মাননীয় সিইসি, আসল কাজ কী করলেন?

প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদা। ফাইল ছবি
প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদা। ফাইল ছবি

জুন ‘প্রথম আলো’য় দ্বিতীয় পাতায় কে এম নুরুল হুদার ছবি ও খবরটি দেখে ভালো লাগল। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) পদে থেকেও তিনি পরিবহন খাতের নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন। কে এম নুরুল হুদা পরিবেশ আন্দোলন বাংলাদেশের (পবা) আজীবন সদস্য। শনিবার জাতীয় জাদুঘরের সামনে সংগঠনটির উদ্যোগ আয়োজিত মানববন্ধন কর্মসূচিতে তিনি শুধু যোগই দেননি, সড়কে অবৈধ পার্কিং ও ফুটপাতের ওপর অবৈধ দোকানপাট তথা পরিবহন খাতের নৈরাজ্য বন্ধ করতে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করারও আহ্বান জানিয়েছেন।

মানববন্ধনটি আয়োজন করা হয়েছিল পরিবেশ আন্দোলনকারী ‘উত্তম হত্যার বিচার: সড়ক পথে পরিবহন নৈরাজ্য ও মানুষ হত্যা’ বন্ধের দাবিতে। এতে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক দুই উপদেষ্টা সুলতানা কামাল ও রাশেদা কে চৌধুরী, পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যান ইকরাম আহমদে, বাপার সাধারণ সম্পাদক আবদুল মতিন, যুগ্ম সম্পাদক ইকবাল হাবিব প্রমুখ।

পরিবহন খাতের নৈরাজ্য বন্ধের দাবিতে অন্যদের সঙ্গে সিইসি কে এম নুরুল হুদা রাজপথে নেমেছেন, এ জন্য তাঁকে বিশেষভাবে ধন্যবাদ দিই। আমাদের দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি হলো, রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন ব্যক্তিরা অবসরে যাওয়ার পর বড় বড় কথা বলেন। সরকারকে নানা উপদেশ দেন। তার আগে কোনো অন্যায়ের প্রতিবাদ করেন না। কিন্তু ভারতে দেখেছি পুলিশ বিভাগের সর্বোচ্চ পদে আসীন থেকেও কিরন বেদি সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। আইজিপি হিসেবে তিনি দিল্লির তিহার জেলকে বন্দীদের জন্য ‘স্বর্গ’ বানিয়েছিলেন। আমরা আশা করব, অন্যান্য পদাধিকারীও সিইসির পদাঙ্ক অনুসরণ করে সমাজে যে অন্যায়-অবিচার চলছে, তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হবেন।

পবার সেদিনের সমাবেশে বক্তাদের কথায় দুটি বিষয় প্রাধান্য পায়। এক. পরিবহন খাতে ভয়াবহ নৈরাজ্য। দুই. জবাবদিহির অভাব। প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় গড়ে ১৫-১৬ জন মানুষ মারা যাচ্ছে। কিন্তু সড়ক পরিবহনের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিবর্গ এবং তাঁদের নীতিনির্ধারকদের চৈতন্যোদয় হয়েছে বলে মনে হয় না। তাঁরা বেপরোয়া চালকদের নিবৃত্ত না করে যাত্রীসাধারণকে সচেতন করার উপদেশ দিচ্ছেন। যাত্রী বা পথচারীদের সচেতন হওয়ার প্রয়োজন অস্বীকার করছি না। কিন্তু যখন চালকদের বেপরোয়া গাড়ি চালানো ও অসুস্থ প্রতিযোগিতায় প্রতিদিন মানুষ মারা যাচ্ছে, তখন যাত্রীদের প্রতি সদুপদেশ ভুল বার্তা দিতে পারে; দিচ্ছে।
অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা অবসরের আগে যুক্ত হলে সমাজে তার প্রভাব অনেক বেশি পড়ে। সেদিক থেকে কে এম নুরুল হুদা একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন। ওই সমাবেশে সিইসি যে সড়কে অবৈধ গাড়ি পার্কিং এবং ফুটপাতের ওপর দোকান বন্ধ করার যে আহ্বান জানিয়েছেন, আমরা তা দৃঢ়ভাবে সমর্থন জানাই। আশা করব, পরিবহন খাতের নৈরাজ্য কমবে। মানুষ নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবে।

তবে এ সুযোগ তাঁকে এ কথা মনে করিয়ে দিতে চাই যে নৈরাজ্য তো শুধু পরিবহন খাতে নয়; ব্যাংকিং থেকে আমদানি-রপ্তানি প্রায় সবখানেই এক নৈরাজ্য অবস্থা। তিনি যে সাংবিধানিক দায়িত্বে আছেন, সেখানেও সেটাও নৈরাজ্যমুক্ত বলা যাবে না। সুষ্ঠু নির্বাচন সব সময় গণতন্ত্র নিশ্চিত করতে পারে না। কিন্তু নির্বাচন ছাড়া গণতন্ত্রের কথা ভাবা যায় না। অর্থাৎ গণতন্ত্রের প্রথম ধাপ। সেখানে গোলমাল থাকলে গণতন্ত্র হবে না।

বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১১৯-এ নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব বর্ণিত আছে। তারা রাষ্ট্রপতি ও সংসদ নির্বাচন পরিচালনা, নির্বাচনের জন্য ভোটার তালিকা প্রস্তুতকরণ, নির্বাচনী এলাকার সীমানা পুনর্নির্ধারণ, আইন কর্তৃক নির্ধারিত অন্যান্য নির্বাচন পরিচালনা (এর মধ্যে সব স্থানীয় সরকার পরিষদ, যেমন ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা, সিটি করপোরেশন, উপজেলা পরিষদ, জেলা পরিষদ, পার্বত্য জেলা পরিষদ অন্তর্ভুক্ত) এবং আনুষঙ্গিক কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করে থাকে। দায়িত্ব পালনে ইসি স্বাধীন থাকবে এবং সংবিধান ও আইন দ্বারা পরিচালিত হবে।

সংবিধান যে নির্বাচন কমিশনের ওপর একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব দিয়েছে, সেটি তারা কতটা দক্ষতা ও সততার সঙ্গে পালন করতে পারে, তার ওপরই গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। বর্তমান কমিশনের পদাধিকারীরা হয়তো বলবেন, দীর্ঘদিনের অনিয়ম, ত্রুটি-বিচ্যুতি রাতারাতি দূর করা যাবে না। বাংলাদেশের মানুষ ধৈর্যশীল। তাঁরা ইসিকে সময় দিতে চান। সেই সঙ্গে এটাও দেখতে চান, পদাধিকারীরা আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করছেন। কে এম নুরুল হুদার কমিশন অনেক ভাগ্যবান। কমিশনের পদাধিকারীদের আগের পরিচয় যা-ই হোক না কেন—প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলগুলো কিন্তু তাঁদের সানন্দেই গ্রহণ করেছে। বিরোধী দল বিএনপিও বলেছে, তারা সরাসরি এই ইসির ওপর অনাস্থা আনতে চায় না। কমিশন আয়োজিত জাতীয় সংলাপেও সব দল অংশ নিয়েছে।

খুলনার আগে বর্তমান কমিশনের অধীনে যেসব নির্বাচন হয়েছে, তার মধ্য কুমিল্লা ও রংপুর সিটি নির্বাচন ছিল উল্লেখযোগ্য। দুটোতেই তারা উতরে গেছে। কিন্তু খুলনায় এসেই মনে হলো ইসি হাত-পা ছেড়ে দিয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে কোনো নির্বাচনে কোনো কেন্দ্রে ৯৯ শতাংশ ভোট পড়েনি। খুলনায় পড়েছে। আবার অনেক ভোটার কেন্দ্রে গিয়ে দেখেছেন তাঁদের ভোট দেওয়া হয়ে গেছে। ইসির দাবি, মাত্র তিনটি কেন্দ্রে অনিয়ম হয়েছে এবং সেখানে তারা ভোট গ্রহণ স্থগিত করে দিয়েছে। কিন্তু এ সিদ্ধান্ত নির্বাচনের ভোটের সার্বিক পরিবেশ সুরক্ষা করতে পারেনি। এর আগে ঢাকা উত্তরের উপনির্বাচন ও গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন স্থগিত হওয়ার ঘটনায় অনেকেই মনে করছেন, ইসি নয়, সরকার চাইলে নির্বাচন হয়। না চাইলে হয় না। একসময় স্থানীয় নির্বাচনের কর্তৃত্বও কমিশনের হাতে ছিল। আওয়ামী লীগ-বিএনপি মিলেই সেটি সরকারের হাতে নিয়ে নেয়। প্রথমবার ক্ষমতায় এসে বিএনপি তো পুরো মেয়াদে উপজেলা নির্বাচন আটকে রেখেছিল।

আগামী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য ইসি একটি পথ-নকশা দিয়েছে। কিন্তু নির্বাচন পরিচালনার ক্ষেত্রে যেসব অসংগতি, অনিয়ম ও দুর্বলতা আছে, সেগুলো দূর করতে না পারলে তাদের পক্ষে কোনো নির্বাচনই সুষ্ঠু করা সম্ভব হবে না। ইসি সর্বশেষ বিতর্ক সৃষ্টি করেছে স্থানীয় সরকার সংস্থার নির্বাচনে সাংসদদের প্রচারের সুযোগ দিয়ে। যদিও সেটি এখনো কার্যকর হয়নি। কমিশন বলেছে, গাজীপুর নয়, বাকি তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কার্যকর হবে। তবে এখানেও ইসির স্ববিরোধিতা স্পষ্ট। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী স্থানীয় সাংসদ নির্বাচনী প্রচারে অংশ নিতে পারবেন না। বাইরের সাংসদেরা পারবেন।

পরিবহন খাতে নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে সিইসি নুরুল হুদা মাঠে নেমেছেন, সেটি খুব ভালো কাজ বলে মনে করি। তবে সেই সঙ্গে নির্বাচনের ক্ষেত্রে যেসব অনিয়ম, ত্রুটি-বিচ্যুতি ও নৈরাজ্য আছে, সেগুলো দূর করার জন্য তাঁর এবং তাঁর সহকর্মী কমিশনারদের মনোযোগ আকর্ষণ করছি। কারও প্রতি রাগ বা অনুরাগের বশবর্তী না হয়ে তাঁরা জাতিকে একটি সুষ্ঠু ও সুস্থ নির্বাচন দেবেন, সেটাই দেশবাসীর প্রত্যাশা এবং তাঁরা সংবিধানের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধও।