কিম-ট্রাম্প বৈঠক কি সফল হবে?

কিম জং-উন ও ডোনাল্ড ট্রাম্প
কিম জং-উন ও ডোনাল্ড ট্রাম্প

ডোনাল্ড ট্রাম্প ও কিম জং-উন শেষ পর্যন্ত সিঙ্গাপুরে আলোচনার টেবিলে মিলিত হচ্ছেন। সেখানে তাঁরা উত্তর কোরিয়ার পরমাণু কার্যক্রম নিয়ে আলাপ করবেন। ট্রাম্পের টুইট বার্তা দেখে এখন পর্যন্ত মনে হচ্ছে, তিনি এই আলোচনায় অত্যন্ত আগ্রহী এবং তিনি বিশ্ববাসীকে দেখিয়ে দিতে চান, যা তাঁর পূর্বসূরিরা পারেননি, তা-ই তিনি করে দেখাবেন। তাঁর আচরণে মনে হচ্ছে, তিনি উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে চুক্তি করার বিষয়টিকে এখন অনেক বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন।

কথা হলো, ট্রাম্প ও কিম দুজনেই যে প্রকৃতির লোক, তাতে বৈঠক কী প্রক্রিয়ায় হবে, সেখানে কী আলোচনা হবে—এসব আগে থেকে নিশ্চিত করে কিছু বলা যাচ্ছে না। এমনকি দুজনের মধ্যে চুক্তি সই হয়ে যাওয়ার পরও সেই চুক্তি টিকে থাকবে; চুক্তি ভেস্তে যাবে না—এমন নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবে না।

১৯৯৪ সালে বিল ক্লিনটন উত্তর কোরিয়াকে আলোচনার টেবিলে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং পরমাণু কার্যক্রমের কিছু অংশ বন্ধ করার ‘ফ্রেমওয়ার্ক’-এ পৌঁছানোর পর তাঁদের সব উদ্যোগ ভেস্তে যায়। অবশ্য তখন ক্লিনটন উত্তর কোরিয়াকে একটু খাটো চোখে দেখেছিলেন বলে মনে হয়। উত্তর কোরিয়া যে আজকের এই অবস্থানে আসতে পারবে, সেটি তিনি আন্দাজ করতে পারেননি।

যা-ই হোক, বেশির ভাগ বিশ্লেষকই একমত হবেন, গত বছর ট্রাম্প টুইট করে যুদ্ধের হুমকি দেওয়ার পর যে আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি হয়েছিল, সিঙ্গাপুর বৈঠকের আয়োজন সেই পরিস্থিতিকে একেবারে প্রশান্ত করে দিয়েছে। তবে এখন বৈঠকের সাফল্য নির্ভর করছে এই দুই নেতার নেতৃত্বের ওপর।

ট্রাম্প ও কিম এই কূটনৈতিক মুহূর্তগুলো সামাল দেবেন। আলোচনা কোত্থেকে কীভাবে শুরু করতে হবে, তা তাঁরাই ভালো জানবেন। কোনো ধরনের সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে আলোচনা দীর্ঘ হতে পারে। একটি দীর্ঘমেয়াদি উত্তেজনা এক বৈঠকেই ঠান্ডা হয়ে যাবে এবং এক ধাক্কাতে চূড়ান্ত চুক্তিতে পৌঁছে যাওয়া যাবে, এমনটা আশা করা যায় না।

রোনাল্ড রিগ্যান এবং মিখাইল গর্বাচেভ বেশ কয়েক দফা চেষ্টা করার পর একটি পরমাণু চুক্তির বিষয়ে একমত হতে সক্ষম হতে পেরেছিলেন। ১৯৮৫ ও ১৯৮৭ সালের মধ্যবর্তী সময়ে গর্বাচেভ ও রিগ্যান তিনবার বৈঠক করেছিলেন। প্রথম দুবারের বৈঠক হতাশার মধ্য দিয়ে শেষ হয়। কিন্তু তাঁরা শেষ পর্যন্ত হতাশ হননি। তৃতীয়বার তাঁরা বৈঠক করে চূড়ান্ত চুক্তি করে করমর্দন করেন।

এখন পরমাণু ইস্যুতে সত্যিকার অর্থে অগ্রগতি অর্জন করতে হলে ট্রাম্প এবং তাঁর সমালোচকদের আগে
থেকেই সিঙ্গাপুর বৈঠকটিকে ধারাবাহিক কয়েকটি বৈঠকের একটি ভূমিকা হিসেবে ধরে নিতে হবে। অর্থাৎ, মনে করতে হবে, ১২ জুনের বৈঠকটি হবে পরবর্তী কয়েক দফা বৈঠকের মূল ভিত্তি।

একটি সম্মেলন হলে সেটির সূত্র ধরে পরে আরও একটি সম্মেলন হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। রিগ্যান প্রশাসনের অনেকেই প্রথমে বুঝেছিলেন, ১৯৮৫ সালে অনুষ্ঠিত রিগ্যান ও গর্বাচেভের প্রথম বৈঠক খুব কাজের বৈঠক হবে না। প্রথম দিকে গর্বাচেভের কথাবার্তা মার্কিন কর্মকর্তারা পছন্দ করতে পারেননি এবং তাঁরা মনে করেছিলেন, সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে তাঁদের মতভিন্নতার ব্যাপ্তি এতটাই যে দুই পক্ষের একমত হওয়া প্রায় অসম্ভব।

কিন্তু রিগ্যান হতাশ হননি। তিনি একটু বিরতি নিয়েছেন। তিনি ভেবেছিলেন, দুই পক্ষের সন্দেহ খানিকটা কমলে আবার আলোচনার উদ্যোগ শুরু হবে। পরে আবার বৈঠকে বসেছেন। আবার চরম উত্তেজনাকর পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে বৈঠক শেষ হয়েছে। পরে ১৯৮৭ সালে তাঁরা একটি সমাধানের পথ খুঁজে বের করতে সক্ষম হন।

এ ধরনের বৈঠক সফল হতে হলে আগে থেকে নির্ধারিত একটি সুস্পষ্ট লক্ষ্য ধরে এগোতে হয়। সাবেক প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারকে নিয়ে তাঁর তৎকালীন উপদেষ্টা স্টুয়ার্ট এইজেনস্টাট একটি বই লিখেছেন। সেখানে এইজেনস্টাট বলেছেন, ইসরায়েল ও মিসরের মধ্যে সমঝোতার জন্য ক্যাম্প ডেভিডে জিমি কার্টার যখন মধ্যস্থতা করেছিলেন, তখন তাঁকে একটি পয়েন্টেই দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে দেখা গেছে। যখনই মিসর ও ইসরায়েলের নেতারা আলোচনার টেবিল থেকে উঠে যেতে চেয়েছেন, তখনই তিনি তাঁদের টেনে ধরে আবার টেবিলে বসিয়েছেন এবং বলেছেন, এই অঞ্চলের শান্তির জন্য সমঝোতাই একমাত্র পথ। সমঝোতার চেষ্টার বাইরে আর কোনো সমাধান নেই।

সিঙ্গাপুর বৈঠকের ক্ষেত্রে ট্রাম্পের অনেক সীমাবদ্ধতা আছে বলে মনে হয়। তিনি চঞ্চলমতি। উত্তর কোরিয়া ইস্যুতে তিনি লম্বা সময় দেবেন না বলে ইতিমধ্যে ইঙ্গিতও দিয়েছেন। এটি একটি আশঙ্কার দিক। উত্তর কোরিয়ার পরমাণু কার্যক্রম স্থায়ীভাবে বন্ধ করার চুক্তিতে পৌঁছাতে হলে ট্রাম্পকে এই বিষয়ে দীর্ঘ সময় দেওয়ার মানসিকতা ধারণ করতে হবে।

দুই পক্ষের মধ্যে আলোচনা সফল হতে হলে আলোচ্য বিষয়ের ওপর আলোচকদের বিশদ জ্ঞান থাকা দরকার। এ ক্ষেত্রেও ট্রাম্পের সীমাবদ্ধতা আছে। রিচার্ড নিক্সন যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীনের নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হতেন, তখন তিনি ও তাঁর সঙ্গে থাকা পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার সেই বিষয়ে বিশদ পড়াশোনা করে বৈঠক করতেন। এতে প্রতিপক্ষের চাওয়া-পাওয়া সম্পর্ক তাঁরা আগে থেকেই একটি ধারণা পেতেন। আলোচনা সমৃদ্ধ হতো। কিন্তু ট্রাম্পের ক্ষেত্রে সেই বিশদ জ্ঞানের অভাব রয়েছে।

সিঙ্গাপুর বৈঠকে যোগ দেওয়ার আগে জি-৭ সম্মেলনে ট্রাম্প সেখানকার নেতাদের সঙ্গে যে আচরণ করে এসেছেন, সেটিও পরিণত রাজনীতিকের আচরণ নয়। তাই সিঙ্গাপুর বৈঠকে তিনি তাঁর ধৈর্য কতটা স্থির রাখতে পারবেন, সেটা খুবই বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে।

এ ধরনের বৈঠকের সাফল্যের ক্ষেত্রে গোপনীয়তা রক্ষার বিষয়টিও খুব গুরুত্বপূর্ণ। নিক্সন ও কিসিঞ্জার যখন চীন সফর করেছেন, তখন চীন পৌঁছানোর ২৪ ঘণ্টা আগে সে খবর চাউর হয়নি। আর ট্রাম্পের ক্ষেত্রে উল্টো চিত্র দেখা গেছে। ট্রাম্প প্রায় ভাবনাচিন্তা ছাড়াই যখন খুশি টুইট করে যাচ্ছেন।

তবে শেষ পর্যন্ত ট্রাম্প যে কিমের সঙ্গে আলোচনায় বসছেন, এটিই বিরাট অগ্রগতি। এই বৈঠকের সাফল্য-ব্যর্থতার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। এই বৈঠক সফল করার মাধ্যমে নিজ নিজ রাজনৈতিক প্রজ্ঞা প্রদর্শনেরও সুযোগ পেয়েছেন তাঁরা। সেই সুযোগ তাঁরা কতটা কাজে লাগাতে পারবেন, সেটিই এখন দেখার বিষয়।  

সিএনএন থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনূদিত

জুলিয়ান জেলিজের সিএনএনের রাজনৈতিক বিশ্লেষক