শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক সুরক্ষা অবহেলিত

প্রস্তাবিত বাজেটে কোনো বড় ধরনের চমক নেই
প্রস্তাবিত বাজেটে কোনো বড় ধরনের চমক নেই

২০১৮-১৯ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে কোনো বড় ধরনের চমক নেই। বেশ কিছু অসংগতি আছে। বেশ বড় আকারের বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে। আমরা আশা করেছিলাম, এই বড় আকারের বাজেট কী করে বাস্তবায়িত হবে, তার একটি দিকনির্দেশনার উল্লেখ থাকবে এই বাজেট প্রস্তাবনায়, কিন্তু আমরা তা পাইনি।

এই বড় আকারের বাজেটের অর্থায়ন করার জন্য দেশি অর্থের উৎস হচ্ছে কর। তবে কর আদায়ের ক্ষেত্রে বড় সাফল্য, যেটিকে আমরা ‘রেজিম চেঞ্জ’ বলতে পারি, তা কখনোই হয়নি। প্রতিবছর ১৬-১৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধির মধ্যেই আমরা আটকে আছি। এ রকম পরিস্থিতিতে ৩০ শতাংশ কর সংগ্রহের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা একেবারেই বাস্তবসম্মত নয়। কর আদায়ে এ রকম উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও এ ক্ষেত্রে যে ধরনের সংস্কার প্রয়োজন, তা হয়নি। কর কাঠামোতে এবং যাঁরা কর আদায় করেন, তাঁদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন আসেনি। কিছু ক্ষেত্রে উন্নতি হয়েছে, তবে তা যথেষ্ট নয়। স্বল্প সময়ের মধ্যে করের পরিধি বিস্তৃত করার বিষয়টি বেশ জটিল। প্রকৃতপক্ষে করের পরিধি বাড়ানোর ক্ষেত্রে আমরা এখনো তেমন কোনো সাফল্য দেখাতে পারিনি। মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) আইন বাস্তবায়ন পিছিয়ে গেছে। শুল্ক আইনও পিছিয়ে যাচ্ছে। তাই অর্থনীতিতে বড় ধরনের যে গতিশীলতা আনার দরকার ছিল, তা ব্যাহত হয়েছে। এমনিতেই বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত পৃথিবীর মধ্যে অন্যতম সর্বনিম্ন। তাই প্রস্তাবিত বাজেটে যে পরিমাণ কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, তা অর্জন করা সম্ভব নয়।

গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, আমাদের মতো দেশে যত বড় আকারের বাজেটের প্রয়োজন, সে তুলনায় আমাদের বাজেটের আকার এখনো ছোট। আমরা যে বড় বড় লক্ষ্য অর্জনের কথা বলছি, বিশেষ করে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা, তার জন্য আরও অনেক বড় আকারের বাজেট প্রয়োজন। কিন্তু যদিও কয়েক বছর ধরেই বড় বাজেট দেওয়া হচ্ছে, বাজেট বাস্তবায়নের হার ক্রমেই কমছে। এখন বাজেট বাস্তবায়নের হার ৭৮-৮০ শতাংশে নেমে এসেছে। আমাদের উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন আছে, বাস্তবায়নের হারে ধীরগতি ও অতিরিক্ত খরচ করারও প্রবণতা আছে এবং এগুলো দীর্ঘদিনের সমস্যা। অনেক ক্ষেত্রে বাস্তবতার নিরিখে প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি করা হয় না। শুরুতে যে ব্যয় ও মেয়াদ প্রাক্কলন করা হয়, সে অনুযায়ী প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে না। এ কারণেই প্রকল্প চলাকালে আবার সংশোধন করতে হয়। সরকারের বিশাল পরিমাণ অর্থ অপচয় হচ্ছে প্রকল্প সংশোধনের কারণে। এখন আমরা বড় বড় মেগা প্রকল্পে যাচ্ছি, কিন্তু এখনো এ সমস্যা থেকে বের হয়ে আসতে পারিনি। আমাদের প্রকল্প বাস্তবায়নের যে চরিত্র, তা নিয়েই মেগা প্রকল্পের কাজ করছি। প্রকল্প পরিচালনার এবং বাস্তবায়নের দক্ষতার খুব বেশি উন্নতি হয়নি।

এ পরিস্থিতিতে আমরা এই বাজেটের বড় ধরনের বাস্তবায়নের বিষয়ে বেশি আশাবাদী হতে পারি না। যদিও সরকার এই বাজেটের মাধ্যমে একটি স্থিতাবস্থা ধরে রাখতে চাচ্ছে, নির্বাচনের বছর বলে বছরের শেষ দিকে অতিরিক্ত খরচের প্রবণতা দেখা দিতে পারে। বড় অঙ্কের অর্থ ছাড় করে মূলত বড় উন্নয়ন প্রকল্পগুলো দৃশ্যমান করার প্রচেষ্টা থাকবে। তবে তাড়াহুড়ো করে অর্থ ছাড়ের কারণে প্রকল্পের গুণগত মান থাকছে কি না, তা নজরে রাখার প্রয়োজনীয়তা আছে। আমাদের সামনে বেশ কিছু গাইডলাইন আছে। যেমন পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়ন। আশা থাকবে নির্বাচনের বছরে আমরা যেন সেসব গাইডলাইন থেকে বিচ্যুত না হই। নইলে সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়ন কক্ষচ্যুত হতে পারে। যদি প্রকল্প যাচাই-বাছাই না করে নির্বাচনকেন্দ্রিক খরচ বেড়ে যায়, তবে নির্বাচনোত্তর নতুন সরকারের জন্য তা বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। সেই সম্ভাবনা এড়াতে প্রয়োজন প্রকল্প ও কর্মসূচি বাস্তবায়নে সরকারের নজরদারি নিশ্চিত করা এবং অযথা অপচয় না করে প্রকল্প বাস্তবায়নের দক্ষতা বাড়ানো।

আমার মনে হয়, এ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাস একটি টানাপোড়েন থাকবে। আমাদের অর্থনীতিতে বেশ কিছু সংকট সৃষ্টি হয়েছে। বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যে বড় ধরনের সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে, ব্যাংক খাতে অস্থিরতা বিরাজ করছে, ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগে দীর্ঘদিন ধরে স্থবিরতা চলছে, কর্মসংস্থান সৃষ্টির জায়গাতেও স্থবিরতা আছে। এবারের বাজেটে এসব বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা নেই। এখন নির্বাচনের বছর বলে যদি প্রথম ছয় মাস এই চ্যালেঞ্জগুলোর দিকে নজর না দিয়ে নির্বাচনী বিষয়গুলোতে বেশি নজর দেওয়া হয়, তাহলে পরবর্তী ছয় মাসে বেশ কঠিন হবে এগুলো সমন্বয় করতে।

গত কয়েক বছরের বাজেটের চরিত্র দেখলে যে পরিবর্তনটা দেখা যায় তা হলো আমরা কিছু মেগা প্রকল্প নিয়েছি। কিন্তু অর্থনীতির ক্ষেত্রে যে সংস্কারগুলো প্রয়োজন, সেগুলোতে নজর দেওয়া হয়নি। যেমন সংস্কার প্রয়োজন আর্থিক খাতে, বৈদেশিক বাণিজ্যনীতিতে এবং কর কাঠামোতে। বিভিন্ন সময়ে সংস্কারের চেষ্টা করা হয়েছে, কিন্তু বাস্তবায়ন করা যায়নি। এ থেকে বলা যায়, এই সংস্কারগুলো করতে না দেওয়ার পেছনে যাদের কায়েমি স্বার্থ আছে, তারা যথেষ্ট শক্তিশালী। এবারের বাজেটে এসব বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট কথা নেই।

এবারের বাজেটে উন্নয়ন বাজেটের আকার বেড়েছে অনেক এবং তা আরও বাড়ানোর প্রয়োজন আছে। ভৌত ও সামাজিক অবকাঠামো উভয় ক্ষেত্রেই আমাদের বড় ধরনের উন্নতির প্রয়োজন। প্রতিবছরই দেখা যায়, অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে মাত্র ৫০-৫২ শতাংশ বাস্তবায়িত হয়, আর শেষ দুই মাসে বাস্তবায়নের জন্য তাড়াহুড়ো করতে হয়। বাস্তবায়ন বলতে মনে করা হয় অর্থ খরচ করা, কিন্তু বাস্তবে তা হওয়া উচিত নয়। দেখতে হবে গুণগত মান কতখানি অর্জিত হচ্ছে। যাঁরা গুণগত মান নিশ্চিত করতে পারছেন না, তাঁদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। যে ঠিকাদারদের তৈরি করা রাস্তা কিছুদিনের মধ্যেই নষ্ট হয়ে যায়, তাঁরাই কিন্তু বারবার কাজ পান। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিকভাবে শক্ত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। যাঁরা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ব্যত্যয় ঘটাচ্ছেন, তাঁদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। এবারের বাজেটে এসব ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার কোনো কার্যকর ও সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপের কথা নেই।

সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক খাতে যে সংকট চলছে, তার প্রতিকারের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কিছু এবারের বাজেটে নেই। সরকারি ব্যাংক খাতে এবারও মূলধন ঘাটতির জন্য বড় বরাদ্দ আছে, যা জনগণের করের টাকা। খেলাপি ঋণ ও অদক্ষতার কারণে সরকারি ব্যাংক খাতের দুরবস্থা; এর প্রতিকারের ব্যবস্থা না করে জনগণের ওপর দায় চাপানো কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। আর বেসরকারি ব্যাংক খাতে নানা কেলেঙ্কারি সত্ত্বেও তার প্রতিকারের যথাযথ ব্যবস্থা না করে করপোরেট করহারে ব্যাংকের মালিকদের ছাড় দিয়ে আদৌ কি ব্যাংক খাতে সুশাসন আনা যাবে? ব্যাংক সুদের হার কি এক ডিজিটে নামিয়ে আনা যাবে? অন্যদিকে ব্যক্তির করমুক্ত আয়ের সীমা আড়াই লাখ টাকা থেকে বাড়ানোর যে প্রস্তাব ছিল, তা করা হয়নি। এই পুরো বিষয়টি কি একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক আর্থিক খাতের ধারণার বিপরীত নয়?

শিল্প সুরক্ষার নামে শুল্ক হারে যেসব পরিবর্তনের প্রস্তাব এসেছে, তা নিতান্তই অ্যাডহক এবং সামগ্রিক বৃহত্তর শিল্পায়নের জন্য উন্নয়ন পরিকল্পনার অধীন নয়। আমাদের করনীতি এখনো রাজস্বভিত্তিক করনীতি, উন্নয়নভিত্তিক করনীতি নয়। এর উদাহরণ এবারের বাজেটে ই-কমার্স খাত থেকে ৫ শতাংশ ভ্যাট আদায়ের প্রস্তাব। যাঁরা সোশ্যাল মিডিয়াসহ বিভিন্ন অনলাইন মাধ্যমে বিভিন্ন সামগ্রী বিক্রি করে কিছু করার চেষ্টা করছিলেন, তাঁদের এখন কর দিতে হবে। এই প্রস্তাব সরকারের ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতের উন্নয়ন পরিকল্পনার একেবারেই বিপরীত।

এবারের বাজেটে কিছু ভালো উদ্যোগ রয়েছে। যেমন সামাজিক নিরাপত্তা খাতের পরিধি বাড়ানো, মেট্রোপলিটন শহরে দুটি গাড়ি থাকলে অথবা আট হাজার বর্গফুট ফ্ল্যাটের জায়গা থাকলে সারচার্জ এবং সর্বজনীন পেনশনের ধারণার সূচনা। কিন্তু এখনো আমরা জিডিপির মাত্র সোয়া ২ শতাংশ শিক্ষা খাতে ব্যয় করছি, স্বাস্থ্য খাতে করছি মাত্র শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ। অথচ স্বাস্থ্য খাতে জিডিপির ৪-৫ শতাংশ ব্যয় হওয়া উচিত, শিক্ষা খাতেও ব্যয় হওয়া উচিত এ রকমই। সামাজিক নিরাপত্তা খাতে পেনশন বাদ দিলে ব্যয় মাত্র জিডিপির সোয়া ১ শতাংশ। এসব ক্ষেত্রে এবারের বাজেটে বড় কোনো পরিবর্তন নেই, যা আছে তা হলো কিছু প্রান্তিক পর্যায়ে অর্থ বরাদ্দ। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তা খাতে এ রকম অর্থ বরাদ্দ নিয়ে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন অসম্ভব।

ড. সেলিম রায়হান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক এবং সানেমের নির্বাহী পরিচালক