একই চেতনায় মোদি-এরদোয়ান

নরেন্দ্র মোদি ও  রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান
নরেন্দ্র মোদি ও রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান

একজনের সঙ্গে অন্যজনের তুলনা করতে গেলে সেটি যেকোনো একজনের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়ানোর মতো মনে হয়। পৃথক দুই দেশের দুই রাজনৈতিক নেতার মধ্যে তুলনা করতে গেলে এটি আরও বেশি মনে হয়। তবে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবনের দীর্ঘ রেখাচিত্র এতটাই বর্ণাঢ্য যে তাঁদের দুজনকে নিয়ে তুলনা করাটা প্রায় অনিবার্য হয়ে ওঠে।

এরদোয়ান ও মোদি দুজনই খুব সাদামাটা মফস্বলী জীবন থেকে উঠে এসেছেন। তুরস্কের রিজে শহরের রাস্তায় রাস্তায় এরদোয়ান লেমোনেড আর প্যাস্ট্রি বেচতেন। আর মোদি গুজরাটের ভাদনগরের রেলস্টেশনে বাবার চায়ের দোকানে বাবা ও ভাইকে কেনাবেচায় সাহায্য করতেন। দুজনই ‘স্বনির্মিত’ মানুষ, দুজনই সুস্থ-সুঠাম। রাজনীতিতে নামার আগে এরদোয়ান পেশাদার ফুটবলার ছিলেন। আর মোদি নিজের ছাপ্পান্ন ইঞ্চি বুকের ছাতি নিয়ে যে বড়াই করে থাকেন, তা ভিত্তিহীন নয়।

দুজনই ধর্মীয় বিশ্বাসের মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠেছেন, রাজনৈতিক ক্যারিয়ারও গড়েন ধর্ম দিয়েই। এরদোয়ানের জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (একেপি) ও মোদির ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)—দুটি দলই ধর্মীয় জাতীয়তাবাদী মতাদর্শের ওপর দাঁড়িয়ে। যে ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ এ দুই দেশের উন্নয়ন-অগ্রগতি অর্জনে অতীতে ভূমিকা রেখেছে, এরদোয়ান ও মোদি দাবি করেন, সেই আদর্শের চেয়ে তাঁদের রাজনৈতিক মতাদর্শ অনেক বেশি আস্থাযোগ্য। তাঁরা উভয়েই ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য শুধু ধর্মপ্রাণ ভোটারদেরই দলে ভেড়াননি, আধুনিকতার প্রচারণাও চালিয়েছেন: দুর্নীতি কমানো ও ব্যবসাবান্ধব নীতির মাধ্যমে আগের সরকারগুলোর চেয়ে অনেক বেশি সমৃদ্ধি আনতে পারবেন।

দুজনই অতীত এবং ভবিষ্যতের ওপর জোর দিয়ে প্রচার চালান। এরদোয়ান তাঁর ভাষণে অটোমান সাম্রাজ্যের ঐতিহ্যের উচ্চ প্রশংসা করেন এবং ভোটারদের বলেন, ভোটের মাধ্যমে তাঁরা শুধু একজন প্রেসিডেন্ট ও তাঁর সহযোগীদের নির্বাচিত করেন না, বরং তাঁরা আগামী শতকে জাতির নিয়তি নির্ধারণ করে দেন। মোদিও একইভাবে প্রাচীন ভারতবর্ষের ঐতিহ্যের গল্প শোনান, উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখান। অল্প কথায়, এরদোয়ান ও মোদি—দুজনই অতীতকে মহিমান্বিত করার মাধ্যমে শক্তি সংহত করেছেন। অত্যন্ত চতুরভাবে তাঁরা নিজেদের দেশবিরোধীদের মোকাবিলা করতে নাঙ্গা তলোয়ার হাতে সাদা ঘোড়ায় ছুটে আসা নায়কদের মতো ভাবমূর্তি সৃষ্টি করেছেন।  উভয়ে বলেন, তাঁরা রাজনীতির বাইরের লোক। দেশপ্রেমহীন ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা দীর্ঘদিন যে ‘প্রকৃত’ ভারতীয় বা তুর্কি জনগণকে বঞ্চনার মধ্যে রেখেছে, তাঁরা সেই জনগণেরই লোক। প্রতিষ্ঠিত অভিজাত ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের বিরুদ্ধে এমনিতেই জনগণ অসন্তুষ্ট ছিল। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে মোদি ও এরদোয়ান এই শ্রেণির শোষণ এবং মধ্যবিত্তের বঞ্চনার কথা বলে গেছেন।

২০০৩ সালে এরদোয়ান যখন প্রধানমন্ত্রী হন, তখন বৈশ্বিক উল্লম্ফন ছিল। এতে তুরস্কের অর্থনীতি চাঙা হয়েছে এবং তাতে তাঁর ক্ষমতাও সংহত হয়েছে। ফলে তিনিও তুর্কি শাসনব্যবস্থাকে একটি পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে এগিয়ে নেওয়ার জন্য সাহসী হয়ে ওঠেন। ধর্মীয় পরিচয়ভিত্তিক একটি শক্তিশালী বলয়, বিজয়াকাঙ্ক্ষী সংখ্যাগুরুবাদ, উগ্র জাতীয়তাবাদ, সব খানে কর্তৃত্ববাদী বাড়ানো, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সীমিত করা, শক্তিশালী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও ব্যক্তি চরিত্রের অনন্য বৈশিষ্ট্য—এসব মিলিয়ে তাঁর রাজনৈতিক ফর্মুলা। এবং এই ফর্মুলা দিয়েই তিনি দুবার প্রধানমন্ত্রী হন এবং ২০১৪ সালে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট পদে বসেন।

মোদি ভারতকে বদলে দেওয়ার জন্য এরদোয়ানের এই ফর্মুলা গ্রহণ করেছেন; মুসলমানদের কোণঠাসা করে হিন্দুত্ববাদের একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন। মোদির জাতীয়তাবাদ সংখ্যালঘুদের শুধু অধিকার থেকে বঞ্চিতই করেনি, তাদের গায়ে বিশ্বাসঘাতকের তকমাও সেঁটে দিয়েছে। ফলে সংখ্যালঘুরা নিজেদের অবরুদ্ধ মনে করা শুরু করেছে। উপরন্তু, মোদির ভারতে রাজনীতিকেরা এখন নিজেদের বিক্রি করে দিতে পিছপা হচ্ছেন না। সংকীর্ণ গোষ্ঠীগত অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো নির্লজ্জভাবে পক্ষপাত করে যাচ্ছে। গণমাধ্যম ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিন্নমতাবলম্বীরা ভয়ভীতি প্রদর্শনের শিকার হচ্ছেন।

আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও মোদি ও এরদোয়ান একটি সমান্তরাল অবস্থান ধরে রেখেছেন। দুজনই দেশের ভেতরে নিজেদের ভাবমূর্তি জোরালো করতে সচেষ্ট, এ জন্য দুজনই প্রবাসীদের সমর্থন প্রার্থনা করেছেন।

বলকান অঞ্চলে এরদোয়ানের দেওয়া ভাষণ যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, সার্বিয়া ও ক্রোয়েশিয়াকে হয়তো ক্ষুব্ধ করেছে, কিন্তু এতে এরদোয়ানেরই লাভ। তারা এরদোয়ানের এসব বক্তব্যকে তুর্কিদের বক্তব্য হিসেবে নেয়। ঠিক একইভাবে মোদি যখন বিদেশের কোনো স্টেডিয়ামে বক্তব্য দেন, তখন স্টেডিয়াম ভরা প্রবাসীরা থাকেন। মোদি তাঁদের উদ্দেশে ভাষণ দিলেও তাঁর মূল টার্গেট অডিয়েন্স থাকেন ভারতের অভ্যন্তরীণ নাগরিকেরা।

তুরস্কের লেখক ও বিশ্লেষক সোনের কাপাতাগে এরদোয়ানকে নিয়ে লেখা একটি বইতে বলেছেন, ‘দেশের অর্ধেক লোক তাঁকে ঘৃণা করে এবং মনে করে তিনি সঠিক কিছুই করতে পারেন না। বাকি অর্ধেক লোক তাঁর পূজা করে এবং মনে করে তিনি ভুল কিছুই করতে পারেন না।’ ঠিক একই বক্তব্য মোদির বেলায় খাটে।

এটা ঠিক যে ভারত ও তুরস্কের মধ্যে খুব গুরুত্বপূর্ণ অনেক পার্থক্য আছে। তুরস্কের মোট লোকসংখ্যা ৮ কোটি ১০ লাখ। আর ভারতের উত্তর প্রদেশেই আছে তার দ্বিগুণ লোক। তুরস্কে ৯৮ শতাংশ মুসলমান। ভারতে ৮০ শতাংশ হিন্দু। ইসলাম একটি বৈশ্বিক মতবাদ। কিন্তু হিন্দুত্ববাদ সে রকম কিছু নয়। তুরস্কে মহাত্মা গান্ধীর মাপের নেতা নেই, যাঁর প্রাতঃস্মরণীয় অহিংসার বাণী প্রত্যেক শিশুর মননে অভিভাবকেরা ঢুকিয়ে দেন। তুরস্ক মোটামুটি উন্নত অর্থনীতির দেশ। কিন্তু ভারতকে সে পর্যায়ে যেতে দীর্ঘ সময় লাগবে। ভারতের মতো তুরস্ক কখনো উপনিবেশের শিকার হয়নি। ধর্মের ভিত্তিতে ভারত যেভাবে বিভক্ত হয়েছিল, সেভাবে তুরস্ক কখনো ভাঙেনি।

এরদোয়ান ও তাঁর একেপি তুরস্ককে যেভাবে হাতের মুঠোয় পুরে ফেলেছে, মোদি ও তাঁর বিজেপি এখনো সেভাবে ভারতকে কুক্ষিগত করতে পারেনি। একেপির চেয়ে বিজেপি ১১ বছর পিছিয়ে আছে। তবে মোদি হয়তো সেই দিকেই যেতে চাইছেন। এটি উদ্বেগের, কারণ তুর্কি মুদ্রা লিরার মতোই ভারতীয় রুপি গত মাসেই ডলারের তুলনায় ৫ শতাংশ মূল্য হারিয়েছে। দুই দেশেই নির্বাচন সন্নিকটে। তুরস্কে এ মাসেই। ভারতে আগামী বসন্তে। ভোটাররা কি উদ্বেগ দূর করতে পারবেন?

ইংরেজি থেকে অনূদিত। স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

শশী থারুর ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী