মিয়ানমারকে সাজা দিতে পারবে আইসিসি?

আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) একজন কৌঁসুলি গত ৯ এপ্রিল আইসিসির বিচারকদের কাছে একটি আবেদনপত্র পেশ করেছেন। আবেদনপত্রে কৌঁসুলি বিচারকদের কাছে জানতে চেয়েছেন, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বিষয়ে তদন্ত করার এখতিয়ার তাঁর আছে কি না এবং রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে তাড়িয়ে দেওয়ার জন্য মিয়ানমারের বিরুদ্ধে তিনি মামলা করতে পারবেন কি না।

এই দরখাস্তের সর্বসাম্প্রতিক প্রেক্ষাপট খুঁজতে আমাদের গত বছরের ২৫ আগস্টে ফিরে যেতে হবে। ওই দিন থেকে রাখাইনে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী তথাকথিত ‘নিরাপত্তা অভিযান’ চালানো শুরু করে। ২৫ আগস্ট থেকে ২৪ সেপ্টেম্বর ৭৩০টি শিশুসহ কমপক্ষে ৬ হাজার ৭০০ রোহিঙ্গাকে মেরে ফেলা হয়। ওই সময় কতজন নারীকে নির্যাতন করা হয়েছে, তা এখন সুনির্দিষ্ট করে বলা কঠিন। তবে এটি নিশ্চিত, ওই সময় হাজার হাজার রোহিঙ্গা নারী ও শিশুকে ধর্ষণ করা হয়েছে। রোহিঙ্গাদের হাজার হাজার ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে এবং তাদের বাংলাদেশে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

গত মার্চ মাসের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরে বর্তমানে ৮ লাখ ৩৬ হাজার ২১০ জন রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়ে আছে।

যেসব দেশ আইসিসির সদস্য, সেসব দেশের ভেতরে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যার বিচারের এখতিয়ার আইসিসির রয়েছে। সদস্যদেশগুলোর কোনো নাগরিক যদি একই ধরনের অপরাধ তাঁর দেশের বাইরে করেন, তাহলে তাঁর বিচারও আইসিসি করতে পারে। এখন কথা হলো, মিয়ানমার আইসিসির সদস্য নয়। তার মানে, মিয়ানমারের ভেতরে যত অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, তার বেশির ভাগেরই বিচার করার এখতিয়ার আইসিসির নেই।

তবে যদি এটা প্রমাণ করা যায় মিয়ানমারের কর্মকাণ্ডে আইসিসির সদস্যদেশ বাংলাদেশ ক্ষতির শিকার হয়েছে, তাহলে মিয়ানমারকে বিচারের আওতায় আনা আইসিসির এখতিয়ারভুক্ত হতে পারে। ওই কৌঁসুলির ভাষ্যমতে, লোকজনকে জোরপূর্বক দেশছাড়া করা এই ধরনের অপরাধের পর্যায়ে পড়ে। দেশত্যাগে বাধ্য করার বিষয়টি প্রমাণ করতে হলে এটি অবশ্যই প্রমাণ করতে হবে ভিকটিমরা আন্তর্জাতিক সীমান্তরেখা অতিক্রম করে এক দেশ থেকে অন্য দেশে ঢুকেছে। ভিকটিমরা এক দেশ থেকে অন্য দেশে পালাতে বাধ্য হয়েছে—এটি প্রমাণ করা গেলেই এটিকে বিতাড়নের অপরাধ হিসেবে আমলে নেওয়া সম্ভব।

রোহিঙ্গাদের ক্ষেত্রে আশ্রয়দাতা দেশটি হলো বাংলাদেশ। কৌঁসুলি বলছেন, যদিও আইসিসির সদস্যদেশে অপরাধ অংশত সংঘটিত হচ্ছে, সেই বিবেচনায় এই আদালত তাঁর বিচারের এখতিয়ার বিবেচনা করে দেখতে পারেন। উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বিশ্লেষক এই যুক্তির পক্ষে মত দিয়েছেন এবং এটি বিবেচনার জন্য আইসিসির ওপরে বড় ধরনের চাপ তৈরি হয়েছে। তথাপি, কৌঁসুলির যুক্তি থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ বাদ পড়েছে। ‘শান্তি মহিলা’ নামের একটি সংগঠনের চার শ জন সদস্যের পক্ষে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন গ্লোবাল রাইটস কমপ্লায়েন্স (জিআরসি) যুক্তি দেখিয়ে বলেছে, মিয়ানমার শুধু যে বাংলাদেশে জোর করে রোহিঙ্গাদের ঠেলে দিয়ে অংশত মানবতাবিরোধী কাজ করছে তা-ই নয়, এর বাইরেও মিয়ানমার বাংলাদেশের ভূখণ্ডে তিনটি অপরাধ করছে। সেগুলো হলো: বর্ণবাদী আচরণ, গণহত্যা ও নির্যাতন।

 শুরুতেই এটি জোর দিয়ে বলা খুবই জরুরি যে বিতাড়ন, নির্যাতন, গণহত্যা ও বর্ণবাদী আচরণ—এই চার অপরাধের সব কটিই এমন পর্যায়ভুক্ত অপরাধ, যা সাধারণত দীর্ঘ মেয়াদে সংঘটনকারীকে বন্ধ করতে বাধ্য না করা পর্যন্ত তা দীর্ঘ মেয়াদে চলতে থাকে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কাউকে যদি বেআইনিভাবে জেলে দেওয়া হয়, তাহলে শুধু তাকে জেলে ঢোকানোর মুহূর্তটিকে অপরাধের সময় হিসেবে ধরা হয় না। যতক্ষণ পর্যন্ত সে সম্পূর্ণ মুক্ত না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত পুরো সময়টুকুই অপরাধকাল বলে ধরা হয়। বিতাড়ন, নির্যাতন, গণহত্যা ও বর্ণবাদী আচরণ— এই চার অপরাধের ক্ষেত্রে ঠিক একই কথা বলা যায়।

 যতক্ষণ রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে থাকতে বাধ্য হবে এবং তাদের দেশে ফিরে যাওয়া ঠেকাতে যতক্ষণ মিয়ানমার তৎপরতা চালাবে, ততক্ষণ মিয়ানমার সরকার জোরপূর্বক কাউকে দেশছাড়া করার অপরাধের সঙ্গে জড়িত বলে ধরে নেওয়া হবে। শুধু তা-ই নয়, নির্বাসনকে যদি সামগ্রিক নির্যাতনের অংশ হিসেবে ব্যবহার করা হয়, তাহলে রোহিঙ্গারা যত দিন বাংলাদেশে থাকবে, তত দিন মিয়ানমার তাদের ওপর ঠান্ডা মাথায় নির্যাতন করছে বলে ধরে নিতে হবে।

 জাতিসংঘ বলেছে,নির্যাতনের অংশ হিসেবে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার বিতাড়ন করেছে। এই অপরাধগুলো বাংলাদেশে ঘটেছে বলে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মামলা করার এখতিয়ার আইসিসির আছে বলে অনেকেই মনে করছেন। কিন্তু আইসিসি সেই এখতিয়ার কাজে লাগাবে কি?

আল-জাজিরা থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনূদিত

ওয়েনি ওরদাস এবং উজে আয়সেভ মানবাধিকার আইনজীবী ও লেখক