চ্যালেঞ্জের মুখে বহুত্ববাদী ভাবাদর্শ

নরেন্দ্র মোদি
নরেন্দ্র মোদি

আগামী নির্বাচনে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারে যাতে পরিবর্তন আসে, সে জন্য দিল্লির আর্চবিশপ অনিল জোসেফ টমাস কুয়োটা ক্যাথলিক খ্রিষ্টানদের বিশেষ প্রার্থনা করতে বলেছেন। এটিকে যতই ন্যায্য কাজ বলে মনে করা হোক না কেন, আদতে তিনি রাজনীতির সঙ্গে ধর্ম মেশানোর মতো একটি গুরুতর ভুল করার জন্য দায়ী। সরকারের পরিবর্তন কামনায় প্রার্থনা ও উপোস করতে অনুরোধ করে তিনি একটি ভক্তিমূলক চিঠি পাঠিয়েছেন তাঁর সহকর্মী পুরোহিতদের কাছে। তিনি মনে করেন, ভারত এমন একটি বিপজ্জনক রাজনৈতিক ভবিষ্যতের মুখে পড়েছে, যা দেশটির গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামোর জন্য হুমকি।
আজকে জাতি হিসেবে ভারত যখন বিভিন্ন ফ্যাসিস্ট ও সংকীর্ণ চেতনার সংগঠনগুলো দ্বারা আক্রান্ত, তখন ধর্মীয় প্রধানদের মুখ খোলা অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায়। অবশ্য অনেকেই এটিকে ভারতের জন্য স্বাস্থ্যকর মনে করেন না। একে একে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ধর্মীয় নেতারা যদি রাজনৈতিক অঙ্গনে ঝাঁপ দেওয়া শুরু করেন, তাহলে রাজনীতি থেকে তাঁদের প্রত্যাশিত দূরত্ব আর থাকবে না।
নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ, তিনি তাঁর পোশাকে উগ্র হিন্দুত্ববাদের ব্যাজ পরেন এবং তিনি ভারতবাসীর মধ্যে বিভেদরেখা টেনে তাদের এতটাই আলাদা করে দিয়েছেন, যে অবস্থায় তারা কস্মিনকালেও ছিল না।
এ কারণেই কয়েকজন খ্রিষ্টান নেতার অভিযোগ, অন্য ধর্ম ও জাতিগোষ্ঠীর স্বার্থকে পাশ কাটিয়ে যেসব উগ্র সংগঠন ভারতে হিন্দু রাষ্ট্র কায়েম করতে চায়, ক্ষমতাসীন বিজেপি তাদের হয়ে কাজ করছে। তাঁরা বলেছেন, মোদি ক্ষমতায় আসার পর খ্রিষ্টানদের ওপর হামলা আগের চেয়ে অনেক বেড়ে গেছে।
সারা বিশ্বে খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের ওপর হামলা ও নির্যাতনের বিষয়ে খোঁজখবর রাখে এমন একটি সংগঠনের হিসাব অনুযায়ী, ভারতে ২০১৬ সালে খ্রিষ্টানদের ওপর যেখানে ৩৪৮টি হামলার ঘটনা ঘটেছে; সেখানে ২০১৭ সালে সেই সংখ্যা ৭৩৬টিতে পৌঁছেছে।
সহকর্মী পুরোহিতদের পাঠানো চিঠিতে আর্চ বিশপ লিখেছেন, ‘আমরা দেখছি এমন একটি ভয়াল অবস্থা তৈরি হচ্ছে যা আমাদের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে সমৃদ্ধ সংবিধান ও ধর্মনিরপেক্ষতার ভাবমূর্তিকে ক্রমে গ্রাস করে ফেলছে।’ এটি সবারই মাথায় থাকা দরকার। এ কথা আরও বেশি মনে রাখা দরকার, কারণ সাধারণ নির্বাচন একেবারেই সন্নিকটে।
ভক্তিমূলক চিঠিটিতে জাতির নিরাপত্তা চেয়ে স্রষ্টার কাছে বিশেষ প্রার্থনা করা হয়েছে। একই সঙ্গে চিঠিতে গির্জা, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও ক্যাথলিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রতি শুক্রবার প্রার্থনাসভার আয়োজন করে সেখানে দেশ ও জাতির জন্য বিশেষ প্রার্থনা করার জন্য বলা হয়েছে। চিঠিতে উল্লেখিত প্রার্থনার একটি অংশে বলা আছে, ‘স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার ও সত্যের আলো এক অশুভ মেঘে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে; হে প্রভু! এই দুঃসময়ে আমাদের নির্বাচনগুলোকে সত্যিকারের গণতন্ত্রে আচ্ছাদিত করুন এবং আমাদের নেতাদের হৃদয়ে সত্যিকারের দেশপ্রেমের বাতি জ্বালিয়ে দিন।’
দিল্লির আর্চ বিশপের এই উদ্যোগকে ভারতের ক্যাথলিক ও খ্রিষ্টান নেতারা স্বাগত জানিয়েছেন। অন্য সংখ্যালঘুরা তাদের দুঃখ-দুর্দশার কথা প্রকাশ করার মাধ্যম হিসেবে হয়তো এই একই পন্থা বেছে নিতে পারে। বিশেষ করে মুসলিম নেতারা ভারতের সংবিধানের গ্রহণযোগ্যতাকে চ্যালেঞ্জ করে বসতে পারেন। ইতিমধ্যে হায়দরাবাদের লোকসভার সদস্য আসাদুদ্দিন ওয়াইসি দেশ ভাগের আগের দিনগুলোতে মুসলিম লিগের নেতারা যেভাবে কথা বলতেন, সেভাবে বক্তব্য দিয়েছেন। হয়তো তিনি ধারণা করছেন, হিন্দু-মুসলমানের দ্বন্দ্বের পরিবেশ নতুন করে তৈরি হবে এবং সেই সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণ রাজনীতি তাঁকে দেশজোড়া পরিচিতি এনে দেবে।
সম্প্রতি আমি আলীগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটিতে গিয়েছিলাম। দেখলাম সেখানেও এই একই বিশ্বাসের জগতে সবাই ডুবে আছেন। ভারত ছাড়া যে তাঁদের জন্য অন্য কোনো উম্মাহ থাকতে পারে না, তা তাঁরা বিশ্বাস করতে পারেন না। কয়েক বছর আগে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ঐতিহ্যগত সমস্যার সমাধানের পন্থা নিয়ে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন হয়েছিল। ইসলামের ঐক্যের জন্য ভবিষ্যৎ করণীয় কী হতে পারে, সেটিই ছিল আলোচনার মূল বিষয়। মুসলমানদের ভবিষ্যৎ কেমন হবে এবং ঐক্যের জন্য তাদের কী করতে হবে, তা নিয়ে দুই দিনের সম্মেলনে আলোচকেরা যেসব বক্তব্য দিলেন তা খুব অদ্ভুত। মিসর থেকে আসা এক আলোচক বললেন, বিশ্বে মুসলমানদের যত গোষ্ঠী আছে, তাদের সবার প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি ‘একীভূত ইসলাম’ দাঁড়
করাতে হবে।
কিন্তু তাঁরা বুঝতে পারেননি, হিন্দু চরমপন্থা ঠেকাতে মুসলমান চরমপন্থা বা খ্রিষ্টান চরমপন্থা দাঁড় করানো কোনো সমাধান নয়। আর্চ বিশপ এই প্রার্থনার আহ্বানের মধ্য দিয়ে ভারত তার ধর্মনিরপেক্ষ মূল্যবোধ থেকে কতখানি সরে গেছে, তা নিয়ে আলোচনার সুযোগ তৈরি করেছেন। এর মাধ্যমে তিনি কোনো সাম্প্রদায়িক বিভেদ ও হিংসার উসকানি দিয়েছেন তা মনে করার কিছু নেই। এটি তাঁর লক্ষ্যও নয়।
তবে আর্চ বিশপের এই চিঠি দেওয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় মেক্সিকোয় দেওয়া পোপের ভাষণের মিল পাওয়া যায়। ট্রাম্প তাঁর প্রচারাভিযানের সময় বলেছিলেন, তিনি জিতলে মেক্সিকো সীমান্তে দেয়াল তুলবেন। পোপ যুক্তরাষ্ট্রের সীমান্ত লাগোয়া মেক্সিকোর অংশে দাঁড়িয়ে ওই সময় বলেছিলেন, যে ব্যক্তি মানুষের মধ্যে সেতু বানানোর কথা না ভেবে যত্রতত্র দেয়াল বানানোর কথা ভাবে, সে ব্যক্তি যথার্থ খ্রিষ্টান নয়। ওই সময় পোপ একবারও বলেননি, ট্রাম্পকে ভোট দেওয়া যাবে না। কিন্তু তাঁর বক্তব্যের মর্মার্থ বোঝাই যাচ্ছিল।
পোপ এটি সবার কাছে স্পষ্ট করেছিলেন, ট্রাম্প এবং তাঁর পলিসি নিয়ে তিনি চিন্তিত। পোপ নিজেকে একবার ‘রাজনৈতিক প্রাণী’ বলেও আখ্যায়িত করেছিলেন। ২০১৩ সালে প্রকাশ্যে তিনি বলেছিলেন, একজন ভালো ক্যাথলিক রাজনীতিতে নিজেকে জড়ায়। তিনি রাজনীতিকে তাঁর ধর্মীয় দায়িত্বের অংশ মনে করেন। হয়তো দিল্লির আর্চ বিশপ পোপের বইয়ের একটি পাতা ছিঁড়েছেন।
তবে দুর্ভাগ্যবশত, ভারতবর্ষে এই পন্থার হাত ধরে ধর্মনিরপেক্ষতা শক্তিশালী হবে না। বরং উল্টো প্রতিক্রিয়া হবে। আরএসএস হয়তো আর্চ বিশপের এই উদ্যোগকেই হাতিয়ার হিসেবে নেবে এবং হিন্দু রাষ্ট্র গড়ার অ্যাজেন্ডা ধরে তারা উগ্রপন্থীদের আরও উগ্র করে তুলবে।

ইংরেজি থেকে অনূদিত

কুলদীপ নায়ার ভারতের প্রবীণ সাংবাদিক ও কলামিস্ট