বাজেটের বার্তায় তবুও আশাবাদ

আরেকটি জাতীয় বাজেট জাতীয় সংসদে পেশ করলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। আগামী ১ জুলাই থেকে শুরু হতে যাওয়া ২০১৮-১৯ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটটি অর্থমন্ত্রীর টানা দশম বাজেট। এটির আকার ৪ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা; যা ১০ বছর আগেরটির তুলনায় চার গুণ বড়। ২০০৯-১০ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের আয়তন ছিল ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা। বছরের শেষ দিকে এসে কিছুটা কমিয়ে সংশোধিত আকার করা হয়েছিল প্রায় ১ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা। শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়ন হয়েছিল এক লাখ কোটি টাকার সামান্য বেশি।

অবশ্য প্রায় প্রতিবছরের বাজেটেই এ রকম অবস্থা হয়। আর এটা কোনো অস্বাভাবিক বিষয় নয়। প্রথমে যে লক্ষ্য ঠিক করা হয়, নানা কারণে তা বছরের শেষ ভাগে এসে কিছুটা কমিয়ে সংশোধন করা হয়। বছর শেষে হিসাব-নিকাশ কষে দেখা যায় যে বাস্তবে আরেকটু কম ব্যয় হয়েছে। এ কারণে বাজেট বাস্তবায়নের সামর্থ্য-সমতা নিয়ে একটা সমালোচনা আছে, আছে বিতর্ক। তবে বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতায় শেষ পর্যন্ত কোনো অর্থবছরে বাজেটের যতটুকু বাস্তবায়ন করা হয়, ততটুকু কতটা গুণগত মানসম্পন্ন, সেটিই এখন বড় বিবেচনা হওয়া জরুরি। টাকা খরচ করে কোনোভাবে একটা অবকাঠামো নির্মাণ করে ফেলার পর এই অবকাঠামো নির্মাণের সুফল কতটা মিলছে বা মিলবে, সেটাই ব্যয়ের গুণগত দিকটি তুলে ধরে।

প্রস্তাবিত বাজেটের বড় আকার থেকে বোঝা যায় যে সরকার আগের তুলনায় আরও বেশি অর্থ খরচ করতে আগ্রহী। যেহেতু অর্থনীতি বড় হয়েছে ও হচ্ছে, সেহেতু বাজেটেও বরাদ্দ বাড়াতে হচ্ছে। মোটা দাগে বাজেট বরাদ্দের দুটি দিক। একটি পরিচালন ব্যয়, অন্যটি উন্নয়ন ব্যয়। বাজেটে প্রায় ২ লাখ ৮৩ হাজার কোটি টাকা যাবে পরিচালন ব্যয়ে। আর বাকি প্রায় ১ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা উন্নয়ন ব্যয়ে। উন্নয়ন ব্যয় হলো রাষ্ট্রের বা সরকারের প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ। আর বিনিয়োগ মানেই তা থেকে যথেষ্ট প্রাপ্তি যোগ হতে হবে বা খরচ করা টাকা থেকে বিভিন্ন মানুষ বিভিন্নভাবে উপকৃত হবে। যত বেশি মানুষ উপকৃত বা লাভবান হবে, তত সেই বিনিয়োগ থেকে প্রাপ্তি বড় হবে।

ব্যয় বা বিনিয়োগ করতে হলে আবার আয় বা অর্থের সংস্থান করতে হবে। ব্যয়ের পরিকল্পনা বড় হলে আয়ের পরিমাণও বেশি হওয়া প্রয়োজন। আর এই প্রয়োজন মেটাতে গিয়ে নাগরিকদের কাছ থেকে বেশি করে কর আদায় করতে হবে সরকারকে। বাজেটে অর্থমন্ত্রী তাই ৩ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আদায় করার লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করেছেন, যার মধ্যে জনগণের কাছ থেকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর বাবদ আদায় হবে তিন লাখ কোটি টাকা। তবে শুধু কর-রাজস্ব আদায় করে যেহেতু কুলাবে না বা ব্যয় মেটানোর জন্য অর্থ ঘাটতি দেখা দেবে, সেহেতু ঋণ নিতে হবে। দেশের ভেতর থেকে ৭১ হাজার কোটি টাকার ও দেশের বাইরে থেকে ৫০ হাজার কোটি টাকার ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রাও ধার্য করা হয়েছে। আর চার হাজার কোটি টাকার বিদেশি সাহায্য পাওয়ার আশাও আছে অর্থমন্ত্রীর।

২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটে তিন লাখ কোটি টাকার বেশি রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করাটা কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলার জন্য যথেষ্ট। শেষ হতে যাওয়া ২০১৭-১৮ অর্থবছরের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৩১ শতাংশ বেশি পরিমাণ রাজস্ব আদায় করতে হবে, যার সিংহভাগই আসতে হবে কর থেকে। জানা কথা যে শেষ পর্যন্ত প্রস্তাবিত লক্ষ্যমাত্রার ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ অর্জিত হলেই তাতে তুষ্ট থাকতে হবে। তবে সেটুকু পরিমাণ কর আদায় করতে হলে আর যাই হোক, বড় কোনো কর ছাড়ের সুযোগ দেওয়া যাবে না বলে মনে করেছেন অর্থমন্ত্রী। সে কারণেই ব্যক্তি করদাতার করমুক্ত আয়ের সীমা আড়াই লাখ টাকাতে স্থির রেখেছেন। এর ফলে যাঁরা কর্মজগতে নতুন প্রবেশ করছেন ও যাঁরা বছর খানেক কাজ করার পর সামান্য একটু বাড়তি আয়ের মুখ দেখেছেন, তাঁদের এক বড় অংশকেই প্রথমবারের মতো করজালে বন্দী করা যাবে। আর একবার বন্দী করা গেলে সারা জীবন এ থেকে মুক্তি নেই! এভাবে ব্যক্তি আয়করদাতার সংখ্যা বাড়বে।

তুলনামূলক সীমিত বা স্বল্প আয়ের করদাতার এতে সবচেয়ে বেশি চাপে পড়বেন। মূল্যস্ফীতির কারণে প্রতিবছরই তাঁদের প্রকৃত আয় কিছুটা কমছে, সামনেও কমবে। মূল্যস্ফীতির হার গড়ে ৬ শতাংশের নিচে নেমে এলেও মূল্যস্ফীতিজনিত চাপ যে নেই, তা বলা যায় না। আর তাই প্রকৃত আয় কিছুটা খুইয়েও আয়কর প্রদানে কোনো ছাড় মিলবে না। এর সঙ্গে যদি অনিয়ম-দুর্নীতিজনিত বাড়তি ব্যয়ের বোঝা যোগ হয়, তাহলে প্রকৃত আয় আরেক দফা খোয়ানোর বিষয়টি চলে আসে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশের মানুষকে তাদের আয়-উপার্জন থেকে একটা অংশ অযাচিতভাবে ব্যয় করতে হয় শুধু রাষ্ট্র পরিচালন প্রক্রিয়ায় অনিয়ম-দুর্নীতির খেসারত হিসেবে।

ক্রমেই শক্ত হয়ে গেড়ে বসা অনিয়ম-দুর্নীতিও ক্রমে যেন গা সওয়া হয়ে উঠছে এ দেশের সাধারণ মানুষের কাছে। তারা নানাভাবে ক্ষোভ প্রকাশ করে, হতাশায় নিমজ্জিত হয়। তারপরও অনিয়ম-দুর্নীতির কাছে হেরে যায়, আপস করতে বাধ্য হয়। এর মধ্য দিয়ে আরেকটি সুবিধাভোগী গোষ্ঠী গড়ে উঠেছে, যাদের আয়-উপার্জন নির্ভর করে দুর্নীতির মাত্রা বিস্তারের ওপর। শাসন কাঠামোর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার সূত্রে এরাই হয়ে উঠেছে রেন্ট সিকার বা অনুপার্জিত আয় ভোগকারী। এঁরাই আবার কর না দিয়ে বা নানা কায়দায় কর ফাঁকি দিয়ে পার পেয়ে যেতে পারছেন।

বাজেটে পরোক্ষভাবে কর আদায় বাড়াতেও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) অনেকটা মরিয়া হয়ে উঠতে হয়েছে। সে কারণে যেখানেই কিছু লেনদেনের কর্মকাল রয়েছে, সেখানেই বসেছে মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাটের থাবা। বিশৃঙ্খলপূর্ণ রাজপথ আর গণপরিবহনের নৈরাজ্যে অসহায় মানুষের জন্য গাড়ি ও মোটরসাইকেলের মাধ্যমে যে রাইড শেয়ারিং সেবা কিছুটা স্বস্তি নিয়ে এসেছে, সেই সেবার ওপর পাঁচ শতাংশ হারে ভ্যাট বসিয়ে দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। নাগরিকদের জন্য সরকার একটি সুষ্ঠু গণপরিবহনব্যবস্থা গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছে, যদিও এই ব্যর্থতার দায় নিয়ে তার কোনো চিন্তা নেই। এমতাবস্থায় নাগরিকেরা নিজেরা যখন কিছু সীমিত বিকল্পে একটু স্বাচ্ছন্দ্য খুঁজছেন, সেটাও যেন আবার সহ্য হচ্ছে না রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিদের। বাজেটের পদক্ষেপ তো এমন বার্তাই দিচ্ছে!

প্রশ্ন হলো, বাজেটে কী তাহলে মন্দের পাল্লাই ভারী? উত্তরটা হলো, না, বিষয়টা তেমন নয়। প্রস্তাবিত বাজেটে সর্বজনীন পেনশনের বিষয়ে একটি রূপরেখা দেওয়া হয়েছে। কথিত শক্তিবর্ধক পানীয়ের (এনার্জি ড্রিংকস) ওপর সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো এবং প্লাস্টিক ও পলিথিন ব্যাগ উৎপাদনে শুল্কারোপ স্বাস্থ্য এবং পরিবেশ রক্ষার প্রতি বার্তা দিয়েছে।

পাশাপাশি সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর পরিধি ও উপকারভোগীর সংখ্যা বাড়ানো এবং অতি উচ্চবিত্তের সম্পদের ওপর সারচার্জ আরোপের মতো ইতিবাচক পদক্ষেপ আছে। এই পদক্ষেপগুলো অবশ্য বোঝায় যে বছর বছর অর্থনীতির উচ্চ প্রবৃদ্ধি হলেও তার ন্যায্য বণ্টন এখনো সুদূরপরাহত। এসব পদক্ষেপ এ-ও বুঝিয়ে দেয় যে আয়বৈষম্য নিয়ে অর্থমন্ত্রী চিন্তামুক্ত নন। বাজেট নিয়ে নানা যৌক্তিক-অযৌক্তিক হতাশা-নিন্দা-সমালোচনার মধ্যে এটা একটা আশাব্যঞ্জক দিক বটে!

আসজাদুল কিবরিয়া: সাংবাদিক।
[email protected]