ভারতীয় রাজনীতিতে নতুন মাত্রা?

এসপির কর্মীদের বিজয়োল্লাস
এসপির কর্মীদের বিজয়োল্লাস

উত্তর প্রদেশে কৈরানা লোকসভা ও নুরপুর বিধানসভা নির্বাচনে বিরোধী দলগুলোর জোট সমর্থিত প্রার্থীর কাছে হেরেছেন সরকারি দল সমর্থক প্রার্থীরা। লোকসভা আসনে নবনির্বাচিত সাংসদ একজন মুসলমান মহিলা। রাজ্যের ৮০টি আসনের মধ্যে শুধু ১ জন মুসলমান সাংসদ। আগে এ দুটো আসনই ক্ষমতাসীন বিজেপির হাতে ছিল। ঠিক তেমনি অল্প কিছুদিন আগে সে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ও উপমুখ্যমন্ত্রীর ছেড়ে দেওয়া দুটি লোকসভা আসন গোরক্ষপুর ও ফুলপুরও চলে যায় বিরোধীদের হাতে।

কথা হতে পারে, ৫৪৫ জন লোকসভা সদস্যের ৩ জন বিরোধীদের দিকে গেলে কী যায় আসে? অন্যদিকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কাছে এ ফলাফল তাৎপর্যপূর্ণ। ওই প্রদেশের মতো জনবহুল রাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যে ক্ষমতাসীন বিজেপি সম্প্রতি একের পর এক হেরে যাচ্ছে। জয়ের সুফল যাচ্ছে সমাজবাদী পার্টি (এসপি), বহুজন সমাজ পার্টি (বিএসপি), কংগ্রেস, রাষ্ট্রীয় লোকদল (আরএলডি)—এসব দলের সমন্বয়ে গঠিত জোটের দিকে। অল্প কিছুদিন আগেও দক্ষিণ ভারতীয় রাজ্য কর্ণাটকে বিজেপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েও কংগ্রেস ও জনতা দলের (এস) সমন্বয়ে জোটের কাছে ক্ষমতা হারায়। দেখা যাচ্ছে, গেরুয়া রংধারী বিজেপি বেশ কিছু স্থানে সম্মিলিত বিরোধিতার মুখোমুখি হয়ে পিছু হটতে শুরু করেছে।

বছরখানেকের মধ্যেই ভারতে লোকসভা নির্বাচন। নতুন মেরুকরণে অনেকটাই সামনে চলে আসছে বিরোধী জোট। এটা অধিকতর স্পষ্ট উত্তর প্রদেশে। উল্লেখ্য, এ রাজ্যের জনসংখ্যার ২০ শতাংশ মুসলমান। দলিত ও অন্যান্য পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠী যথাক্রমে ২১ ও ৪০ শতাংশ। সাধারণত এসপি ও বিএসপি এদের প্রতিনিধিত্ব করছিল। কংগ্রেস ও সবার সমন্বয়ে। তবে বিগত লোকসভা নির্বাচনে সবাইকে তাক লাগিয়ে বিজেপি রাজ্যের ৮০টি আসনের ৭৩টি জয় করে নেয়। গোঁড়া হিন্দুত্ববাদী বলে তাদের পরিচিতি থাকলেও তখন সব সম্প্রদায়ের ভোট পেতে সক্ষম হয়েছিল দলটি। তবে হালের উপনির্বাচনগুলো এবং ভারতীয় রাজনীতির এদিক-সেদিক দেখে মনে হচ্ছে, সেখানে নতুন মাত্রা চলে আসছে।

ভারতের রাজনীতিতে উত্তর প্রদেশের অগ্রণী ভূমিকা সবার জানা। হিন্দুদের দুটি ধর্মগ্রন্থ রামায়ণ ও মহাভারতের কাহিনি অনেকটা এ অঞ্চলকে কেন্দ্র করে। আর তা মূলত রাজনৈতিক। রামায়ণের কোশল রাজ্যের রাজধানী অযোধ্যা উত্তর প্রদেশেই। এ স্থানে একটি মসজিদকে কেন্দ্র করে দুই সম্প্রদায়ের দীর্ঘকালীন বিরোধ রাজনীতির গতি-প্রকৃতিকে প্রভাবিত করেছে। মহাভারতের কাহিনি মূলত হাল আমলের উত্তর প্রদেশের অঞ্চলগুলো নিয়ে। খাইবার গিরিপথ দিয়ে ভারতে যারাই এসেছে, তাদের দক্ষিণ ভারত বা গাঙ্গেয় বদ্বীপে নিজেদের সীমা বিস্তার করতে উত্তর প্রদেশ অঞ্চলকেই আগে নিয়ন্ত্রণে নিতে হয়েছে। বিজেতার শাসনের ছাপের পাশাপাশি এ অঞ্চল অনেক সংস্কৃতি ধারণ করে সমৃদ্ধ হয়েছে। মোগল আমলের শ্রেষ্ঠতম স্থাপনা তাজমহল সমুজ্জ্বল হয়ে আছে উত্তর প্রদেশের আগ্রায়। ব্রিটিশরা এ দেশে এসেছিল জলপথে। তাই সূচনায় এখানে না এলেও পরবর্তী সময়ে তাদের দিল্লিকে রাজধানী করতে হয়েছে। ১৮৫৭ সালে তারা প্রথম ভারতীয় স্বাধীনতাযুদ্ধের মোকাবিলা করে এ অঞ্চলেই। এতে অনেকের মধ্যে নেতৃত্ব দেন এ অঞ্চলেরই মঙ্গল পাণ্ডে। ভারতের স্বাধীনতাসংগ্রামে মতিলাল ও জওহরলাল নেহরু নেতৃত্ব সর্বভারতীয় স্তরে ছড়িয়ে পড়েছে। তাঁরাও উত্তর প্রদেশের। এ রাজ্য স্বাধীন ভারতকে জওহরলাল নেহরুসহ ৭ জন প্রধানমন্ত্রী উপহার দিয়েছে।

১৯৭৭ সালে ভারতে গণতন্ত্রের চেতনা যখন বিপরীত দিকে যাচ্ছিল, তখন উত্তর প্রদেশের বালিয়ার জয়প্রকাশ নারায়ণ ভারতব্যাপী আন্দোলন গড়ে তুলে তা আবার সঠিক পথে ফেরাতে সফল হন। ৯৪ হাজার বর্গমাইলের এ রাজ্যে ২২ কোটি লোকের বাস। রাজনীতির গতিপথও বিচিত্র। স্বাধীনতার পর থেকে ১০ বার রাষ্ট্রপতির শাসনে থেকেছে ১ হাজার ৭০০ দিন। স্বাধীন রাষ্ট্র হলে জনসংখ্যায় হতো পৃথিবীতে পঞ্চম বৃহত্তম এবং আয়তনে ব্রিটেনের সমান। কাশী, মথুরাসহ হিন্দুদের বহু পবিত্র স্থান আছে এ রাজ্যে। আছে বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়। ব্রিটিশ ভারতে মুসলমানদের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে এ রাজ্যেই প্রতিষ্ঠিত হয় সব আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়। মুসলমানদের ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে উপমহাদেশে অনেকটা অপ্রতিদ্বন্দ্বী রয়েছে দেওবন্দের দারুল উলুম মাদ্রাসা।

উত্তর প্রদেশের এই মেরুকরণ স্থায়ী রূপ পাবে কি না? প্রদেশের সর্বত্র একই চিত্র না-ও হতে পারে। এ বিষয়ে জোর দিয়ে কিছু বলার সময় এখনো আসেনি। সর্বভারতীয় রাজনীতিতে বিজেপিবিরোধী কোনো কার্যকর জোট হবে কি না, তা নির্ভর করবে অনেকগুলো আঞ্চলিক দলের স্থানীয় স্বার্থসহ বিভিন্ন ইস্যুতে। তবে জোটের নেতৃত্বে কে থাকবেন, তার ইঙ্গিত এখনই পাওয়া যাচ্ছে। কংগ্রেস সর্বভারতীয় দল হলেও সাংগঠনিক ক্ষমতা ও জনপ্রিয়তায় পিছিয়ে পড়েছে। তাদের একক কর্তৃত্ব আছে এমন রাজ্যের সংখ্যা খুব কম। বিপরীতে বিজেপি সর্বভারতীয় রূপে নিজেদের প্রসার ঘটাতে সক্ষম হয়েছে। তবে হালের চ্যালেঞ্জও বড় ধরনের।

উত্তর প্রদেশে যে মেরুকরণ শুরু, তার হাওয়া ভারতের অন্যত্র বইতে শুরু করেছে। এমনটা চললে পরবর্তী লোকসভা নির্বাচনে জয়লাভ তাদের জন্য মসৃণ হবে না। বরং ক্ষমতার পালাবদল হতে পারে। ভারতীয় রাজনীতির পালাবদলে বড় ভূমিকা পালনকারী উত্তর প্রদেশের কয়েকটি দল শক্ত জোটই গড়ে তুলেছে। এ জোটের মূল শক্তি অখিলেশ যাদবের এসপি এবং মায়াবতীর বিএসপি। দুটি দলই মূলত পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠী সমর্থিত। উত্তর প্রদেশের শাসনক্ষমতায় ছিল একাধিকবার। এর আগের রাজ্য সরকারেও ছিল অখিলেশ যাদবের নেতৃত্বে এসপি। কিন্তু তাঁর শাসনকালে বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা লক্ষ করা গেছে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা দমনে ঈপ্সিত ভূমিকা রাখতে পারেনি। বরং তিনি তাঁর বাবা, দলটির প্রতিষ্ঠাতা মুলায়ম সিং যাদবকে বঞ্চিত করেন দলের নেতৃত্ব থেকে। এটা উত্তর প্রদেশের আগ্রার দুর্গে ছেলের হাতে বন্দী শাহজাহানের অনেকটা আধুনিক সংস্করণ মনে হয়েছে। তেমনি মায়াবতীও শাসনক্ষমতায় গিয়ে ব্যক্তিগত ভাবমূর্তি গড়ার দিকে নজর দিয়েছেন। তবু এ দুটি দলের বিশাল সমর্থক গোষ্ঠী ও কর্মী আছেন। এককালের ডাকসাইটে নেতা চরণ সিংয়ের আরএলডির প্রভাব ক্ষীয়মাণ হলেও কিছুটা আছে। কংগ্রেস আনন্দ ভবন আর স্বরাজ ভবনের আঙিনা পেরিয়ে নিজদের ছড়িয়ে দিয়েছিল আসমুদ্র হিমাচল, কিন্তু এখন ক্ষয়ে গেছে। তবে তাদেরও বেশ রাজ্যটিতে অনেক কর্মী-সমর্থক আছেন। উত্তর প্রদেশের রাজনীতিতে অপরাধ জগতের একটি ছাপ রয়েছে দীর্ঘকাল। তেমনি রয়েছে অন্য রাজ্যেও। এ অবস্থায় গঠিত জোটটিকে ধরে রেখে সর্বভারতীয় স্তরে প্রসার ঘটাতে পারলে ভারতীয় রাজনীতিতে নতুন মাত্রা যুক্ত হওয়ার কথা। থেমে যাওয়ার কথা গেরুয়া রথের পথচলা।

এ রকম হলে বা না হলে আমাদের বাংলাদেশের কোনো লাভ-ক্ষতি হবে কি না? প্রতিবেশী দেশ হিসেবে আমরা ভারতীয় রাজনীতির গতি-প্রকৃতি সম্পর্কে উৎসুক। তবে কোনো পরিবর্তন আমাদের জন্য সুফল আনবে এমন ভাবার কারণ নেই। কেননা আমাদের বর্তমান মহাজোট সরকারের প্রথম মেয়াদেই ভারতকে একতরফা ব্যাপক ছাড় দিয়েছে। বিনিময়ে তিস্তার পানি কিংবা অন্য তেমন কিছু পায়নি। অথচ ভারতে পাঁচ বছর ক্ষমতায় ছিলেন কংগ্রেসের মনমোহন সিং। বরং নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় এসে ছিটমহল-সংক্রান্ত একটি মানবিক সমস্যার সমাধান করেছেন দৃঢ়তার সঙ্গে।

গণতন্ত্রের পথে আমরা খুঁড়িয়ে চললেও ভারতের দৃপ্ত পদযাত্রা আমাদের জন্য প্রেরণার উৎস। সেখানে রাজনীতির মেরুকরণ কী নিয়ে আসে, সেদিকে আমাদের স্বাভাবিক কৌতূহল থাকবে। প্রত্যাশা থাকবে ভারত আমাদের সমস্যাগুলো দেরিতে হলেও দূরদর্শিতার সঙ্গে বিবেচনায় নেবে। কিন্তু আমাদের নিজেদের অবস্থান জোরালো ভিতের ওপর দাঁড় করাতে না পারলে শূন্য হাতেই বগল বাজাতে হবে।

আলী ইমাম মজুমদার সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব