কোরআন নাজিলের রজনী লাইলাতুল কদর

বিশ্ব মুসলিম মননে সর্বাধিক পবিত্র ও মহিমান্বিত রাত হচ্ছে লাইলাতুল কদর। এই মহান মর্যাদাময় রাত্রিতেই বিশ্ব মানবতার সর্বশ্রেষ্ঠ মুক্তির সনদ ও সর্বযুগের সর্ব জাতির পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থার অপরিবর্তনীয় বিধান গ্রন্থ আল-কোরআন নাজিল করা হয়েছিল।

ভারতীয় উপমহাদেশ, পারস্যসহ পৃথিবীর অনেক দেশের ফারসি, উর্দু, বাংলা, হিন্দিসহ নানা ভাষাভাষী মানুষের কাছে এটি ‘শবে কদর’ নামেই সমধিক পরিচিত। ‘শব’ শব্দটি ফারসি, অর্থ হলো রাত্রি বা রজনী; ‘কদর’ শব্দটি আরবি, অর্থ হলো মহিমা, সম্মান ও মর্যাদা, গুণাগুণ, সম্ভাবনা, ভাগ্য ইত্যাদি। ‘শবে কদর’ অর্থ মর্যাদার রাত্রি, ভাগ্য রজনী। শবে কদর-এর আরবি হলো ‘লাইলাতুল কদর’ তথা সম্মানিত রাত্রি। এ রাতেই প্রথম পবিত্র মক্কা মুকাররমার জাবালে রহমত তথা হেরা পর্বতের গুহায় মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের পক্ষ থেকে ফেরেশতাদের সরদার হজরত জিবরাইল (আ.)-এর মাধ্যমে বিশ্ব নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রতি মহাগ্রন্থ আল–কোরআন অবতীর্ণ হয়। আল্লাহ তাআলা বলেন: ‘রমজান মাস! যে মাসে কোরআন নাজিল হয়েছে মানবের দিশারিরূপে ও হিদায়াতের সুস্পষ্ট নিদর্শন।’ (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ১৮৫)।

আসমানি এক শ সহিফা ও চারখানা কিতাবসহ মোট এক শ চারটি কিতাবের মধ্যে আল–কোরআন সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ আসমানি কিতাব। এই কোরআনের স্পর্শ বড়ই সৌভাগ্যের। সংস্পর্শে একটি সাধারণ রাত ‘লাইলাতুল কদর’ বা ‘শবে কদর’ রজনীর সম্মানে বিভূষিত হয়েছে। কোরআনের সঙ্গে যাঁর যতটুকু সম্পর্ক ও সংস্পর্শ থাকবে তিনি ততটুকু সম্মানিত ও মর্যাদার অধিকারী হবেন। প্রিয় হাবিব (সা.) বলেন, ‘কোরআনওয়ালা-ই আল্লাহওয়ালা এবং তাঁর প্রিয় ব্যক্তি।’ (বুখারি)। ‘যার অন্তরে কোরআনের সামান্যতম অংশও নেই, সে যেন এক বিরান বাড়ি।’ (বুখারি ও মুসলিম)। রাসুলে আকরাম (সা.) আরও বলেছেন: ‘তোমরা রমজানের শেষ দশকের বেজোড় রাত্রগুলোতে শবে কদর সন্ধান করো।’ (মুসলিম)। এ রাতগুলো হলো ২১, ২৩, ২৫, ২৭ ও ২৯। আরবিতে দিনের আগে রাত গণনা করা হয়।

পবিত্র কোরআনে এই শুভ রজনীর আধ্যাত্মিক মাহাত্ম্য বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে একটি সুরায়, যার নাম সুরা কদর। মক্কায় অবতীর্ণ পাঁচ আয়াতবিশিষ্ট এই সুরা কোরআন মজিদের ৯৭তম সুরা। এই সুরায় আল্লাহ তাআলা বলেন: ‘নিশ্চয়ই আমি কোরআন নাজিল করেছি মর্যাদাপূর্ণ কদর রজনীতে। আপনি কি জানেন মহিমাময় কদর রজনী কী? মহিমান্বিত কদর রজনী হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। সে রাতে ফেরেশতাগণ রুহুল কুদুস ও হজরত জিবরাইল আলাইহিস সালাম সমভিব্যাহারে অবতরণ করেন; তাদের প্রভু মহান আল্লাহর নির্দেশ ও অনুমতিক্রমে, সকল বিষয়ে শান্তির বার্তা নিয়ে। এই শান্তির ধারা চলতে থাকে উষার উদয় পর্যন্ত।’

মুফাসসিরগণ বলেন, ‘আরবিতে “লাইলাতুল কদর” শব্দদ্বয়ে নয়টি হরফ বা বর্ণ রয়েছে; আর সুরা কদরে লাইলাতুল কদর শব্দদ্বয় তিনবার রয়েছে; নয়কে তিন দিয়ে গুণ করলে সাতাশ হয়, তাই সাতাশে রমজানের রাতে শবে কদর হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।’ (তাফসিরে মাজহারি)।

হজরত আয়িশা সিদ্দিকা (রা.) রাসুলুল্লাহ (সা.) কে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল (সা.) ! আমি যদি লাইলাতুল কদর সম্পর্কে জানতে পারি, তাহলে আমি ওই রাতে আল্লাহর কাছে কী দোয়া করব?’ রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন; তুমি বলবে, ‘আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউন, তুহিব্বুল আফওয়া; ফাফু আন্নি।’ ‘হে আল্লাহ! আপনি শ্রদ্ধাশীল, ক্ষমা ভালোবাসেন; তাই আমাকে ক্ষমা করেন।’ (ইবনে মাজা, সহিহ্-আলবানি)। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন: ‘যে ব্যক্তি ইমানের সঙ্গে সওয়াবের নিয়তে কদরের রাতে ইবাদত করবে; তার অতীতের গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে।’ (বুখারি, ইমান অধ্যায়, পরিচ্ছেদ: ২৫, খণ্ড: ১, পৃষ্ঠা: ২৯-৩০, হাদিস: ৩৪)।

লাইলাতুল কদরের আমল হলো: নফল নামাজ: তাহিয়্যাতুল অজু, দুখুলিল মাসজিদ, আউওয়াবিন, তাহাজ্জুদ, ছলাতুত তাসবিহ, তাওবার নামাজ, সলাতুল হাজাত, সলাতুশ শোকর ও অন্যান্য নফল ইত্যাদি পড়া। নামাজে কিরাআত ও রুকু-সিজদা দীর্ঘ করা। কোরআন শরিফ: সুরা কদর, সুরা দুখান, সুরা মুজ্যাম্মিল, সুরা মুদ্দাচ্ছির, ইয়া-সিন, সুরা ত-হা, সুরা আর রহমান ও অন্যান্য ফজিলতের সুরা তিলাওয়াত করা; দরুদ শরিফ বেশি বেশি পড়া; তাওবা ইস্তিগফার অধিক পরিমাণে করা; দোয়া-কালাম, তাসবিহ তাহলিল, জিকির আজকার ইত্যাদি করা; কবর জিয়ারত করা; নিজের জন্য, পিতা-মাতার জন্য, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব ও সব মোমিন মুসলমানের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা এবং দেশ, জাতির কল্যাণ ও সমৃদ্ধি কামনা করা।

মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতির যুগ্ম মহাসচিব ও আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম–এর সহকারী অধ্যাপক

smusmangonee@gmail,com