজার কোটি টাকার ইলেকট্রনিকস সামগ্রী আমদানি হচ্ছে। এখানে নিজস্ব আন্তর্জাতিক মানের ব্র্যান্ড থাকলে আমদানি কমে আসবে। কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়বে। পাশাপাশি রপ্তানি করতে পারব। এটাই হচ্ছে আমাদের লক্ষ্য।

প্রথম আলো: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
আবদুল্লাহ আল মামুন: আপনাকেও ধন্যবাদ।