সব পথে কাঁটা, সব দরজা বন্ধ

যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতি দেশের স্থানীয় সরকার, প্রাদেশিক আইন পরিষদ ও পার্লামেন্টে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূতদের নির্বাচিত হওয়ার সংবাদ মাঝেমধ্যে আমাদের পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ওই খবর প্রকাশের অর্থ বা তাৎপর্য আমার কাছে পরিষ্কার নয়। কোন দেশে কে নির্বাচিত হলেন তাতে আমাদের কী? তবে এটুকু বুঝি যে বিদেশে কোনো বাঙালির সাফল্যে গৌরবান্বিত হওয়া স্বজাতিপ্রীতির প্রকাশ। সম্ভবত আরও একটি কারণ কাজ করে। তা হলো, এই বার্তা দেওয়া যে উন্নত দেশে, যেখানে নির্ভেজাল গণতন্ত্র কার্যকর, বাঙালির সন্তান যে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হচ্ছেন, সেই যোগ্যতা অর্জন যেমন-তেমন ব্যাপার নয়। তাতে প্রমাণিত হয় বাঙালির যোগ্যতার অভাব নেই।

আমি ওই সব সংবাদের মধ্যে আরও একটি বিষয় দেখতে পেয়েছি। পাশ্চাত্য দেশে সাম্প্রতিক সময়ে যেসব বাঙালি নির্বাচিত হয়েছেন, তাঁরা সবাই তরুণ। ওই সব দেশে নিশ্চয়ই আমাদের দেশের রাজনীতিকদের মতো অনেক বয়স্ক মানুষ আছেন, যাঁরা বহুদিন যাবৎ রাজনীতি করছেন, তাঁদের জনগণ বেছে না নিয়ে তরুণ-তরুণীদের নির্বাচিত করছেন। কিন্তু সবচেয়ে বড় তাৎপর্যের বিষয়, যেসব বাঙালি তরুণ-তরুণী নির্বাচনে জয়লাভ করছেন, তাঁরা কোনো ধনীর আদরের দুলাল-দুলালি নন। তাঁরা নিম্ন ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। তাঁদের অনেকের বাবা ছিলেন কলকারখানার শ্রমিক, হোটেল-রেস্তোরাঁর নিচের দিকের কর্মচারী কিংবা পরিবহনশ্রমিক-বাসচালক বা কন্ডাক্টর। নির্বাচনের প্রার্থী হিসেবে তাঁদের কোনো পারিবারিক পরিচয় নেই। গত কয়েক বছরে ইউরোপ-আমেরিকায় যেসব বাঙালি বংশোদ্ভূত নেতা নির্বাচিত হয়েছেন তাঁদের কারও মা-বাবা, দাদা-দাদি সেখানকার বিখ্যাত নেতা ছিলেন না। একজনের কথাও শুনিনি যিনি কোনো বিপুল বিত্তবান অথবা অভিজাত পরিবারের সন্তান।

তাঁদের ওই সাফল্যের পেছনে শুধু কি শিক্ষাগত অথবা অন্যান্য যোগ্যতাই কাজ করেছে? তা মনে করার কোনো কারণই নেই। উচ্চশিক্ষিত ও যোগ্য মানুষ ওসব দেশে প্রচুরই রয়েছেন। তাহলে তাঁদের সাফল্যের পেছনে মূল কারণ কী? মূল কারণ ওই সব দেশের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি। সেখানে গণতন্ত্রের পথে কাঁটা বিছানো নেই, সেখানে যোগ্য অথচ বিত্তহীনের জন্য এবং তরুণ-তরুণীদের জন্য কোনো দরজাই বন্ধ নয়।

আমরা একটা গদ আওড়াই: যুবসমাজই জাতির ভবিষ্যৎ। এটা মিথ্যা সান্ত্বনার কথা। প্রতিটি প্রজন্মের তরুণদের যদি আমরা একই কথা বলে ভবিষ্যতের জন্য সরিয়ে রাখি, তাহলে বর্তমান থাকবে কাদের হাতে? বুড়ো-বুড়িদের? সে তো পরকালে বেহেশতে বা স্বর্গে যাওয়ার মতো। যে হতভাগ্য ইহজগতে কিছুই পেল না, তাকে বলা হলো তুমি পরকালে বেহেশতে যাবে। আজ বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় তরুণদের পথগুলো বন্ধ করে দিয়ে আমরা বলছি, তোমরাই জাতির ভবিষ্যৎ। বাজে কথা। স্রেফ প্রতারণা।

আমরা যখন সগৌরবে আমাদের বাঙালিদের বহির্বিশ্বে সাফল্যের সংবাদ করছি তখন সেসব দেশের পত্রপত্রিকা বাংলাদেশের রাজনীতি ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সম্পর্কে ভিন্ন কথা লিখছে। তারা বড় বড় প্রতিবেদনে বলছে, বাংলাদেশের রাজনীতি দুই পরিবার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এই দুই পরিবারের দুই নেতা অতীতে বাংলাদেশ শাসন করেছেন। বর্তমানে তাঁদের উত্তরাধিকারীরা রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছেন। ২৭ বছর যাবৎ পালাক্রমে তাঁদের একজন ক্ষমতায় থাকছেন, আর একজন থাকছেন বিরোধী দলে। তাঁদের বাইরে তৃতীয় ধারার কোনো রাজনৈতিক শক্তির উত্থান ঘটতে পারেনি।

বিদেশি কাগজগুলোর সাংবাদিক ভাষ্যকারেরা একটি ভুল করছেন। বর্তমান রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে বাংলাদেশে দুই পরিবার নয়, বহু রাজনৈতিক পরিবারের সৃষ্টি হয়েছে। যাকে বলা যায় খুব নিম্নমানের সামন্ততান্ত্রিক প্রথা। গত ২৭ বছরে একটি প্রবণতা লক্ষ করা গেছে। দুটি বড় দলের কোনো সাংসদের মৃত্যুর পর তাঁর বিধবা স্ত্রী অথবা পুত্র-কন্যাদের উপনির্বাচনে প্রার্থী করা হচ্ছে, তাঁরা সরকারি দলের হলে তাঁদের বিজয় অবধারিত। এটাকে ক্ষমতার রাজনীতিতে মোগল আমলের মৌরুসিপাট্টা বললে কম বলা হয়। নেতা মারা গেছেন, তাঁর আসনটি তাঁর বউ, ছেলে বা মেয়ে কোন অধিকারে দাবি করেন? ওই এলাকায় কি আর কোনো যোগ্য নেতা নেই? কোনো নাগরিকের পথ বন্ধ করা গণতন্ত্র নয়।

ভেবে দেখেছি, বর্তমান রাজনৈতিক ব্যবস্থায়, যে সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য আমরা হাহাকার করছি, ফেরেশতাতুল্য কোনো নির্বাচন কমিশনের দ্বারা যদি তা হয়ও, তাহলেই কি জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে? সামন্তবাদী প্রথায় ওপর থেকে জনগণের ওপর প্রার্থী চাপিয়ে দেওয়া হয়। তারপর ‘সিল মারো ভাই সিল মারো-অমুক মার্কায় সিল মারো’। তা ছাড়া, ভোটার বুঝে নির্বাচনী প্রচারণার সময় কোথাও জায়নামাজ, টুপি, কোথাও মশারি-লুঙ্গি-শাড়ি বা নগদ টাকা বিতরণ। যদি সুষ্ঠু নির্বাচন হয় তাহলে কেন্দ্র থেকে চাপিয়ে দেওয়া এক প্রার্থীকে বেছে নিতে হয়। তাঁর দ্বারা জনগণের কী উপকার হবে, তা কেউ জানে না।

কোনো জনপদে যখন ঝাঁকে ঝাঁকে মোটরসাইকেল প্রবেশ করে তখন ভোটারদের অন্তরাত্মা খাঁচাছাড়া হয়ে যায়। ত্রাসে শুধু ভোটাররা নন, কাঁপতে থাকে এলাকা। এক কামারের ইচ্ছা ছিল নতুন শাড়ি পরিয়ে বউকে নিয়ে নির্বাচনের দিন ভোটকেন্দ্রে যাবেন। এক মোটরসাইকেল আরোহী সিগারেটে কষে টান দিয়ে তার হাপরের কাছে পা ঠুকে বলে গেল, ‘কষ্ট কইরা ভোটকেন্দ্রে যাইয়েন না, আপনের বাড়ির সব ভোট আমরাই দিয়া দিমু।’ কামারের বউ নতুন শাড়িটি পরার একটা উপলক্ষ পেয়েছিল, তা ভেস্তে গেল।

গত ৪৫ বছরে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে বিভিন্নভাবে কলুষিত করা হয়েছে। এক. জাল ভোট, দুই. নির্বাচনের আগের দিন খাসি-মুরগির সদ্ব্যবহার করে রাত জেগে ব্যালট পেপার বাক্সে ঢোকানো, তিন. প্রশাসনকে দলীয় স্বার্থে ব্যবহার এবং চার. বর্তমানে দাস্য প্রবৃত্তিসম্পন্ন নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের দিয়ে সার্টিফিকেট জোগাড়। পশ্চিমা দেশে এগুলোর একটিও নেই বলেই সাধারণ পরিবারের বিদেশি বংশোদ্ভূত যুবক-যুবতীরা অনায়াসে নির্বাচনে জয়লাভ করতে পারেন।

যেখানে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি কলুষিত সেখানে সুষ্ঠু নির্বাচনই কী আর অসুষ্ঠু নির্বাচনই-বা কী? কারচুপির নির্বাচনই কী আর নিরপেক্ষ নির্বাচনই-বা কী? এলাকার যে জনদরদি যুবক সাইকেল বা মোটরসাইকেল চালান তাঁর দাম পাজেরো, বিএমডব্লিউ বা মার্সিডিজ বেঞ্জ হাঁকানো ধনকুবেরের কাছে দুপয়সাও নয়। দীর্ঘদিনের সূক্ষ্ম ব্যবস্থাপনায় ব্যবস্থাটিতে মানুষ অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। সেখান থেকে বের হওয়া এখন অতি দুরূহ। বৃদ্ধেরা এই ব্যবস্থাকে নানা প্রক্রিয়ায় টিকিয়ে রাখতে চাইবেন, তা থেকে বের করে আনতে পারেন তেজস্বী তরুণেরাই।

কৃষিপ্রধান দেশে স্থানীয় সরকারেই হোক বা জাতীয় সংসদেই হোক, কৃষকশ্রেণির প্রতিনিধিই অধিকাংশ থাকা স্বাভাবিক। তেমন এমপিকেই তিনবার সালাম জানাব, যাঁর বাবা মাঠে কাদার মধ্যে কাজ করেন। সেই এমপিরই মর্যাদা বেশি, যাঁর বাবা কলকারখানায় শ্রমিকের কাজ করতেন বা এখনো করেন এবং বাস করেন শ্রমিক বস্তিতে। এই জন্য তাঁদের সালাম জানাব কারণ তাঁরা মানুষের অভাব ও বেদনা অনুভব করতে পারবেন। সাংসদ-মন্ত্রীদের স্ত্রী বা ছেলেমেয়েদের সাংসদ নির্বাচিত হওয়াই বড় নিকৃষ্ট সামন্তবাদী প্রথা। তবে ক্ষেত্রবিশেষে যোগ্য হতেই পারেন।

নষ্ট গণতন্ত্রের চেয়ে দাস্য মনোবৃত্তিসম্পন্ন বা এমবেডেড মিডিয়া বেশি ক্ষতিকর। আমাদের অনেক পত্রিকায় সারা বছর বিভিন্ন এলাকার সম্ভাব্য প্রার্থীদের ছবিসহ ব্যাপক প্রচার দেওয়া হয়। তাঁদের অনেকে জঘন্য অপরাধী, অসৎ এবং নষ্ট মানুষ; কিন্তু তারা প্রভাবশালী। দেশে উচ্চশিক্ষার প্রসার ঘটেছে। বিভিন্ন এলাকায় অত্যন্ত যোগ্য তরুণ-তরুণী রয়েছেন। তাঁরা কোনো আনুকূল্য পাচ্ছেন না। তাঁদের অগ্রযাত্রার পথে শুধু কাঁটা, তাঁদের সব দরজা বন্ধ।

পথের কাঁটা সরাতে চাই অদম্য মনোবল, অপার ধৈর্য এবং অপরিমেয় ত্যাগ: দরজার বন্ধ অর্গল খুলতে চাই বিপুল শক্তি। সে শক্তি বাংলাদেশের চার কোটি তরুণ-তরুণীর কারও মধ্যেই নেই—আমি বিশ্বাস করি না। তাঁদের আবাহন করি। তাঁদের আবির্ভাবের আশায় রইলাম।

সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক