জনতুষ্টির হাত ধরে ইমরানের উত্থান

ইমরান খান । ফাইল ছবি
ইমরান খান । ফাইল ছবি

পাকিস্তানে নির্বাচনের মৌসুম শুরু হয়ে গেছে। এখন রাজপথে ধুলো উড়িয়ে স্লোগান দিয়ে মিছিল হবে, স্টেডিয়ামগুলোতে বিরাট বিরাট জনসভা হবে, নোংরা ছলচাতুরী হবে, হাতাহাতি-মারামারি হবে, প্রার্থী আর ভোটাররা কাপের পর কাপ চা সাবাড় করবেন।

এবারের নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় আছেন কিংবদন্তি ক্রিকেটার থেকে রাজনীতিক হয়ে ওঠা ইমরান খান। ৬৫ বছরে পড়া ইমরান খান দুই দশক ধরে ‘রাজনীতির স্টাম্প’ ধরাশায়ী করার জন্য ‘বল করে’ যাচ্ছেন। রাজনীতির জন্য এটি বেশ দীর্ঘ সময়। রাজনীতিতে নাম লেখানোর পর ১৯৯৮ সালে ইমরান যখন তাঁর নিজ শহর লাহোরে প্রথম জনসভা করেন, সেই সভায় আমি তাঁর এতটাই কাছে ছিলাম যে তাঁর ঘাড়ের পেছন থেকে তাঁর লিখিত ভাষণ পড়তে পারছিলাম। সেই পৃষ্ঠার প্রথম লাইন ছিল, ‘পাকিস্তানকে বিশ্বাস করুন’। ওই সময় ইমরানের সম্ভাবনার ওপর আমার তেমন একটা আস্থা ছিল না এবং আমার করা প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল, ‘না, খান পারবেন না’।

সেই ইমরান খান এখন বিশ্বের সবচেয়ে সমস্যাসংকুল, স্থিতিস্থাপক ও ভূরাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ দেশ পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পথে। এটা যে কী করে সম্ভব, তার উত্তরের মধ্যেই আমাদের সবার জন্য শিক্ষা নিহিত রয়ে গেছে। বছরের পর বছর ইমরান খান বিশেষত নেতিবাচক খবরের জের ধরে পশ্চিমা গণমাধ্যমের কভারেজ পেয়ে আসছেন।

তাঁর অসামান্য খেলার দক্ষতা, প্লেবয় খ্যাতি, জেমিমা গোল্ডস্মিথের মতো ব্রিটিশ ধনকুবের তনয়াকে বিয়ে করা, তালাক দেওয়া, অন্য নারীকে বিয়ে করে আবার তালাক দেওয়া—এসব মুখরোচক খবর নিয়ে পশ্চিমা ট্যাবলয়েড বহু মাতামাতি করেছে। তাঁর মধ্য বয়সে ধর্মকর্মের প্রতি ঝুঁকে পড়া, আগের চেয়ে অনেক বেশি রক্ষণশীল হয়ে পড়া এবং রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষী হয়ে ওঠা আরও গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয় হতে পারে। কিন্তু আমি এবং আমার মতো অনেকেই বহুদিন ধরে যেটি ধরতে পারিনি, সেটি হলো ইমরান খান সব সময়ই তাঁর সময় থেকে এগিয়ে থেকেছেন। পিছিয়ে থাকেননি।

এখন এটি স্বতঃসিদ্ধ সত্য যে আমরা এমন এক বিশ্বে বসবাস করছি যেখানে জনতুষ্টিবাদী এবং জাতীয়তাবাদীদের সামনে উদারপন্থী, প্রগতিশীল ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা হাঁটু মুড়ে বসে আছে। গণভোটে ব্রেক্সিট পাস, আমেরিকায় ট্রাম্পের জয় এবং ফ্রান্সে মারিন লো পেন, হাঙ্গেরিতে ভিক্তর ওরব্ ও ইতালিতে বেপ্পে গ্রিলোর সাফল্য ইউরোপের সবাইকে ঝাঁকুনি দিয়েছে। পোল্যান্ডের মতো দেশে সেক্যুলাররা ডানপন্থীদের সামনে এখন কুলিয়ে উঠতে পারছেন না।

এটিও একটি স্বতঃসিদ্ধ বাস্তবতা যে এই পরিবর্তনটি আমাদের অনেকের কাছে একেবারে আচমকা ধরা দিয়েছে। নাগরিক এলিটরা, বিশেষ করে সুশীল রাজনীতিকেরা এবং নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ও মিডিয়া ব্যক্তিত্বরাও কী দ্রুত সমাজের মূল স্রোত বদলে যাচ্ছে যে তা ধরতে পারেননি। সাধারণ মানুষের মনস্তত্ত্ব ধরতে তাঁরা একেবারেই ব্যর্থ হয়েছেন।

আমরা এটি বুঝতে ব্যর্থ হয়েছি যে জনতুষ্টিবাদ ও জাতীয়তাবাদকে ধারণ করে বহু বছর ধরে একটু একটু করে উদারপন্থাকে ধরাশায়ী করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ইমরান খান উৎকৃষ্ট উদাহরণ। তাঁর রাজনৈতিক জীবনের পুরোটা সময় তিনি তাঁর বাগাড়ম্বর ধরে রেখেছেন। নাইন-ইলেভেনের আগে একটি সাক্ষাৎকারে ইমরান খান প্রতিবেশী দেশ আফগানিস্তানে ‘শান্তি আনার জন্য’ তালেবানের প্রশংসা করেছিলেন। গত নির্বাচনের আগে আমি তাঁর একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। সেখানে তিনি তাঁর দেশে ‘বিদেশি দখলদারির’ অভিযোগ তুলেছিলেন।

ইমরান কখনোই পাকিস্তানের ‘লিবারেল এলিটদের’ সমালোচনা করতে ছাড়েননি। ২০১০ সালে প্রকাশিত নিজের বইয়ে ইমরান বলেছেন, পাকিস্তানের সবচেয়ে বেশি সুবিধাভোগী গোষ্ঠী সবচেয়ে বেশি পশ্চিমা জীবনযাপনে ঝুঁকছে। ওই বইয়ের এক জায়গায় তিনি লিখেছেন, ‘আজকের লাহোরে ধনী নারীরা পশ্চিমা পোশাক–আশাক পরে পুরুষদের সঙ্গে পশ্চিমা কায়দায় বিভিন্ন পার্টিতে যাচ্ছে। এই সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ পাকিস্তানের সংস্কৃতি থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।’

পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদে মার্কিন মেরিনদের হাতে ওসামা বিন লাদেন নিহত হওয়ার পর ইমরান বলেছিলেন, ‘পাকিস্তানের মাটিতে আমেরিকার এই অভিযান আমাদের সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় নিরাপত্তার ওপর হুমকি।’ এসব জনতুষ্টিবাদী বক্তব্য সাধারণ মানুষ সহজেই গ্রহণ করে। লিবারেল এলিটরা তাদের সেই ভাষা পড়তে ব্যর্থ হয়েছে।

১৯৯৪ সালে রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান ইস্তাম্বুলের মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই তুরস্কে ইসলামপন্থীরা সংহত হতে শুরু করে। এরদোয়ান প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর খুব সাবধানে উদারপন্থীদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগোচ্ছিলেন। এখন ৯ বছরের মাথায় তিনি তাঁর আদর্শিক জায়গা অনেকটাই পাকা করে ফেলেছেন।

আরব বসন্তের সময় মধ্যপ্রাচ্যে সেক্যুলার, গণতন্ত্রপন্থী, প্রগতিশীল ও বৈশ্বিকতাবাদীদের আচমকা উত্থানে ইউরোপীয় বিশ্লেষকেরা আপ্লুত হয়েছিলেন। কিন্তু তলেতলে সেখানে যে রক্ষণশীলদেরও উত্থান হচ্ছে, তা তাঁরা বুঝতেই পারেননি। ভারতে হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের উত্থান শুরু হয় ১৯৮০ দশকের শেষ দিকে এসে। এরপর ২০১৪ সালে এসে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে তারা চূড়ান্ত বিজয় দেখতে পায়।

মোদিকে বলা হয় জনতুষ্টিবাদী রাজনীতির গুরু। মনে হচ্ছে তাঁর কাছ থেকেই ইমরান খান দীক্ষা নিয়েছেন। তিনি এখন মহানগরের এলিট শ্রেণির বিরুদ্ধে বিষোদ্‌গার শুরু করেছেন। যে কোটি কোটি ভোটার বছরের পর বছর বঞ্চিত ও প্রতারিত বোধ করে এসেছে, তারা এই সমালোচনাকে সাদরে গ্রহণ করছে। মোদির মতোই তিনি জনগণকে আরও ভালো জীবনমানের আশ্বাস দিচ্ছেন এবং পাকিস্তানের মূল্যবোধের প্রচারে ভূমিকা রাখার কথা বলছেন। মূলত এর মধ্য দিয়ে ইমরান খান ভোটার টানতে লোকরঞ্জনবাদী পথই বেছে নিয়েছেন। এই কাজটি তিনি শুরু করেছেন বহু আগে থেকে। আর এলিট বুদ্ধিজীবীরা তা ধরতেই পারেননি।

দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনূদিত

জেসন বার্ক দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকার আফ্রিকা প্রতিনিধি