বিচারপতি ওবায়দুলের 'চিন্তা' মানা হলো?

যখনই দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বেড়ে যায়, তখনই বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও তার কার্যকারিতার বিষয়গুলো আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। কেননা, ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মানুষ মারার একটা কারণ হিসেবে বলা হয়, এই ব্যক্তিরা দুর্ধর্ষ। তারা নানা সময়ে গ্রেপ্তার হয়েছে। কিন্তু জামিনে বেরিয়ে গেছে। অবশ্য চলমান ভয়ংকর মাদকবিরোধী যুদ্ধে নিহত ১৩৩ জনের মধ্যে ঠিক কতজন জামিনে বেরিয়েছিলেন, তা আমরা জানি না। তবে সবকিছু ছাপিয়ে এ ক্ষেত্রে দেশের বিদ্যমান বিচারব্যবস্থার কার্যকারিতার বিষয়টিই আলোচনায় আসে। আর এর সঙ্গে ক্ষমতার পৃথক্‌করণ এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতাও প্রাসঙ্গিক। বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ধারণা বিমূর্ত থেকে যাবে, যদি না আমরা বিচারক বাছাই ও নিয়োগ–প্রক্রিয়ার দিকে চোখ বন্ধ করে রাখি।

কোনো ধরনের স্বচ্ছ রীতিনীতি অনুসরণ ছাড়াই (সরকারি ঘোষণার আগে জনগণ অন্ধকারে ছিল) হাইকোর্ট বিভাগে আবারও ১৮ জন অতিরিক্ত বিচারক নিয়োগ করা হলো। এতে কোনো বিস্ময় নেই। কিন্তু কিছুটা হলেও বিস্ময়কর যে বিএনপি-সমর্থিত সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি এ বিষয়ে একটি দায়সারা প্রেস ব্রিফিং করে চুপ করে আছে। তবে তারা নিয়োগ–প্রক্রিয়াকে অস্বচ্ছ গণ্য করে অসন্তোষ ব্যক্ত করেছে। আর লক্ষণীয়ভাবে তারা ২০১৭ সালে বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের দেওয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ রায়েরও উল্লেখ করেছে।

বিচারক নিয়োগ-সংক্রান্ত রায়ের সংখ্যা এখন আমাদের খুব নয়। সর্বশেষ এ বিষয়ে ব্যারিস্টার আজীমের জনস্বার্থে দায়ের করা এক রিটে গাইডলাইন না দিয়ে বিচারপতি ওবায়দুল হাসান তাঁর কিছু নতুন ‘থটস’ (চিন্তা) প্রকাশ করেছেন। তিনি এই চিন্তা প্রকাশ করতে গিয়ে ২০১০ সালে ১০ বিচারপতিসংক্রান্ত আপিল বিভাগের রায় নিশ্চয় বিবেচনায় নিয়েছেন। তার মানে, তাঁর চিন্তা এসেছে সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের আলোকে। সেই রায় পর্যবেক্ষণ বা চিন্তা ছিল না, সেটা নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগের জন্য বাধ্যতামূলক আইন বলে রায়ের মূল লেখক বিচারপতি এম এ মতিন অবসরে এসে নানাভাবে উল্লেখ করেছেন। অথচ সুপ্রিম কোর্ট বারসহ অন্য অনেক জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সেই আইনের পূর্ণ বাস্তবায়ন না চেয়ে নতুন করে বিচারক নিয়োগের একটি নীতিমালা চান। তবে আইনজীবী ও আইনবিদদের মধ্যে যাঁদের আমরা বিএনপির আমলে বাদ পড়া ১০ বিচারককে ২০১০ সালের ওই রায়ে পুনর্বহালে উদ্গ্রীব দেখেছি, তাঁদের অধিকাংশকে পরে আমরা বিচারক নিয়োগের ওই আইনের বিচ্যুতি ঘটতে দেখে উদ্বিগ্ন হতে দেখিনি।

এটা খুব বিস্ময়কর যে বিচারক নিয়োগ–সংক্রান্ত ২০১০ সালের মাইলফলক রায়টির কথা প্রাসঙ্গিকভাবেও মুখে আনা হয় না। বিচারক কী প্রক্রিয়ায় বাছাই হবে, কীভাবে কী করলে লোকে তাকে স্বচ্ছ বলবে, তা পরিষ্কার ও সুনির্দিষ্টভাবে তাতে বলা আছে। এটাও সত্য, বাছাই ও নিয়োগ–প্রক্রিয়া আরও বিস্তারিত ও সুনির্দিষ্ট করার সুযোগ আছে। কিন্তু ২০১০ সালে বেঁধে দেওয়া নির্দেশাবলির বিচ্যুতি বিষয়ে সামান্যতম কোনো উল্লেখ ওই মামলায় (ব্যারিস্টার আজীমের রিট) নিযুক্ত অ্যামিকাস কিউরিরা করলেন না। ভারতের সংবিধানে বিচারক নিয়োগে যা বলা, বাংলাদেশেও তা-ই বলা। অথচ ভারত রাষ্ট্রপতিকে (সরকারকে) বাদ দিয়ে প্রধান বিচারপতিকে অন্য বিচারপতিদের সঙ্গে বসে সমষ্টিগত সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্যকারী বিধান কলিজিয়াম উদ্ভাবন ও তা দুই দশকের বেশি সময় টিকিয়ে রাখতে পারছে। কিন্তু আমরা সেই পথে হাঁটার কোনো সংকল্প প্রকাশ করছি না।

বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের ২০১৭ সালে হাইকোর্টে দেওয়া রায়ে দেখি, রাষ্ট্র (অ্যাটর্নি জেনারেল) বলেছে, বিচারক নিয়োগে রাষ্ট্রপতির নিরঙ্কুশ বিশেষ ক্ষমতা (অ্যাবসলিউট প্রিরোগেটিভ) আছে। অন্য একজন অ্যামিকাস কিউরি রাষ্ট্রপতিকে ‘মতামত’ প্রদানে কার্যত প্রধান বিচারপতির ‘অ্যাবসলিউট প্রিরোগেটিভ’ থাকার অনুকূলেও তত্ত্ব দিয়েছেন। অথচ গণতান্ত্রিক বিশ্বে এখন যে যত বড় পদেই থাকুন, কোনো ধরনের নিরঙ্কুশ ক্ষমতা প্রয়োগের অধিকারের কোনো জায়গা নেই। বিচারক নিয়োগ, কিংবা ফাঁসির আসামির দণ্ড মওকুফ করা কিংবা বিচারবহির্ভূত পন্থায় কাউকে হত্যার নির্দেশ দিতে কারও অ্যাবসলিউট প্রিরোগেটিভ নেই। ১৯৫৫ সালে ভারতের বিচারপতি আনসারী লিখেছিলেন, ‘জনগণতন্ত্রী সংবিধানের সঙ্গে নিরঙ্কুশ সম্রাটের বিশেষ অধিকারের ধারণা অসামঞ্জস্যপূর্ণ।’ এর ৬০ বছর পর ২০১৫ সালে বিচারক নিয়োগের এক মামলাতেই ভারতের সুপ্রিম কোর্ট বিচারপতি নিয়োগে নির্বাহী বিভাগের ক্ষমতা থাকার যুক্তি একটি পুরোনো রায়ের বরাতে পুনরায় উড়িয়ে দিয়েছেন।

ভারতীয় ওই পুরোনো রায়টি হলো, ‘কেউ অস্বীকার করতে পারে না যে রাষ্ট্র এখন এক বৃহৎ মামলা দায়েরকারী এবং সুপ্রিম কোর্ট ক্রমেই এক ঝড়ঝঞ্ঝাপূর্ণ বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে; এর কিছু বিষয়ে রয়েছে রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়ার গন্ধ। আদালতকে ঝড় ও সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস মোকাবিলা করতে হবে, কারণ তাঁর অস্তিত্ব জাতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এ ধরনের একটি পরিস্থিতিতে বৃহৎ মামলা দায়েরকারীর হাতে কি ওই সব মামলার বিচারক নিয়োগের নিরঙ্কুশ ক্ষমতার দাবি মেনে নেওয়া চলে?’ ভারতের সুপ্রিম কোর্টের এই প্রশ্ন আমরা বাংলাদেশের অ্যাটর্নি জেনারেলের বর্ণিত বিশেষ অধিকার থাকার মত যে বা যাঁরাই সমর্থন করেন, তাঁদের কাছে রাখলাম। ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট যখন এই মন্তব্য করেছিলেন, তখন ভারতীয় স্বাধীনতার ৪৬ বছর পার হচ্ছিল। তাঁরা দেখেছেন, ভারত সরকার বিচারক নিয়োগে তাঁর হাত খাটো করতে এগিয়ে আসেনি। এরপর সুযোগ আসামাত্রই আদালত প্রধান বিচারপতি ও আরও কয়েকজন জ্যেষ্ঠ বিচারপতির সমন্বয়ে কলিজিয়াম গঠন করলেন। আমাদের যেসব আইনবিদ দশকের পর দশক ধরে সরকারের ক্ষমতা থাকার পক্ষে ওকালতি করে চলছেন, এসব রায় কি তাঁদের অগোচরে থেকে যাচ্ছে? ক্লায়েন্টদের মামলা জিততে তাঁরা তো শতকরা প্রায় ৮০ ভাগ ক্ষেত্রে ভারতীয় উদাহরণ চর্চা করেন। ভারতের বিচারপতিরা বলেছেন, ‘সরকারকে যদি বিচারপতি বাছাইয়ের ক্ষমতা ভোগ করতে দেওয়া হয়, তাহলে দীর্ঘ মেয়াদে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ডুবে যাবে, তখন তার হদিস পর্যন্ত মিলবে না।’

বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের সঙ্গে আমরা একমত যে মেধাবী ও সৎ বিচারক চাইলে হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগের বিচারকদের বেতন উপমহাদেশীয় বিচারকদের সমান হতে হবে। ভারত ও পাকিস্তানের বিচারকেরা আমাদের বিচারকদের চেয়ে সম্ভবত দু-তিন গুণ বেশি বেতন পান। কিন্তু উপমহাদেশের আর কোনো দেশে বাংলাদেশের মতো অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় তো বিচারক নিয়োগ হয় না।

অধস্তন আদালত থেকে ৬ জন, বার এবং অ্যাটর্নি জেনারেলের দপ্তর থেকে ১২ জন, সব মিলিয়ে নবনিযুক্ত এই ১৮ জনকে কী প্রক্রিয়ায় বাছাই করা হলো? বিচারপতি ওবায়দুল বর্ণিত একটি স্বচ্ছ বাছাই–প্রক্রিয়ার আওতায় ‘মেধাবী শিক্ষাজীবন, দক্ষ, আইনি প্রজ্ঞা এবং সততায় সুউচ্চ মানসম্পন্ন’ ১৮ জনকে বাছাই করতে বসে মোট কতজনের কী কী সামগ্রিক বৃত্তান্ত বিবেচনায় নেওয়া হয়েছিল, তার লিখিত রেকর্ড আদৌ সংরক্ষণ করা হয়েছে কি না, অন্তত সেটুকু তথ্য আমরা প্রকাশের দাবি জানাই। ইংল্যান্ডের মতো বিচারপতি হতে আগ্রহীরা আবেদন না করুন, বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নয়া চিন্তা মেনে ‘সম্পদ ও দেনার বিবরণসহ জীবনবৃত্তান্ত’ সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে জমা দেওয়ার বিধান সহজে চালু করা যেত এবং এখনই তা করা যায়। আমরা এই নির্দেশনাটির শতভাগ সমর্থক।

১০ বিচারকের মামলায় ২০১০ সালের রায়টিও আমরা পুরোপুরি মানতে পারিনি। কারণ, আপিল বিভাগ বলেছেন, প্রথম বাছাই তালিকাটি সরকার করবে। আমরা মনে করি, এটা বিচার বিভাগের স্বাধীনতা পরিপন্থী। কিন্তু তারপরও সেখানে যতটা দিকনির্দেশনা (যেমন বিচারক বাছাই–প্রক্রিয়া সরকার ও প্রধান বিচারপতির মধ্যে অংশগ্রহণমূলক হবে এবং যাচাই-বাছাইয়ের প্রতিটি স্তর লিখিত থাকবে এবং তার রেকর্ড সংরক্ষিত থাকবে) দেওয়া আছে, রায় প্রকাশের পর থেকেই তা অনুসরণ করা হচ্ছে না। এটা বড় দুঃখের কথা।

মিজানুর রহমান খান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক