পাকিস্তানের রাজনীতিকেরাও একমত হতে পারেন!

অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী নিসারুল মুলক
অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী নিসারুল মুলক


ইতিহাস গড়ল পাকিস্তান! প্রায় ৭১ বছর বয়সী দেশটিতে মাত্র দ্বিতীয়বারের মতো গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত কোনো সরকার বেসামরিক কোনো সরকারের কাছে ক্ষমতার হস্তান্তর করল। ক্ষমতা অবশ্য এখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের হাতে। অন্তর্বর্তী এই সরকারের দায়িত্ব হলো একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করে নতুন সরকারের হাতে ক্ষমতা তুলে দেওয়া। তবে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো নানা কারণে টালমাটাল রাজনীতির মধ্যেও অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে একমত হতে পেরেছেন দেশটির রাজনীতিকেরা।

পাকিস্তানের সাবেক প্রধান বিচারপতি নিসারুল মুলককে অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বেছে নিয়েছেন রাজনীতিকেরা। ১ জুন তিনি দেশটির সপ্তম অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। আগামী ২৫ জুলাই সাধারণ নির্বাচন আয়োজনই তাঁর প্রধান কাজ। পাকিস্তানের সংবিধান অনুযায়ী বিদায়ী পার্লামেন্টের প্রধানমন্ত্রী বিরোধী দলের নেতার সঙ্গে আলোচনা করে অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দেবেন। এ ক্ষেত্রে ওই দুই নেতা তিনজন করে মোট ছয়জনের নাম প্রস্তাব করবেন। সেই নামগুলো থেকে অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে একজনের নাম চূড়ান্ত করা হবে।

পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট মামনুন হোসাইন দেশটির অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ পড়ান সাবেক প্রধান বিচারপতি নিসারুল মুলককে (বাঁয়ে)। ইসলামবাদে প্রেসিডেন্ট হাউসে গত শুক্রবার ছিল এই আয়োজন। ছবি: এএফপি
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট মামনুন হোসাইন দেশটির অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ পড়ান সাবেক প্রধান বিচারপতি নিসারুল মুলককে (বাঁয়ে)। ইসলামবাদে প্রেসিডেন্ট হাউসে গত শুক্রবার ছিল এই আয়োজন। ছবি: এএফপি


পাকিস্তানে চলমান রাজনৈতিক পরিবেশে এটা ছিল কঠিন এক কাজ। যখন দেশটির নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ দুর্নীতির দায়ে পদত্যাগ করে আদালতের আদেশে নিজের দলের সভাপতির পদও ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। সেনাপ্রধান কামার জাবেদ বাজওয়া ক্ষমতা দখলকারী পূর্বসূরিদের মতো নানাভাবে নিজের অবস্থান জানান দিচ্ছেন, সুপ্রিম কোর্টের নানা আদেশে ভিন্ন আভাস পাচ্ছেন কেউ কেউ, তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) নেতা ইমরান খান প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য সবকিছু করতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন, কট্টরপন্থী দলগুলো নির্বাচন সামনে রেখে সক্রিয় হয়ে উঠছে। আসন্ন নির্বাচন নিয়ে সংশয়ও প্রকাশ করছেন কেউ কেউ। তাঁদের একজন মিডল ইস্ট ইনস্টিটিউটের ফেলো ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক আরিফ রফিক। তাঁর মতে, রাজনৈতিক দলগুলো ঐকমত্যের ভিত্তিতে একজনকে নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বেছে নেওয়ার ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। কিন্তু ওই নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ না হওয়ার আশঙ্কা দিন দিন জোরালো হচ্ছে।

এমন পরিস্থিতিতেও কঠিন কাজটি করে ফেললেন নওয়াজের দলের (পিএমএল-এন) নেতা বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী শহিদ খাকান আব্বাসি ও পার্লামেন্টের বিরোধী দল পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) নেতা খুরশিদ শাহ। ডন নিউজের খবর অনুযায়ী অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বেশ কয়েকজনের নাম আলোচিত হয়। এই তালিকায় নিসারুল মূলক ছাড়াও ছিলেন সাবেক প্রধান বিচারপতি তাসাদুক হোসাইন জিলানি, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর শামসাদ আখতার। নাম শোনা গেছে পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান জাকা আশরাফ ও যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত পাকিস্তানের সাবেক রাষ্ট্রদূত জলিল আব্বাস জিলানিরও। তবে নিসারুল মূলকের বিষয়ে একমত হন আব্বাসি ও খুরশিদ। সবচেয়ে প্রশংসনীয় পর্বটি এল ২৮ মে অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রীর নাম ঘোষণার সংবাদ সম্মেলনে। ইসলামাবাদে ওই সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় পরিষদের স্পিকার আয়াজ সাদিক, প্রধানমন্ত্রী আব্বাসি ও বিরোধী দলীয় নেতা খুরশিদ শাহ। সবাইকে অবাক করে দিয়ে অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রীর নাম ঘোষণা করলেন বিরোধী দলের নেতা খুরশিদ। তাঁকে এই নাম ঘোষণার জন্য অনুরোধ করেন প্রধানমন্ত্রী নিজেই। প্রধানমন্ত্রী সৌজন্যতা করেই হোক বা বিনয় করে হোক বিরোধী দলের নেতাকে নাম ঘোষণার জন্য অনুরোধ করেছেন। খুরশিদ শাহও প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়ে বললেন, প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধে তিনি নাম ঘোষণা করছেন। সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে যেসব নাম প্রস্তাব করা হয়েছিল, তার কোনোটির বিরুদ্ধেই কারও ব্যাপক আপত্তি ছিল না। তবে তাঁদের মধ্যে নিসারুল মূলককে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি বলে মনে হওয়ায় তাঁকেই চূড়ান্তভাবে মনোনীত করা হয়েছে।

ইসলামাবাদে সংবাদ সম্মেলনে আয়াজ সাদিক (মাঝে), শহিদ খাকান আব্বাসি (বামে) ও খুরশিদ শাহ (ডানে)। ছবি: এএফপি
ইসলামাবাদে সংবাদ সম্মেলনে আয়াজ সাদিক (মাঝে), শহিদ খাকান আব্বাসি (বামে) ও খুরশিদ শাহ (ডানে)। ছবি: এএফপি


পাকিস্তানের চলমান রাজনীতিতে এটা সত্যিই অসাধারণ সম্প্রীতির এক দৃষ্টান্ত। আব্বাসি ও খুরশিদকে ধন্যবাদ। ধন্যবাদ ইমরান খানকেও। বিদায়ী পার্লামেন্টের তৃতীয় বৃহত্তম দলের এই নেতা অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী নিসারুল মুলককে স্বাগত জানিয়েছেন। অর্থাৎ বিদায়ী পার্লামেন্টের প্রধান তিন দলই অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী বাছাইয়ের ব্যাপারে একমত হয়েছেন। মে মাসে গ্যালাপের জরিপে এই তিন দলই জনপ্রিয়। সবার চেয়ে এগিয়ে আছে নওয়াজের পিএমএল-এন (৩৮শতাংশ)। তার পরেই আছে ইমরানের পিটিআই (২৫শতাংশ), তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে জারদারি-বিলওয়ালের পিপিপি (১৫ শতাংশ)।

১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের জন্মের পর অর্ধেকের বেশি সময় ছিল সরাসরি সামরিক শাসন কিংবা বেসামরিক ছদ্মাবরণে সামরিক একনায়কের শাসন। এই দেশটিতে এখন পর্যন্ত গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত কোনো প্রধানমন্ত্রীই তাঁর পাঁচ বছরের মেয়াদ পূরণ করতে পারেনি। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত মাত্র দুটি সরকার টানা তার মেয়াদ শেষ করতে সক্ষম হলো। অর্থাৎ প্রায় ৭১ বছর বয়সী দেশটির জনগণ এই প্রথম দেখল টানা ১০ বছর তাঁদের ভোটে নির্বাচিত দুটি সরকার ক্ষমতার মেয়াদ শেষ করল। সেই দেশের যেকোনো পরিস্থিতিতে এমন রাজনৈতিক ঐক্য সত্যিই জরুরি। আর সেটাই যেন করে দেখালেন রাজনীতিকেরা। ধন্যবাদ নওয়াজ, জারদারি, ইমরান! ধন্যবাদ খাকান আব্বাসি, খুরশিদ শাহ!

মাহফুজার রহমান: সাংবাদিক
[email protected]