ট্রাম্পের মিশন ভেস্তে দেবেন পুতিন!

ভ্লাদিমির পুতিন ও ডোনাল্ড ট্রাম্প
ভ্লাদিমির পুতিন ও ডোনাল্ড ট্রাম্প

রাশিয়ার কিছু গবেষণাকেন্দ্র রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়মিত তথ্য সরবরাহ করে এবং করণীয় নির্ধারণে সরকারকে পরামর্শ দিয়ে থাকে। সে রকমেরই একটি গবেষণাকেন্দ্র ২০১৭ সালের শেষের দিকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ ও ক্রেমলিনকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক পুনরুদ্ধার করার পরামর্শসহ একগুচ্ছ প্রস্তাব দিয়েছিল। একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র আমাকে এ কথা জানিয়েছে।

এই গুচ্ছ প্রস্তাবে রুশ সরকারকে ইউক্রেন সংলাপ জোরদার করা, সাইবার হামলা রোধে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সহযোগিতা বাড়ানো এবং উত্তর কোরিয়া মিশনে ট্রাম্পকে সহায়তা দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। প্রস্তাবে বিশেষজ্ঞরা যুক্তি তুলে ধরে বলেছিলেন, ট্রাম্প এখন যেটিই করছেন, সেটি নিয়েই সমালোচনার মুখে পড়ছেন। তিনি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কোনো রকম একটু সফলতা অর্জন করার ক্ষেত্রে যদি মস্কোর সমর্থন পান, তাহলে নিঃসন্দেহে রাশিয়ার প্রতি কৃতার্থ হবেন।

তাঁরা ক্রেমলিনকে বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন, যেহেতু কোরীয় উপদ্বীপ এলাকার স্থিতিশীলতার ওপর রাশিয়ার দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থ নির্ভর করছে, সেহেতু উত্তর কোরিয়া ইস্যুতে ট্রাম্পকে সহযোগিতা করতে বাধা কোথায়?

ওই গবেষকদের প্রস্তাব শুনে ক্রেমলিন এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে, সেটার সঙ্গে বিলি জোয়েলের ‘রাশিয়া ডিড নট স্টার্ট দ্য ফায়ার’ {এ আগুন (অর্থাৎ, দ্বিতীয় শীতলযুদ্ধ) রাশিয়া আগে জ্বালেনি} গানটির মিল রয়েছে। তার মানে, গবেষকদের প্রস্তাবের জবাবে ক্রেমলিন এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, যেহেতু আমেরিকাই রাশিয়ার সঙ্গে উত্তেজনাকর সম্পর্ক তৈরি করেছে, সেহেতু রাশিয়া আগ বাড়িয়ে তার সঙ্গে সমঝোতার সম্পর্ক পাতাতে যেতে পারে না।

সিঙ্গাপুরে কিম জং–উনের সঙ্গে ট্রাম্পের সম্মেলন শেষ পর্যন্ত হচ্ছে কি না, বিষয়টি বলা যায় এখনো ঝুলে রয়েছে। তবু এটুকু বলা যায়, দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে চলমান যুদ্ধাবস্থার আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি টানা এবং পরমাণু নিরস্ত্রীকরণের বিষয়ে উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ভালোই বোঝাপড়া হয়েছে। ঠিক এ রকম একটি সময়ে, যুক্তরাষ্ট্র ও উত্তর কোরিয়ার খেলার মধ্যে রাশিয়া ঢুকে পড়েছে এবং চমকে ওঠার কিছু নেই, রাশিয়া পিয়ংইয়ংয়ের পক্ষেই থাকছে।

গত সপ্তাহে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ হঠাৎই পিয়ংইয়ং সফর করেছেন। এতে বোঝা যাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর কোরিয়া নীতিকে বাধাগ্রস্ত করতে এবং সম্ভব হলে ব্যর্থ করে দিতে ক্রেমলিন চেষ্টা চালানো শুরু করে দিয়েছে। কিম জং–উনের হাতে লাভরভ পুতিনের লেখা একটি চিঠি তুলে দিয়েছেন এবং উনকে জানিয়ে দিয়েছেন, পুতিন এ বছরের শেষের দিকে পিয়ংইয়ং সফর করতে যাবেন।

উন-লাভরভ বৈঠকের যে খবরাখবর প্রকাশিত হয়েছে তা থেকে আন্দাজ করা যায়, কিমকে দেওয়া মস্কোর প্রধান উপদেশ হচ্ছে: ‘খবরদার, উত্তর কোরিয়া থেকে যুক্তরাষ্ট্র অবরোধ উঠিয়ে না নেওয়া পর্যন্ত কোনোভাবেই পরমাণু অস্ত্র কিংবা দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র কার্যক্রম নষ্ট করবেন না।’ উত্তর কোরিয়া ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র যা চায়, তার সঙ্গে রাশিয়ার দেওয়া এই উপদেশ সরাসরি সাংঘর্ষিক। যুক্তরাষ্ট্র চায়, উত্তর কোরিয়ার ওপর আরোপিত অবরোধ তুলে নেওয়ার আগে অবশ্যই পিয়ংইয়ংকে পরমাণু নিরস্ত্রীকরণের একটি বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ পেশ করতে হবে।

 মস্কো কয়েক দশক ধরে যে কায়দায় খেলে এসেছে, এবারও সে সেই একই কৌশলে খেলতে চাইছে। এর আগে রাশিয়া সাদ্দাম হোসেন, স্লোবোদান মিলোসেভিচ ও ভিক্তর ইয়ানুকোভিচের সামনে নিরাপত্তার নামে যে মুলা ঝুলিয়েছিল, এখন বাশার আল–আসাদের সামনে সেই একই জিনিস ঝুলিয়ে রেখেছে। মজার বিষয় হলো, মস্কো কিমকে এখন ঠিক সেই একই লোভ দেখাচ্ছে। এদের সবাইকে যে কথাটি বলে প্রলোভন দেখানো হয়েছিল বা হচ্ছে, তা এক লাইনে বলতে গেলে বলা যায়: ‘সরকার ফেলে দেওয়ার চেষ্টা মেনে নেওয়া হবে না’।

২০০৪ সালে ইউক্রেনে সংঘটিত অরেঞ্জ রেভল্যুশনের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র এবং একনায়কতান্ত্রিক সরকারগুলোর প্রতি ওয়াশিংটনের বৈরিতার বিরোধিতা করে আসছে ক্রেমলিন। গত কয়েক বছরে যুক্তরাষ্ট্র একের পর এক অনেক সরকার ফেলে দেওয়ার পর পুতিন এবং তাঁর ঘনিষ্ঠ বলয়ের লোকজন বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন, রাশিয়ায় সরকার বদলের মার্কিন চেষ্টা রুখতে হলে সবখানে সর্ব অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের নীতির বিরোধিতা জারি রাখতে হবে। তাহলেই যুক্তরাষ্ট্র ক্রেমলিনের সতর্কতা সংকেতকে, বিশেষ করে সাবেক সোভিয়েত দেশগুলোতে ক্রেমলিনের স্বার্থসংক্রান্ত বিষয়কে সম্মানের চোখে দেখবে।

তবে রাশিয়ার এই নীতি অতীতে কাজে দিয়েছে কিংবা এখন দিচ্ছে বলে তেমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। বাগদাদে সাদ্দামকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে, হেগে বিচার চলার সময়ই মিলোসেভিচ মারা গেছেন, ভিক্তর ইয়ানুকোভিচ (এঁদের মধ্যে সবচেয়ে সুখী মানুষ) কোটি কোটি ডলার চুরি করে মস্কোয় আশ্রয় নিয়ে এখন সেখানে বিভিন্ন রেস্তোরাঁয় ডলারগুলো ওড়াচ্ছেন। এর মধ্যে আসাদকে সবচেয়ে ভাগ্যবান মনে হচ্ছে। তিনি এখনো কোনোরকমে টিকে আছেন। যুক্তরাষ্ট্রের কোপানলে পড়া শাসকদের রক্ষা করার প্রলোভন দেখানোর নীতি এত দিন ঠিকমতো কাজ করেনি, তারপরও এই নীতি চালিয়ে যাওয়া ছাড়া মস্কোর সামনে এখন অন্য কোনো পথও নেই।

পুতিন ‘নতুন শীতলযুদ্ধকেই’ বাস্তবতা হিসেবে নিয়েছেন এবং সেই মতো কাজও করে যাচ্ছেন। এটিকেই তিনি দেশের ভেতরের বিরুদ্ধবাদীদের দমন করা এবং ‘পশ্চিমা আগ্রাসনের’ বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে জনমত গড়ার কাজে ব্যবহার করছেন। রাশিয়া মনে করে, ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ বা ‘আমেরিকার স্বার্থ আগে’ স্লোগানকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প, তাঁর পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও এবং নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন বোল্টন রাশিয়াকে বেকায়দায় ফেলার হাতিয়ার ছাড়া আর কিছুই মনে করেন না।

 লাভরভের উত্তর কোরিয়া সফরের মধ্য দিয়ে এটি স্পষ্ট হয়েছে, আমেরিকার সঙ্গে রাশিয়ার বৈরিতা একটি নতুন পর্যায়ে যাচ্ছে। এই অঞ্চলে দক্ষিণ কোরিয়া ও চীন যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত মিত্র। তাদের সঙ্গে পারস্পরিক বাণিজ্যিক নির্ভরতার সম্পর্ক রয়েছে। তাই চাইলেও তারা যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে গিয়ে উত্তর কোরিয়াকে বেশি সহায়তা দিতে পারবে না। কিন্তু রাশিয়ার সেই পিছুটান নেই। এ কারণে সে ট্রাম্পের উত্তর কোরিয়া মিশনকে ব্যর্থ করার চেষ্টা করবে। সে লক্ষ্য অর্জন তার পক্ষে খুব অসম্ভব হবে বলেও মনে হয় না।

 ডয়চে ভেলে থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনূদিত

 কনস্তান্তিন এগের্ত রুশ সাংবাদিক