মুকতাদা সদর ও ইরাকের আবার রাষ্ট্র হয়ে ওঠা

ইরাকে সংসদীয় নির্বাচনের ফল মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের হিসাব ওলট-পালট করে দিয়ে থাকবে। নির্বাচনে শিয়া মুসলিম ধর্মগুরু মুকতাদা আল-সদরের নেতৃত্বাধীন সায়রুন জোট একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলেও সবচেয়ে বেশি আসন জিতেছে। জোটের প্রধান শরিক আল-সদরের নিজস্ব দল আর ইরাকি কমিউনিস্ট পার্টি। সায়রুন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র হায়দার আল-আবাদির নেতৃত্বাধীন জোটকে হারিয়ে দিয়েছে। তারা আছে তিন নম্বরে। দ্বিতীয় হয়েছে ইরানের আশীর্বাদপুষ্ট হাদি আল-আমেরির ফাতাহ।

আল-সদরের জয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরান দুই পক্ষেরই মাথাব্যথা স্বাভাবিক। কট্টর মার্কিনবিরোধী হিসেবে তিনি সুপরিচিত। এমন একসময়ে আল-সদর ইরাকের রাজনীতির নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠলেন, যখন ইরানকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র নয়া ছক কষছে। আল-সদরকে ইরানও খুব একটা পছন্দ করে না। স্বাধীনচেতা হিসেবে তিনি সুপরিচিত। ভোটের প্রচারে ইরাকে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টার জন্য তিনি ইরানের সমালোচনাও করেছেন। তবে এটাও ঠিক, সেখানে কোনো যুদ্ধাবস্থা তৈরি হলে আল-সদর কী ভূমিকা নেবেন, বলা কঠিন। আল জাজিরার মধ্যপ্রাচ্য বিশ্লেষক জাহিদ আল-আলী মনে করেন, ইরাককে বিদেশি প্রভাবমুক্ত করতে প্রয়োজনীয় দর-কষাকষির জন্য আল-সদর এখন যথেষ্ট শক্তি ধরেন।

আল-আবাদির অপ্রত্যাশিত তৃতীয় স্থান পাওয়ায় ওয়াশিংটন হয়তো হতাশই। যদিও সরকার গঠনে আল-সদরের সঙ্গে তাঁর যোগ দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এমনকি প্রধানমন্ত্রী পদেও থেকে যেতে পারেন।

নির্বাচনে কোনো দলই কার্যকর সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। সরকারি হিসাব অনুসারে আল-সদর ও তাঁর সায়রুন জোট ৫৪টি আসন লাভ করেছে। আল-আমিরির ফাতাহ পেয়েছে ৪৭টি। আল-সদরের ৫৪ আসন নতুন সংসদে মোট আসনের মাত্র ১৬ দশমিক ৪ শতাংশ। কিন্তু ইরাকের রাজনীতি এতটাই দল-উপদলে ছিন্নভিন্ন যে, এই সামান্যই বিরাট তাৎপর্যের সমান। নতুন সংসদে ২৮টি দল জায়গা নেবে, যাদের আসনসংখ্যা ৫ বা তারও কম। মিলিতভাবে এসব দল ৫৮টি বা আনুমানিক ১৮ শতাংশ আসনের মালিক হবে।

ইরাকের এই নির্বাচনের বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। কোনো জোটই সাম্প্রদায়িক বিবেচনায় লড়াই করেনি। আল-সদরের জোটে কিছু সুন্নিও রয়েছেন। প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে মূলত দুর্নীতিমুক্ত দেশ গড়ার কর্মসূচিতে। পাশাপাশি আইএসকে হটিয়ে ইরাকে এমন একটি পরিবেশ তৈরি হয়েছে, যখন বিশ্বের দরবারে ইরাক বহুকালের মধ্যে একটি রাষ্ট্র হিসেবে প্রথমবারের মতো বৈধতার মর্যাদা পাচ্ছে।

অবশ্য ইরাকের সব অগ্রগতিই এককভাবে দেশটির অভ্যন্তরীণ উন্নয়নের ফল নয়। এর পেছনে অনুকূল ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি—বিশেষ করে ২০১৫ সালে ওয়াশিংটন ও ইরানের মধ্যে জয়েন্ট কমপ্রিহেনসিভ প্ল্যান অব অ্যাকশন (জেসিপিওএ) বিরাট ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু এখন আর সে অবস্থা থাকছে না। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে নিয়েছেন। নিশ্চিতভাবেই ধরে নেওয়া যেতে পারে এর ফলে যুক্তরাষ্ট্র-ইরানের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটবে। সে রকম অবস্থায় ইরাকের ভঙ্গুর অভ্যন্তরীণ শান্তি বিপদগ্রস্ত হওয়া বিচিত্র নয়। তেমন হলে ইরাক আবার সাম্প্রদায়িক হানাহানিতে ফিরে যাবে, যা শুরু হয়েছিল সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসনের মধ্যে।

ফরেন অ্যাফেয়ার্সের জেমস ফ্রমসন ও স্টিভেন সায়মন মনে করেন, ইরাকের ঘরের অবস্থা আগের চেয়ে ভালো হওয়ার প্রাথমিক কারণ আইএসের পরাজয়। আল-আবাদি ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে ইরাক আইএসমুক্ত হয়েছে—এ ঘোষণা দেওয়ার পর থেকেই সেখানে পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করে। মসুলে হারের পর ইরাকি সেনাবাহিনীর মুখে চুনকালি পড়েছিল। আইএসকে শেষতক হারাতে পারায় মর্যাদা অনেকটাই ফেরত পেয়েছে তারা। ইরানের সমর্থনপুষ্ট পপুলার মোবিলাইজেশন ফোর্সেসও (পিএমএফ) এই গৌরবের ভাগীদার। আইএসবিরোধী অভিযানের সাফল্য এবং সুন্নিদের গেরিলা কর্মকাণ্ড ইরাকে জাতীয়তাবাদের পালে হাওয়া দিয়ে দেশটিতে গোষ্ঠীমুক্ত রাজনীতির সুবাতাসের জন্ম দিয়েছে।

পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ইরাকের অর্থনীতিও চাঙা হয়েছে। ফেব্রুয়ারি মাসে কুয়েতে অনুষ্ঠিত বিনিয়োগ সম্মেলনে গালফ কো-অপারেশন কাউন্সিল থেকে দেশটি উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ পেয়েছে। পাশাপাশি যুদ্ধের সময়েও তেলের উৎপাদন আনুমানিক ২৫ শতাংশ বাড়াতে সমর্থ হওয়ায়, বিশ্বব্যাপী তেলের বাজারে মন্দা সত্ত্বেও, সেখানে অর্থনীতি স্থিতিশীল থেকেছে।

ইরাকের অগ্রগতির পথে বাইরের রাজনৈতিক জটিলতা বরাবর একটা সমস্যা। ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও তার উপসাগরীয় মিত্রদের মধ্যে নতুন কোনো দ্বন্দ্ব দ্রুতই নড়বড়ে ইরাকি জাতীয়বাদের জায়গায় গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের সূচনা ঘটাতে পারে। আল-আবাদির মতো রাজনীতিকেরা পরিষ্কার করেই বলেছেন, তাঁরা ইরাককে যুক্তরাষ্ট্র-ইরানের শত্রুতার মৃগয়াক্ষেত্র বানাতে চান না। কিন্তু এ প্রসঙ্গে এ কথাও মনে রাখা দরকার, ইরাকের ভাগ্যবিধাতা সে দেশের মানুষের—এমন দাবি বড়জোর কল্পনাবিলাস।

এমনকি সরাসরি সহিংসতা যদি শুরু না-ও হয়, যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে চরম উত্তেজনা ইরাকি সরকার গঠনে প্রভাব ফেলতে বাধ্য। ইরানি পরিকল্পকেরা নিজেদের আত্মরক্ষার তাগিদেই ইরাকের ওপর তাঁদের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার বিষয়টা আগের চেয়ে বেশি জরুরি বলে দেখবেন এবং যুক্তরাষ্ট্রকে বাধা দেওয়ার মঞ্চ হিসেবে ইরাককে ব্যবহার করতে চাইবেন। একই কাজ করতে পারে যুক্তরাষ্ট্রও। উভয়পক্ষ ছায়া গোষ্ঠীগুলোর (Proxy) সাহায্যে ইরাকের ওপর চাপ প্রয়োগ করে যাবে।

চলতি সংখ্যা ‘ফরেন অ্যাফেয়ার্স-এ ‘দ্য এন্ড অব ইরান ডিল কুড ডিস্ট্যাবিলাইজ ইরাক’ নিবন্ধে ফ্রমসন ও সায়মন বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রকে চাপে রাখতে ইরান বিশেষভাবে চাইবে ইরাকে নতুন সরকারের জ্যেষ্ঠ পদগুলো ইরানি সমর্থনপুষ্ট আমেরি ও কাসিম আল-আরাজির নেতৃত্বাধীন শিয়া মিলিশিয়াদের দিয়ে পূরণ করতে। যদি সাবেক প্রধানমন্ত্রী নুরি আল-মালিকির দাওয়া পার্টি আবাদির নেতৃত্বাধীন সরকারে যোগ দেয়, তাহলে আবাদি ও মালিকির মধ্যে আপস প্রার্থী হিসেবে প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন মালিকির সাবেক চিফ অব স্টাফ তারিক নাজম। ইরানের চাহিদার প্রতি তাঁর সহানুভূতিশীল হওয়াটা অবাক কিছু হবে না।

এগুলো হচ্ছে কয়েকটি সম্ভাবনা মাত্র। বাস্তব পরিস্থিতি তরল; এসব কুশীলবের কাউকে কাউকে শীর্ষ পদগুলোয় দেখা যেতে পারে, অন্যরা অতল অন্ধকারে হারিয়ে যেতে পারেন। তবে ইরান-সমর্থক প্রার্থীদের সবাই ইরাকে আমেরিকান প্রতিনিধিদের সঙ্গে কমবেশি লম্বা সময়ের জন্য কাজ করেছেন। ইরানের প্রতি সহানুভূতি সত্ত্বেও, তাঁরা সবাই যথেষ্ট বাস্তববাদী এবং ইরাকের উন্নয়নে যুক্তরাষ্ট্রের অব্যাহত সহযোগিতা পাওয়ার আশায় নিজেদের মুক্তমনা বলে দাবি করতে পারেন। কিন্তু তেহরানের সঙ্গে ওয়াশিংটনের লড়াই বাধলে—যা বাধানোর জন্য মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের দুই ক্লায়েন্ট স্টেট ইসরায়েল ও সৌদি আরবের কোশেশের কমতি নেই—ইরাকি কর্মকর্তাদের থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। সদরের শক্তিশালী উপস্থিতি সেই সহযোগিতার ক্ষেত্রে বাড়তি অনিশ্চয়তা যোগ করছে।

যতক্ষণ পর্যন্ত না যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে উত্তেজনা চরমে উঠছে, ইরান সম্ভবত ইরানপন্থী একটি মন্ত্রিপরিষদ নিয়েই সন্তুষ্ট থাকবে। তারা চেষ্টা করবে সরকারি কার্যক্রমে পিএমএফের ভূমিকা যেন বজায় থাকে। পাশাপাশি কাতায়িব হিজবুল্লাহর মতো জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোও লালন করবে। ইরান এই শক্তিকাঠামোগুলোকে সম্ভাব্য মার্কিন হামলাকে নিরুৎসাহিত করার জন্য আবশ্যক মনে করে।

যদি আগামী দিনগুলোয় লেবানন, সিরিয়া, পারস্য উপসাগরে সহিংসতা মাথাচাড়া দেয় কিংবা ইরানের পারমাণবিক স্থাপনার ওপর মার্কিন বা ইসরায়েলি হামলা হয়, ইরান তার সমর্থক সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে দিয়ে ইরাকের অভ্যন্তরে মার্কিন লক্ষ্যবস্তুর ওপর হামলা চালাবে। সে ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রও চুপ করে থাকবে না। ইরাকে নিজের উপস্থিতি বাড়ানোর পাশাপাশি ইরাকি সরকারকে চাপ দেবে তাদের নোংরা কাজগুলো করে দেওয়ার জন্য। তেমন অবস্থায় ইরাকি জনগণের কাছে নতুন সরকারের বৈধতা ক্ষুণ্ন হবে।

এই পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা আগাম বলা কঠিন। যুক্তরাষ্ট্র ও ইরান, উভয়েরই ইরাকে খেলার মতো তাস আছে। প্রশ্ন হচ্ছে, কে কাকে বাজিতে হারায়। তবে একটি জিনিস নিশ্চিত: ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে যদি সত্যিকার সংঘাত শুরু হয়, ইরাকের একটি রাষ্ট্রব্যবস্থায় ফিরে যাওয়ার প্রক্রিয়াটি আবার থেমে যাবে।

রওশন জামিল চৌধুরী: সাংবাদিক
[email protected]